November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

রেনুর গল্প- মেয়ে হয়ে জন্মেছিল বলেই…

শাহরিয়া দিনা।। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের বিষয়ভিত্তিক আয়োজনে শুধুমাত্র নারী বলে আমার সাথে ঘটেছে এমন একটি ঘটনার কথা আমি লিখবো বলে চিন্তা করছিলাম। চিন্তা করতেই মনে হল, আমি যা মোকাবিলা করেছি সেটা তো বেঁচে থাকলে যেকোনো সময় লিখতেই পারবো। আজ বরং এমন একজনের কথা লিখি যে বেঁচেও মরে আছে এবং কখনোই লিখতে পারবেনা তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা।

ঘটনাকাল ৯০ দশকের একদম শেষদিক। মেয়েটার নাম রেনু। গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। আমার থেকে বয়সে ছোট। রেনু যখন ক্লাস সেভেন/এইটের ছাত্রী তখন সে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যায় বিয়ের দাওয়াতে। গ্রামের বিয়ে তাই সেজেগুজে গেলাম খেয়ে আসলাম ব্যাপারটা এমন না, বিয়ের দুই/তিন দিন আগে থেকে আত্মীয়স্বজন আসা শুরু হয়। গানবাজনা, গল্প-গুজব চলে। তো রেনুরা বিয়ে খেয়ে আসার পর থেকেই শুনলাম রেনুকে জ্বীনে ধরেছে। পাগলামি করছে।

জ্বীন-ভূত কাহিনী আগেও শুনেছি এমন জ্বীনে ধরা মেয়েদের লক্ষণ দেখে পত্রিকায় পড়া হিস্টেরিয়া রোগের লক্ষণের সাথে মিল পেয়েছি। যাই হোক, তাকে দেখতে গেলাম। কখনো হাসছে, কখনো কাঁদছে, কান্নার ফাঁকে ‘মামা আমারে ছাইড়া দেন, আপনার পায়ে ধরছি’ বলতেছে। লোকজন ভাবে সে জ্বীনকে বলছে, আর আমি ভাবি সে রেইপ হইছে। ছোট মানুষ তাই ট্রমার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন কলেজে পড়ি তবে অত বড় না যে আমার কথা গুরুত্ব পাবে। নিজের মা’কে বললাম সন্দেহের কথা। গার্জিয়ান লেভেলে আলাপ করে তার বাবা-মা’কে ডাক্তার দেখাতে বলানোর ব্যবস্থা করলাম।

তবে তারা ভাবে এইসব ডাক্তারের বিষয় না, কবিরাজ দরকার। বলে রাখি তারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার এবং শিক্ষার দিক থেকেও পিছিয়ে। যথারীতি কবিরাজ আনা হল। সে আরেক তেলেসমাতি! রাতের বেলায় মুর্শেদী গান গেয়ে ডাকা হয় জ্বীন, জ্বীন আসে। মেয়েটাকে শুকনা মরিচ পুড়িয়ে তার মধ্যে নিঃশ্বাস নিতে মাথা চেপে ধরে বাধ্য করা হয়। আরও কি কি সব! তার চিৎকার, আকুতি বাবা-মা’র খারাপ লাগলেও কবিরাজের নির্দেশে তারা ঘরের বাইরেই থাকলো। কবিরাজ আর তার সহকারি শুধু রইল ঘরে। শেষ রাতে নাকি প্রচন্ড দুর্বল তাকে ধরাধরি করে নিয়ে গোসল দেয়া হল তিন রাস্তার মোড়ে বটগাছের নিচে।

সকালে শারীরিকভাবে ভীষণ ক্লান্ত, মরার মতো পরে আছে রেনু। এরপর থেকে সে চুপচাপ কিছুটা। হতে পারে সেটা মানসিক বিপর্যয়ের সাথে নতুন করে যোগ হওয়া এই শারীরিক দুর্বলতার জন্য। কয়েকদিন বাদে শুরু হয় নতুন লক্ষণ। এবার সে অ্যাগ্রেসিভ। হাতের কাছে যা পায় ভাংচুর করে, কেউ ধরতে আসলে চ্যাচামেচি করে, কামড় দেয়। কোন উপায় না পেয়ে ঢাকায় আনা হল ডাক্তারের কাছে। কিছু ঔষধপত্র দেয়া হল আর দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা লাগবে ডাক্তার জানিয়ে দিল। বাড়ি ফিরে কয়েকদিন ঔষধ নেবার পর মোটামুটি শান্ত। এখন মানুষজন চিনতে পারে। তবে গুছিয়ে কোনো কথা বলতে পারেনা।

একদিন রেনু নিখোঁজ হল। সন্ধ্যা নামে, গৃহস্থালির গরু-ছাগল, হাস-মুরগী ঘরে ফেরে, রেনুর মা দেখে শুধুই রেনুই ঘরে নেই আজকে। খোঁজ চলল আশেপাশের কয়েক বাড়ি, টর্চের আলোতে ঝোপঝাড় জঙ্গলও খোঁজা হল। নেই তো নেই, কোথাও নেই। ৫/৬ দিন পর অন্য কোন গ্রামে বাজারের পাশে দেখা গেছে জানা গেল। বাবা-ভাই গিয়ে নিয়ে আসল। এরপর যখন সবাই ব্যস্ত থাকতো তখন রেনুকে  মাঝেমধ্যেই শেকল পরিয়ে রাখা হতো।

গ্রামের দুই/একজন মহিলা রেনুর মা’কে বলে, রেনুর পেট বড় হয়ে যাচ্ছে কেন? হঠাৎ কী ভেবে তারা পেটে হাত দিয়ে দেখে যা ভাবছে তাই। পেটে বাচ্চা! তড়িঘড়ি করে শহরে ডাক্তারের কাছে নেয়া হল। আলট্রাসনোগ্রাফিতে জানা হল সাত মাস বয়সের ছেলে বাচ্চা বেড়ে উঠেছে রেনুর জরায়ুতে। এরপর কীভাবে কী হল জানিনা। শুধু জানলাম সিজারিয়ান অপারেশনে মরা বাচ্চা হইছে এবং সেই সাথে  অপারেশনের মাধ্যমে তার মা হবার পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পরিবারের সিদ্বান্তে।

রেনু এখনও বেঁচে আছে। অনেকদিন পর দেখা হলে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে চিনেছো? চুপচাপ একটা লাজুক হাসি দিয়ে মাথায় ওড়না টেনে দেয়। আমার মেয়েকে দেখিয়ে আঙুল তাক করে বলে, তোমার? বলি, হ্যাঁ। রেনু হাসে। এখন অনেক শান্ত, বাড়ি ছেড়ে পালায় না, মারধোর করেনা। তবে ঠিকঠাক গুছিয়ে কথা বলতে পারেনা। ওর জগৎ অস্পষ্ট। এ এমন এক জীবন না আছে স্মৃতি, না আছে স্বপ্ন। শুধুই বেঁচে আছে।

শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর ফলাফলেই রেনু পেল এমন এক জীবন। যে জীবন কখনোই কারো কাম্য না।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]