April 30, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পাত্রী দেখার নামে অপমান আর কতদিন?

তৌকির ইসলাম।। শীতের হিমেল হাওয়াতে যখন কম্বল গায়ে নিবো নিবো করছি তখন মনে হল শীতের সময় হচ্ছে আমাদের বাঙালিদের বিয়ের অনুষ্ঠানের সময়। সারা বছর জুড়ে যা বিয়ে না হয় শীতে অনেক বেশি হয়। আর বিয়ে মানেই পাত্র-পাত্রী দেখা।

আমার কাছে মনে হয় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে পাত্রী দেখার নাম করে নারীকে চরম আকারের অপমান করা হয়। এখন বলতেই পারেন তাহলে কি আমরা পাত্রী দেখব না! অবশ্যই দেখব। কিন্তু যে পাত্রী আপনার চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে এলো তাকে কেন আবার হাঁটতে বলা তা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক আজও বুঝতে পারে না।

পাত্রপক্ষ আসা নিয়ে আমাদের সমাজে একজন মেয়ের বাড়িকে যে প্রস্তুতি নিতে হয় তা ছোটখাটো একটা যজ্ঞ বলা যেতে পারে। বিশ পদের নাস্তা করিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে পাত্রীকে পুতুল সাজিয়ে আনা হয়। আর এই আনার পর থেকেই শুরু হয় অসম্মানের এক একটি ধাপ। একজন নারীকে সামাজিকতার নাম করে পরিবারের সম্মতিতে এভাবে অসম্মান করার আর কোনো পদ্ধতি আমি দেখি নি।

পাত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয় সে কোন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, তা সে পাত্র এইট পাশ হোক! পাত্রীকে বলা হয় নিজের নাম ঠিকানা লিখে দেখাও, একটু হেঁটে দেখাও, পায়ের জুতা খুলে দাঁড়িয়ে দেখাও, চুলগুলো দেখাও, নামাজ পড় কিনা, কয়টি সূরা মুখস্থ, পূজা কর কিনা, রান্না করতে পারো কিনা, কোন রান্না ভালো পারো ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে কোন সূরা, কোন মন্ত্র কিংবা কোন মনিষীর নাম জিজ্ঞাসা করে বসেন। শাড়ি পরা অবস্থায় দেখার পরে আমরা পাত্রীকে সালওয়ার কামিজে দেখতে চাই, পাত্রপক্ষের এমন আবদারের কথাও আমি শুনেছি। একজন মানুষ হিসেবে চিন্তা করুন তো ঘর ভর্তি এতগুলো অচেনা লোকের সামনে একজন মানুষের জন্য কতখানি মানসিক শাস্তি এটা! নার্ভাসনেস থেকেও একজন মানুষের এই মুহূর্তে কিছুটা ভুল হওয়াটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগে। কিন্তু পাত্রপক্ষ হয়তো সেই ইস্যুতেই পাত্রীকে রিজেক্ট করবে আর পাত্রীপক্ষ মেয়েকে দুষবেন।

হয়তো আপনি বলতে পারেন এখন আর এমনটা হয় না, এসব কেউ জিজ্ঞাসা করে না। আমি আপনাকে বলব একটু শহরের বাইরে তাকান। পাত্রী দেখার নাম করে যে মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে একজন নারী তা সহজে দেখতে পাবেন। পাত্রীকে যেভাবে দেখা হয় ঠিক ঐভাবে আমাদের সমাজে কি একজন ছেলেকে পাত্র হিসেবে দেখা হয়? মোটেও না।

আমাদের সমাজে পাত্রের আয় উপার্জন ছাড়া অশিকাংশ মানুষ আর কিছুই দেখতে চায় না। যেসব কারণে পাত্রীপক্ষকে রিজেক্ট করা হয় সেই একই কারণে পাত্রপক্ষ রিজেক্ট হয়েছে এমন শোনার সৌভাগ্য এখনো আমার হয় নি। পাত্র লম্বা-খাটো-সাদা-কালো কিছু বলার অধিকার এই সমাজ মেয়েকে দেয় নি। বাবা মা মনেই করেন যে তাদের মেয়ে তার জামাইয়ের টাকায় গড়াগড়ি খেয়ে সুখেই আছে। এমনটা হয় না। হয়তো আপনার মেয়ের কোনদিন তার হাজব্যান্ডের কোন কিছুই পছন্দ হয় নি কিন্তু আপনার কারণে সে বলতেই পারে নি। আর না হয় বললে আপনি বলেছেন যে তুই অনেক সুখে থাকবি। আসলে বিয়ে ব্যাপারটা একা সুখে থাকার জিনিস নয়, একা দুঃখে থাকার জিনিস নয়। বিয়ে হল দুইজন মানুষের সুখ-দুখের ব্যাপার।

মানুষ হিসেবে একজন পাত্র বা পাত্রীকে যাচাই করা অনেক বেশি জরুরি। তাকে সম্মান করা জরুরি। হাঁটা চলা, চেহারা সুন্দর কিনা এসব দেখে নারীকে মানুষ হিসেবে অসম্মান করা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না। আর নারী বলেই তাকে এভাবে পাত্রী দেখার নাম করে অসম্মান করা হয়। নারী বলেই তাকে এরকম একটা মানসিক শাস্তি দেওয়া হয়। যদি বলেন যে বিয়ের ব্যাপার তাই দেখতে হচ্ছে, তাহলে পাত্রেরটাও দেখুন। পাত্রকেও বলুন যে- বাবা পায়ের জুতা খুলে আমার মেয়ের পাশে দাঁড়াও, দেখি তুমি কতটুকু লম্বা কিংবা একটু লিখে দেখাও তো। তাহলে হয়তো সমাজের তথাকথিত  পাত্র-পাত্রী দেখায় একটা ব্যালেন্স আসবে। পাত্রীর বাসার নাস্তার পরিমাণ যদি পাত্রের আয় উপার্জনের সমানুপাতিক হয় তাহলে উভয়ের সুখ ব্যাস্তানুপাতিক হওয়া অবশ্যম্ভাবী!

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]