নারীবাদ নিয়ে সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা মাথা থেকে দূর করুন
তাসনিয়া আল সুলতানা।। গত কয়েকদিন আগে ফেইসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে একটা খবরে চোখ আটকে গেল। আফগানিস্তানে দুই নারী বিচারপতি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত। আই রিপিট, বিচারপতি। যেখানে রাষ্ট্র বিচারপতির আসনে বসা যেকোনো ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, সেখানে একটি রাষ্ট্রের দু’দুজন নারী বিচারপতি সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হলেন! লিংকে ক্লিক করে যখন পুরো খবরটা পড়লাম তখন রীতিমতো চমকে উঠলাম। জানতে পারলাম, গত কয়েকমাস ধরেই আফগানিস্তানে নারী সংবাদকর্মী, রাজনীতিবিদ, লেখিকা অর্থাৎ যে সমস্ত পেশা সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে তাদেরকেই টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে।
আপনার কাছে মনে হতে পারে, এ আর নতুন কি? আফগানিস্তানের মতো দেশে এসব তো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ওখানে তো এসব ঘটনাকে তুচ্ছ ঘটনা হিসেবে বিচার করা হয়। এসব বলেই যখন চায়ে চুমুক দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আপনি খুব স্বাভাবিকভাবে আপনার দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কাজ করতে থাকেন তখন কি মাথায় একবারও এসেছে, আপনার দেশে আপনি নিরাপদ কিনা? অথবা আপনি যদি পুরুষ হয়ে থাকেন তখন একবারটি কি ভেবে দেখেছেন, আপনার সাথে কাজ করা আপনার নারী সহকর্মীটি নিরাপদ কিনা? কিংবা আপনার মা, কন্যা, বোন, স্ত্রী এরা নিরাপদ কিনা?
পুরো পৃথিবীর বেশ কয়েকটা রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনা করে অনেক ছোট বয়স থেকেই এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছি যে একজন নারী যখন শিক্ষা-দীক্ষা এবং যোগ্যতায় অনেক উঁচু অবস্থানে চলে যায় তখনই সে সমাজের সবার চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ায়। সেটি হোক আফগানিস্তান, ইরান কিংবা পাকিস্তান অথবা হোক ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা আমেরিকা। অনেকে এটি ধারণা করে থাকবেন যে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ মনে করে তাদের সমমর্যাদা দেওয়া হয়। এটি সম্পূর্ণ একটি ভ্রান্ত ধারণা। দেশের ভৌগলিক, আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন কোথাও কম অথবা কোথাও বেশি হতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে সমাজে নারীদের অবস্থান এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও খুব একটা সুবিধার নয়।
২০০৮ সালের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ তথা Fourth Wave of Feminism চলছে। এই তরঙ্গের মূল কথা হলো নারীর প্রতি ঘটা যৌন হয়রানী, লাঞ্ছনা এবং স্ত্রী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই আন্দোলনের সূত্রপাত পশ্চিমা দেশগুলোতে হলেও ধীরে ধীরে এই আন্দোলন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় পাড়ি দেওয়ার পরও এখন অব্দি এই আন্দোলন খুব একটা সফলতার মুখ দেখে নি।
নিজ দেশের কথাই বলি। পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত, নারী নিজ যোগ্যতায় সব বাধা উপেক্ষা করতে সক্ষম এটি এখনও সমাজের বেশিরভাগই মানতে নারাজ। বরং যখনই নারী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেয়েছে তখনই কোনো না কোনোভাবে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রে নারীকে হেনস্থা হতে হয়েছে চরমভাবে। কারণ সমাজের সেই তীক্ষ্ম দৃষ্টি উপেক্ষা করার শক্তি, সে যতই শিক্ষিত এবং যোগ্যতাসম্পন্ন নারী হোন, সবাই অর্জন করতে শেখেননি এখনো।
এখন আসা যাক নারীর এই দুর্বলতার উৎস কোথায় সে প্রসঙ্গে। এই দুর্বলতার উৎস আপনি, আমি, আমাদের থেকেই হয়, আমাদের পরিবার থেকেই আসে। পরিবার থেকেই যেহেতু সমাজের উৎপত্তি সেহেতু “নারী মাত্রই দূর্বল” নামক এই রোগ ক্যান্সারের মতোই সমাজের প্রতিটি কোণায় পৌঁছে দিতে আমরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই কিন্তু সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছি। নারী সমাজের চোখে দুর্বল, তাই তাকে হেয় করা যায়, লাঞ্ছিত করা যায়, তার সাথে যেমন ইচ্ছে তেমন করেই অবলীলায় অন্যায় আচরণ করা যায়। আর নারীও তা সহ্য করে যান মুখ বুজেই, কারণ তাকে তো এই পাঠ বহু আগেই পড়ানো হয়েছে যে সে যতই শিক্ষিত হোক, যোগ্যতাসম্পন্ন হোক, তার অবস্থান কখনোই একজন পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে না। পুরুষরা একজন নারী কে সর্বোচ্চ তার সহকর্মী পর্যন্ত মেনে নিতে পারে, কিন্তু সেই সহকর্মী থেকে উঁচু অবস্থানে গেলেই শুরু হয় সেই নারী সম্পর্কে অপবাদ, বিভিন্ন প্রকার হয়রানীমূলক আচরণ, তার প্রতি প্রফেশনাল জেলাসি। এমনকি সেই নারীর জীবন নিতেও কেউ কেউ দ্বিধাবোধ করে না, এমন ঘটনার উদাহরণ তো শুরুতেই দিয়েছি। তবে আশার কথা হলো এখনো বেশ কিছু নারী এবং পুরুষ সমাজের এই কন্টক উপড়ে ফেলার চেষ্টা করছেন, কারণ তারা স্বপ্ন দেখেন একদিন এই পৃথিবী নারীর জন্য বাসযোগ্য হবে। কারণ একজন নারী সবার আগে একজন মানুষ। আর মানুষ হিসেবে সমাজে সবাই সমান অধিকার পাওয়ার অধিকারী।
নারীবাদ মানে উগ্রতা, ওপেন প্লেসে সিগারেট খাওয়া কিংবা যার তার সাথে যৌনতা শেয়ার করা, মদ্যপান- এ সমস্ত সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা দিয়ে দয়া করে নারীবাদকে সংজ্ঞায়িত করবেন না। নারীবাদ আন্দোলনের সূচনা কেন হয়েছিল সেটি সম্পর্কে জানুন, বুঝুন। নারীবাদ মানে পুরুষ-বিদ্বেষ নয়। নারীবাদ মানে পুরুষকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া নয়। বরং নারীবাদ মানে হল পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে চলা। নারী পুরুষ নির্বিশেষে একতার মাধ্যমে সকল মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টি করাই হলো নারীবাদ। নারীবাদ মানেই স্বাভাবিকতা। নারীবাদ মানে সত্যিকার অর্থে মানুষের মতো করেই বাঁচা। তাহলে এই স্বাভাবিকতাকে গ্রহণ করতে এই সমাজের আপত্তি কোথায়?
মস্তিষ্কের আবর্জনা ঝেড়ে ফেলে একটি সাধারণ বিষয়ের বাজে অর্থ বের করে অবৈধ সুবিধা নেওয়া বন্ধ করুন না, প্লিজ! এতে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]