শেষ বিকেলের জীবন
আলীয়া তামজিদা কান্তি।। মুর্হুতগুলো কাটছিল সীমাহীন আনন্দে। একের পর এক করে গাজীপুরের বেশ কয়েকটা দর্শনীয় জায়গা ঘুরে শেষটায় গেলাম বয়স্ক ও শিশু পুর্ণবাসন কেন্দ্র (বশিপুক) দেখতে। কোথায় যাচ্ছিলাম জানলেও ঠিক যেন বুঝতে পারিনি তখনো। সদ্য উপভোগ করা আনন্দের রেশ ধরেই বেশ উৎফুল্ল মনে ঢুকলাম বশিপুকের এলাকায়। চারিদিকের ছিমছাম পরিবেশের শান্ত ভাব মনকে যেন নিয়ে চলল কোন ধারায়। মন যেন ভাবতে শুরু করল কোথায় যাচ্ছি, কাদের দেখতে যাচ্ছি। ভাবনার গন্ডী পেরিয়ে মন যেন উপলব্ধি করল শেষ বিকেলের আলোয় এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, সেইসব মানুষ যারা জীবনের বাঁকে বাঁকে ভাল-মন্দ বিভিন্ন অবস্থা পেরিয়ে জীবনের শেষ সময়ে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে সহায়হীন অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছে বশিপুকে। দেখলাম নির্মম মা-বাবার ফেলে যাওয়া অসহায় শিশুদের। দেখা হলো ও কথা হলো অনেক প্রবীণের সাথে। জানতে পারলাম তাদের জীবনের অনেক কথা বশিপুকের বিচিত্রা থেকে।
জানলাম জনাব আসাদুজ্জামানের কথা যিনি জীবনের যা কিছু কামাই করেছেন তাই দিয়ে মানুষ করেছেন তার দুই ছেলে আর এক মেয়েকে। বড় ছেলে মানুষ হয়েছেন কিনা জানিনা তবে তিনি ম্যাজিষ্ট্রেট হয়েছেন। আসাদুজ্জামান সাহেবের ভাষ্যে বড় ছেলের চেয়ে বড় ম্যাজিষ্ট্রেট তার বৌ যার উপস্থিতিতে ছেলের বাড়িতে সম্বলহীন বুড়ো বাপের আশ্রয় জোটেনি।
জানতে পেরেছি জনাব মুস্তফার গল্প যিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ২০টি বছর কাটিয়ে সব উপার্জন ব্যয় করেছেন পরিবারের সামাজিক মর্যাদা আর আয়েশের জন্যে, অথচ বৃদ্ধ বয়সে মর্যাদা পান না নিজ ছেলে মেয়ের কাছে।
শুনলাম রোকেয়া বেগমের কাহিনী যার স্বামীর কষ্টার্জিত পয়সার তাদের একমাত্র ছেলে ডাক্তার হয়। তারপর ছেলে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে বাবা-মার খোঁজ নেবার প্রয়োজন বোধ করে না। ডাক্তার ছেলের রোগে জর্জরিত বাবা এক পর্যায়ে মারা গেলে আশ্রয়হীন রোকেয়া বেগম বিভিন্ন স্বজনের বাসায় ঘুরে শেষটায় আশ্রয় নেয় বশিপুকে।
অবাক হয়ে শুনি অনীল রায়ের কথা যার পর পর দুটো দুর্ঘটনায় পা ও হাত ভেঙ্গে যাওয়ায় পঙ্গুত্বকে সামাল দিতে ব্যয় হয়ে যায় সব সঞ্চয়। তার এই দুঃসময়ে সন্তানেরা এমনকি তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে যায়। উপায়হীন অনীল রায় আশ্রয় নেয় বশিপুকে।
বিস্ময়ে হতবাক হই এক সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধার কথায়। ছেলে-মেয়ে কজন জানতে চাইলে তিনি দুহাত নেড়ে নেড়ে বললেন, “না নেই”। অথচ তার দৃষ্টিতে ছিল বুকভরা অভিমানের প্রতিফলন। পরে অন্যের কাছে জানলাম, মহিলার একটি নয়, দুটি নয়, ছয় ছয়টি ছেলে-মেয়ে আছে। শুধু বিদেশ বিভূঁইয়ে নয়, এদেশের মাটিতে অত্যন্ত ভাল সামাজিক অবস্থানে আছে তার তিন তিনটে ছেলে।
এতসব দেখে-শুনে এই অসহায় প্রবীণদের করুণা করার স্পর্ধা আমার হয়নি বরং আমি করুণা করেছি ঐ সমস্ত দায়িত্ব-জ্ঞানহীন ছেলে-মেয়েদের বোধশক্তিকে যার ফলশ্রুতিতে বৃদ্ধ বাবা মা ওল্ড এইজ হোমকে নিজ স্বজনদের বাড়ির থেকে নিরাপদ ভাবতে শেখে। অথচ ঐ সন্তানেরা ভেবে দেখে না যে, নবীন প্রজন্মও একদিন প্রবীণ হবে। তাদের নিজেদের স্থাপিত দৃষ্টান্তই অনুসরণ করবে পরবর্তী প্রজন্ম। আফসোস হচ্ছে ক্রমশ ভেঙ্গে পড়া যৌথ পরিবারের ঐতিহ্যের কথা ভেবে। আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোর মত প্রবীণদের জন্য যথেষ্ট ওল্ড এইজ হোম, হসপিটাল আর রিক্রিয়েশন সেন্টারের মত সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আমাদের যা আছে তা হচ্ছে সুন্দর পরিবার ব্যবস্থা যেখানে অবসর জীবনে অধিকাংশ মানুষ খাওয়া-পড়া, চিকিৎসার সাথে পায় সম্মান আর সঙ্গ। অথচ বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে সংঘাতময় জীবনযুদ্ধে ভীষন চাপের মুখে পড়েছে যৌথ পরিবার। ফলে প্রবীণদের জীবন যাপন নিয়ে দেখা দিয়ে তীব্র আশংকা। আধুনিক নগরজীবনে একক পরিবারে রোজগারহীন বুড়ো মানুষের যেমনি জায়গা হচ্ছে না তেমনি গ্রামের প্রবীনদের অবস্থা আরও করুণ। এককালের রোজগেরে চাষী জমির আলী (৬৫) শেষ বয়সে জমি জমা ছেলেদের ভাগ করে দিয়ে ছেলেদেরই গলা-ধাক্কা খেয়ে জীবন কাটাচ্ছে ভিক্ষা করে। কি হবে প্রবীণদের অবস্থা ভেবেই আতঙ্কিত হই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭.৫ ভাগই প্রবীণ যা ২০৫০ সাল নাগাদ ২০% বেড়ে যাবে; সংখ্যায় দাঁড়াবে ৪০ মিলিয়নের উপরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মতেও, আগামী দশকগুলোতে বিশ্বে অন্যের উপর নির্ভরশীল বয়স্ক লোকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তখন শহর-গ্রামের শত সহস্র প্রবীণ মানুষ?
বাংলাদেশে ওল্ড এইজ হোমের মতো সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। সেক্ষেত্রে প্রবীণদের আসন্ন কঠিন সময়কে সামাল দিতে আমাদেরই দায়িত্ব যৌথ পরিবারের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা। উন্নত দেশে প্রবীণদের খাওয়া-পড়া চিকিৎসার কষ্ট না থাকলেও সামাজিক বন্ধনের অভাবে ওল্ড এইজ হোমে বুকভরা মানসিক কষ্ট নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন কাটায় ছেলে-মেয়ের সান্নিধ্যহীন বুড়ো-বুড়ী। আর আমাদের দেশে মানসিক কষ্ট বাদই দিলাম এত প্রবীণের মৌলিক চাহিদা মেটানোর মত প্রতুল সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নেই। তাই গরীব-ধনী সব প্রবীণদের নিশ্চিত জীবন সম্পর্কে আরও অনেক বেশি ভাবতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও জনগণকে। সমাজে বৃদ্ধদের অবস্থা, অধিকার ও প্রাপ্য সম্মান সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বাসে, রেলে টিকিটের সারিতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ প্রবীণদের এবং তাদের জন্য জিনিসের দামে (যেমন ওষুধে) ছাড় দেয়া দরকার। বয়স্ক ভাতা যথেষ্ট হওয়া দরকার। যৌথ পরিবারকে বাঁচাবার দায়িত্ব নিতে হবে গোটা সমাজকে। কারণ বশিপুকের প্রবীণদের দেখে এলাম যারা সময়মত ভাল খাওয়া-পরা, বিনোদন, চিকিৎসা সবই পাচ্ছেন। কিন্তু এখনো তাদের মনে পড়ে, নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে প্রিয় খাবার তুলে দেয়ার কথা। এখনো মনে পড়ে রোগে শোকে, বিপদে আপদে সন্তানকে আগলে রাখার কথা। আর তারই সাথে মনে পড়ে অকৃতজ্ঞ সন্তানের নির্মম ব্যবহারে একবুক কষ্ট নিয়ে ওল্ডহোমে আশ্রয় নেবার কথা। এভাবে সুখ-দুঃখ ক্রোধ অভিমানের স্মৃতি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় কাটে ওল্ডহোমের প্রবীণদের জীবন-দিবসের শেষ বিকেলের সময়।