সন্তান হয় শুধু ছেলেরা, মেয়েরা না!
ফারজানা নীলা।। নারী হয়ে জন্ম নেওয়া কষ্টের, এই বোধটা জীবনে কোনো না কোনও দিন আসে যদি কেউ নিজেকে নারী মনে করার আগে মানুষ ভাবে। হ্যাঁ যদি কেউ “মেয়ে হয়ে জন্মাইছি, এসব তো স্বাভাবিক” ব্যাপার বলে মেনে নেয় তাহলে হিসেব অন্য।
এই অন্য হিসেব করার মানসিকতা ছিল না আমার। নিজেকে নারী বলে পিছিয়ে রাখা বা মেয়েদের এসব সহ্য করতে হয়, মানতে হয় এমন বোধ কখন ছিল না। এই বোধের সাথে আমাকে আমার পরিবারই পরিচয় করিয়ে দেয় নি। সেক্ষেত্রে আমি চমৎকার পরিবারের অংশ বলে নিজেকে ভাবতে পারি।
ভাবতামও তাই। আমাকে শিখিয়েছে আমাকে পড়তে হবে, শিক্ষিত হতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, নিজে আয় করতে হবে। আমার কাজ শুধু বিয়ে সংসার হাড়ি ঠেলা নয়। আমি শিখেছি তাই। আমার নিজের আলাদা একটা পরিচয় থাকতে হবে, এই বোধ খুব ছোট বেলা থেকেই আমার ভেতরে গেঁথে গিয়েছিল।
আমাদের তিন ভাই বোনের সংসারে ভাই ছিল বড়। ভাই বোনদের মধ্যে কোনো তফাত করতে দেখি নি কখনও।
একটা গর্ব ছিল এই নিয়ে মনে মনে। এই গর্বটা একদিন হুট করে ভেঙ্গে যায় যখন আমাদের বাবাকে বলতে শুনি, “আমার তো একটাই সন্তান”
এ কী করে সম্ভব? আরো যে দুইটি মেয়ে আছে তারা কি সন্তান না?
আমি কান পেতে আরো স্পষ্ট শুনতে চাই। শুনতে পাই যা শুনেছি ঠিকই শুনেছি। পারিবারিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে একটি কাজ করার জন্য সাময়িকভাবে ভাইকে বাসা ছাড়া করা হয়েছিল। বাসায় তখন কান্নাকাটির রোল।
যদিও তখন সেটা সাময়িক মনে হয় নি। মনে হয়েছে “আহা আজীবন কি এমনই থাকবে!”
সেই সাময়িক বরখাস্তের সময় আমার বাবা উচ্চারণ করে ফেলে “আমার একটা মাত্র সন্তান, আর সে আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করল!”
বার বার শুনে, বার বার বোঝার চেষ্টা করে যেটা বুঝলাম, তিনি ছেলেকেই সন্তান মনে করেন। ছেলেকেই পরিবারের স্তম্ভ মনে করেন। ছেলেকে বংশের বাতি মনে করেন। ছেলেকে পরিবারের সম্বল মনে করেন। ছেলেই সন্তান হয়। কারণ মেয়ে তো পর! মেয়ে তো অন্যের ঘরে চলে যাবে! মেয়ে তো বুড়ো বয়সের আশ্রয় হবে না!
আমি বোকার মত মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, সন্তান একজন মানে কী? আমি কে তাহলে?
মা তখন আমার কথায় বিরক্ত হয়। বুঝাতে চাইলেন এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময় না।
আমি জানি না কেন সেদিন আমার বুক ভেঙে কান্না এসেছিল। আমাকে সন্তান মনে না করার কারণে, নাকি এমন কথা আমি কোনোদিন আমার বাবা মার কাছে শুনব; আশা না করার কারণে?
নিজেকে সেই প্রথম তুচ্ছ মনে হয়েছিল। সেই প্রথম অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। সেই প্রথম মনে হয়েছিল “শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে সন্তানই হতে পারলাম না! মেয়েরা সন্তান হয় না। সন্তান হয় শুধু ছেলেরা। মেয়েরা সান্ত্বনা পুরষ্কার। মেয়েরা বাড়তি, অতিরিক্ত, না হলেও হয় এমন।
সেদিন জীবনে শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার কারণে চরম লজ্জা আর অপমানিত বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিল আমি হাজার করলেও “সন্তান” হওয়ার মর্যাদা পাবো না। আমি যদি তথাকথিত ছেলে হওয়ার সব দায়িত্বও পালন করি, তবু আমার বাবা মার আক্ষেপ থাকবে। সে আক্ষেপ হয়ত আমি কোনোদিন দূর করতে পারব না।
এরপর সময় গড়ায়। সবকিছু আগের মত হয় আবার। পরিবার আবার পরিবারের মত হয়। আমার যা করার কথা, আমি তাই করি। নিজের পায়ে দাঁড়াই। পরিবারের প্রতি যা দায়িত্ব তা স্বেচ্ছায় এবং আনন্দের সাথেই করি।
অনেকে বলতে পারেন বা হয়ত আসলেই ব্যাপারটা এমন যে তখন আবেগের বশে বাবা এমন কথা বলে ফেলেছিল। আসলেই এমন কোনো মানে নেই। সত্যি তিনি সবাইকে তার সন্তান মানেন। ছেলে মেয়ে বলে কোনো বৈষম্য করেন না।
হয়ত এমনটাই ঠিক। কিন্তু আবেগের বশে হোক আর না হোক যে কথা একবার শ্রবণযোগ্য হয়েছে সে কথা তো কান মন মস্তিষ্ক ভুলে যেতে পারে না। সেদিন সে মুহূর্তে যে অপমান,কষ্ট, লজ্জা বোধ হয়েছিল সেও তো মিথ্যে হয়ে যাবে না।
যা হয়ে জন্ম নিয়েছি সেই অস্তিত্বের প্রতি লজ্জা পাওয়া, কষ্ট পাওয়ার বোধ কি নারী ছাড়া আর কেউ পায়?
কখনও কি কোনো ছেলেকে শুনতে হয় “সে ছেলে তাই সে আমার সন্তান না!” হয় না।
ভাবি যে পরিবারে কোনো ছেলে নেই, সেখানে না জানি বাবা মা’দের কত আক্ষেপ, কত কষ্ট ছেলে না থাকার জন্য। একজন সব দিক থেকেই সক্ষম মেয়েকেও শুনতে হয় “তুই আমার মেয়ে না, তুই আমার ছেলে!”
দায়িত্ব পালন করা মেয়েকে শুধুমাত্র সন্তানের মত সন্তান মনে না করে মনে করা হয় “ছেলের মত সন্তান।”
এই কথা শুনলে মেয়েরা কি খুব খুশি হয় বলে মনে করেন?
না বরং নিজেদের কারো প্রক্সি মনে হয়। এই প্রক্সি মনে করা, অন্য কারো সাথে তুলনা করা কখনো কি বন্ধ হবে?
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]