September 20, 2024
জীবনের গল্পফিচার ২

আমরা মা-মেয়ে দুজন দুজনের শিক্ষক

রুখসানা কাঁকন।। আমার একুশ বছরের মেয়ে সকালে উঠে প্রথম চিন্তা করে তার দিন যেন প্রোডাক্টিভ হয়। মেডিটেশন দিয়ে সকাল শুরু করার শিক্ষাটা আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছি ।

আমরা মা মেয়ে নানা বিষয়ে কথা বলি যেমন মানুষ তার ভালবাসা কেন পুরোটাই তার পেশায় ঢালতে পারে না ? এর বড় কারণ মানুষ তার সঠিক পেশা বাছতে পারে না।

আমার মেয়ে বলে, সে তার সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করার কর্মসূচি পরবর্তিতে ধরে রাখতে চায় । তাই সে এমন পেশা নিতে চায় যে পেশা যেন তার সামাজিক এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে যোগসূত্র তৈরি করে।
সে  ভিগান আর একজন ভিগান ব্লগার হিসাবে তার শেখার কোন শেষ নাই আর তাই কিভাবে আরো মানুষকে ইন্সপায়ার্ড করতে পারে সে সব নানা তথ্য নিয়ে আমরা কথা বলি। তার মা এখনো ভেজিটেরিয়ান, দুধ ডিম মার প্রিয় খাবার বিধায় মনে মনে দুঃখ পেলেও মেনে নিয়েছে। আর এই মেনে নেয়ার ক্ষমতা নিয়ে আমরা নানা রকম আলাপ করি। তবে সে প্রায়ই বলে বাংলাদেশের বহু মেয়ে প্রেম ভালবাসাহীন জীবন মেনে শুধুমাত্র একটা ফেক সংসার রাখা করার জন্য যুদ্ধ করে, এটা তাকে কষ্ট দেয়।

মায়ের অনেক কিছু তার পছন্দ। স্পষ্ট কথা বলা, সততা মেনে চলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তার পুরোটাই সে শিখতে চায়। চিন্তার অনেক কিছুতে আমরা কখনো কখনো ভিন্নমত পোষন করি আর আমরা দুই জন আমাদের ভিন্নতাগুলো কে প্রাণ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। আমার ইচ্ছা যেন তার ইচ্ছা হয় এমন মনোভাব পোষণ করি না। যেমন জীবনসঙ্গী নির্বাচনে আমি আগে এক আধটু নাক গলালেও এখন আমি পুরোটাই তার উপর ছেড়ে দিয়েছি। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি সন্তানদের নিজের ক্ষমতা আর ইচ্ছাশক্তির উপর বিশ্বাস রাখতে হয়।

অনেকে বলে তুমি কত অল্প বয়সে এতটুকু মেয়েকে ভ্রমণ করতে দিয়েছ কিন্তু আমি আমার মেয়ের এই ক্ষমতাটাকে বুঝতে পেরেছিলাম আর ও আমাকে বুঝাতে পেরেছিল। আমার মেয়ে যেদিন একা কানাডা যেতে চাইল, তাকে আমি বললাম, ‘তুমি আর আমি ভেনিসে যাব আর এখানে তুমি আমার গাইড।’ ভ্রমণের সময় তার আচরণ, অন্য একটা দেশে নিখুঁত করে সব কিছু পারার ক্ষমতা আমাকে বলে দিল তোমার মেয়েকে ব্যাকপ্যাক কাঁধে দিয়ে ছেড়ে দাও। আঠার বছর বয়সে সে পৃথিবী ঘুরে দেখতে শুরু করে, নানা মানুষ আর পরিবেশের সাথে পরিচিত হয় আর তার এই মানুষ চেনার ক্ষমতা আর যে কোন পরিবেশে শক্ত হবার ক্ষমতা আমাকে বলে দেয়, আমি মেয়েকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ভুল করিনি।


সন্তানের কাছ থেকে বিশ্বাস আর আস্থা ছোট বড় নানা কাজে আমি উপলব্ধি করে শিখছি।

আমি মনে করি না অনেক লেখাপড়া আর ভালো পাত্র পেলে মেয়ের জীবন ঝকঝকে হয়ে যায় না। আপনার মেয়ে সন্তানের মননে আর মেধায় কতটা কারিশমা আছে তাই বুঝতে চেষ্টা করুন। প্রেম, ভালবাসা, সঙ্গী মানুষ নিজের মত চিন্তা, চেতনা, ভুল ভ্রান্তি আর জীবনবোধ দিয়ে তার মত করে খুঁজে নেয়।

‘কৈ গেলি, কেন করলি, কেন শিখলি না’— এসব জুলুম একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস ভাঙার জন্য যথেষ্ট। এসব আমি পারতপক্ষে করি না।

আমার মেয়ের সাথে আমি যে কোন বিষয়ে কথা বলতে পারি। সেক্স, হোমোসেক্সুয়ালিটি এগুলো খোলাখুলি যে কোন টপিক আমাদের টেবিলে ঘুরে ফিরে আসে। পৃথিবীর বর্ণবাদ, হিংসা, অন্য মানুষকে জাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের ভুলগুলো আমরা বলি আর সংশোধন করতে চেষ্টা করি। একটি কন্যা আপনার কত বড় বন্ধু হতে পারে তা শুধু রান্না করে প্লেটে গরম ভাত ঢেলে দিলে বুঝা যায় না।
মা আর মেয়ে একে অন্যকে সময় দিতে হবে আর সেই সময়টা হবে একে অন্যের মতামত বোঝার আর ধারন করার ক্ষমতা জন্মানোর সময়। নিজেদের দুঃখ, বেদনা, হাসি মন খুলে বলতে হবে, অভিমান আর অভিযোগ মন খুলে বলে দিয়ে তৈরি হতে পারে একটা শক্ত বন্ধন।

একে অপরের বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নতা থাকতে পারে কিন্তু তার মানে এই নয় যে একে অপরকে দোষী করতে হবে। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না, মা হয়ে ওঠা এক বিরাট প্রসেস। মা আর মেয়ে। দুজন দুজনেরই শিক্ষক।

স্বাধীনতা হরণকারী পিতামাতার চরিত্রগুলো আমার ভীষণ অপছন্দ। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে তার স্বাধীনতা দিয়ে বেড়ে উঠতে দিতে হয়। সন্দেহ আর স্বাধীনতা এক সাথে কাজ করে না। তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে, তুমি কার সাথে ঘুরতে চাও এসব প্রশ্ন করে আমি বুঝতে পেরেছি আমার মেয়ের কাছে এসব বিরক্তিকর আর বিব্রতকর। দিন শেষে আমার মেয়ের সেই শিক্ষা আছে সে দিয়ে সে বুঝবে তার মায়ের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় হয়েছে ।

ছোট বেলায় যে শিশু আপনার কথা মত খেলেছে, বলেছে, করেছে আর লক্ষ্মী মেয়ে হবার মন্ত্র জপতে থাকেন যদি আপনি আজন্ম – তাহলেই বিরাট ভুল।

লক্ষ্মী মেয়ে না, পক্ষী মেয়ে তৈরি করেছি আমি। আকাশ ঘুরে, মাটি ফুঁড়ে সে মাকে জানান দেয় সে কী শিখেছে, লড়েছে বা জিতেছে।

একাডেমিক পড়া নিয়ে মাথার চুল না ছিঁড়ে ফেলা- এ আমার আরেক শিক্ষা। মনের আনন্দে পড়ে আমার মেয়ে। মিডিয়া মার্কেটিং। তার নিজস্ব চিন্তা চেতনা দিয়ে সে তার পড়াশুনা করে। দিনের শেষে বরং আমি তার প্ল্যান শুনি, তার থিংস টু ডু র লিস্ট আমাকে বলে দেয়— তোমার মেয়ে ঠিক ট্র্যাকে আছে, তাকে চলতে দাও।

একবার সে ষোল বছর বয়সে একটা দোকানে কাজ খুঁজতে চাইল। কিন্তু ভড়কে গিয়ে বলে, ‘মা আমি অনেক ছোট ওরা ইউনি স্টুডেন্টদের দেবে কাজটা’।
আমি বললাম, ‘আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বল। বল- আমি পারব’।

ইন্টারভিউ দিয়ে পিচ্চি মেয়েটার কাজ হয়ে গেল।

মেয়েকে নিয়ে লিখতে বসলে ইতিহাস রচনা হয়ে যাবে। তবু মা মেয়ের জীবনছন্দের কথা লিখতে বসলাম মমতার গন্ধে। এয়ারপোর্টে ট্রাভেল করার আগে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য অন্য শহরে যখন যায় তখন আমাকে বলে এইত মা আর কয়টা দিন..।

আমার বুকে কান্না জমে কিন্তু আমি বেঁধে রাখি না।

একবিংশ শতাব্দীতে আমার কন্যাকে আমি পৃথিবীর কাছে সম্প্রদান করেছি আর তাই সে আকাশে উড়ছে, অক্ষ খুঁজছে। আর আমি মা হয়ে উঠছি আমার শূন্যতা, হতাশা কিংবা ভালোবাসার টুকরো মাখা পৃথিবীতে আর প্রতিদিন সেখানে মেয়েটার হাত ধরে হাঁটছি আর শিখছি।

আমার মেয়ের কাছে আমি নাকি একজন Cool Ma!