November 21, 2024
কলামফিচার ২

ডিভোর্সের পর নারী: যুদ্ধের হরেক রং

ক্যামেলিয়া আলম।। মেরি ওলস্টোনক্রাফটকে চিনি নিশ্চয়ই। মেরির জীবদ্দশা নিয়ে হয়তো জানেন, তবু বলি। সাত ভাই বোনের মাঝে দ্বিতীয় সন্তান মেরির প্রথম সংঘাতই শুরু হয় নিজ পরিবার থেকে। মদ্যপানে আসক্ত বাবার প্রতিদিনের মাকে পিটানো আর মায়ের পুরুষতান্ত্রিক রোল মডেলে চলাকে মেরি সমর্থন করতে পারেননি। বাড়ি ছাড়েন তাই। বাড়ি ছাড়ার দুই বছরের মাথায় মা মারা গেলে ভাই বোনদের কথা ভেবে ফিরে আসেন। প্রিয় বোনটিকে স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখালেও বোনটি বিয়ে করে যখন ঘর বাধে, মেরি সানন্দে মেনে শহরে ফিরে আসেন। জেন আর্ডেনের সাথে পরিচয় তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে নিয়ে আসে। এক স্কুলে চাকরি নিয়ে কোন রকমে লেখালেখি চালাতে চালাতে বোনটির অসুস্থতায় তার কাজ ছেড়ে বোনের কাছে চলে আসতে হয়। প্রচন্ড সেবাযত্নও বোনটিকে বাঁচাতে পারে না।

ভেঙে পড়া মন নিয়ে মেরি আয়ারল্যান্ডে গিয়ে গভর্নেসের কাজ নেন। তখন মেরি বেশ কিছু শিশু সাহিত্য রচনা করেন। কিন্তু বেশিদিন সেখানে কাজ আর করেননা। ফিরে আসেন লন্ডনে, দেখা করেন যোশেফ জনসনের সাথে। এক প্রকাশনা সংস্থায় ফ্রেঞ্চ, জার্মান ভাষার অনুবাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এডমন্ড বার্কের ফ্রেঞ্চ রেভুলেশন নিয়ে তার অবস্থানকে কটাক্ষ করে, মেল শভেনিস্ট জায়গাকে চ্যালেঞ্জ করে বের হয় মেরির বিখ্যাত বই The Vindiction of the Rights of Men, বিশেষ করে বইটির ২য় এডিশনে সরাসরি আক্রমণ করে মেরি সব মহলে তার অবস্থানকে জোরালো করেন। এর দুই বছর পর ১৭৯২ সালে মেরি বের করে আ ভিন্ডিকেশন অফ দা রাইটস অফ ওমেন। যেখানে নারী পুরুষের অসমতার রাজনৈতিক ও নৈতিক অবস্থানকে নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

এর মাঝে হেনরি ফুসেলে নামের এক বিবাহিত পুরুষের সাথে প্রেমে জড়িয়ে মেরি তাকে প্লেটোনিক লিভিং এর প্রপোজাল দিলে স্বয়ং সেই লোকের বউসহ মেরির চারপাশে সমালোচনার মাঝে পড়ে যান মেরি। সম্পর্ক বিচ্ছেদ আর সামাজিক তিক্ততার মুখোমুখি হয়ে মেরি দেশ ছাড়েন। ফ্রান্সে এসে প্রেমে পড়েন গিলবার্ট ইমলের। প্রায় তিন বছরের বিয়ে বহির্ভূত যুগল জীবন সেই সমাজে ছিল এক নিষিদ্ধ সম্পর্কের মতো। মেরির ভিন্ডিকেশন অফ দা রাইটস অফ ওমেন বই নিয়ে নারী জগতে মেরি তখন রীতিমতো বেশ্যা, ডাইনি উপাধি পাওয়া নারী। এদিকে তখন ফ্রান্সের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। রাজতন্ত্র আর জনতার লড়াই তুঙ্গে। মেরির একের পর এক বন্ধুর গিলোটিনে জীবনাবসান মেরিকে মানসিক বিপর্যস্ততায় ফেলে দেয়। মেরির উপরেও যে কোন সময়ে খড়গ নামবে, ফলে ইমলের সহায়তায় আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে আমেরিকান জাতীয়তা গ্রহণ করে ফ্রান্স থেকে পালান। এর মাঝে মেরির প্রথম কন্যা জন্ম নেয়।

পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে পুনরায় তারা ফিরে আসেন ফ্রান্সে। কিছুদিন পরেই ব্যবসায়িক কাজের উদ্দেশ্যে অল্পদিনের জন্য ইমলে লন্ডনে থাকবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেন। এর মাঝে বিপ্লব আর যুদ্ধে ফ্রান্সের সাথে বাইরের সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলে তীব্র আর্থিক কষ্টে পড়ে যান মেরি সন্তান নিয়ে। ইমলেকে খুঁজতে লন্ডনে পাড়ি দিয়ে দেখেন ব্যবসায়ী ইমলে অন্য নারীর পাশে। এক সুইসাইড নোট লিখে মেরি টেমস নদীতে ঝাঁপ দেন। নদীতে থাকা এক ব্যক্তি দেখে রেসকিউ করে। বেঁচে যান মেরি। ফিরে আসেন ব্যর্থ আর হতাশ মন নিয়ে ফ্রান্সে। একদিকে আর্থিক কষ্ট, অন্যদিকে সমাজের চোখে বেশ্যা হিসেবে বিবাহ বহির্ভূত সন্তান নিয়ে মেরির এক ভয়ানক জীবন যুদ্ধ শুরু হয়। এমনই এক সময় দেখা হয় গডউইনের সাথে, যার সাথে বছর খানেক আগেও একবার দেখা হয়েছিল মেরির। সেদিন সোশ্যাল স্ট্রাকচার নিয়ে প্রেম, মায়া ভালোবাসায় বিশ্বাসী মেরির বিবাদ তৈরি হয়েছিল গডউইনের সাথে। এবারের দেখায় তাদের সেই দার্শনিক আলোচনা ভিন্নদিকে মোড় নেয়, প্রেমে পড়েন একে অপরের। যদিও মেরি বা গডউইন প্রচলিত প্রথা বা রীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না, তবু সামাজিক রীতির কারণে ও নাগরিক কিছু আইনের কারণে বিয়ে করেন। মেরিকে বিয়ের জন্য গডউইনকেও সামাজিকভাবে প্রচন্ড ধিকৃত হতে হয়েছিলেন যে, বিবাহ বহির্ভূত বাচ্চা জন্মদানকারী একজন মন্দ মেয়েকে বিয়ে করছে। মাত্র তিন বছরের সংসার জীবন শেষে মেরির মৃত্যু হয় ২য় সন্তান শেলী মেরি গডউইনের জন্ম হবার ১১ দিন পরে, শেলী, যিনি প্রথম সায়েন্স ফিকশন ফ্রাংকেনস্টাইনের রচয়িতা।

মেরির গল্প বলার উদ্দেশ্য ছিল, সমাজের বাস্তবতা আর তার সাথে একজন নারীর লড়াই করে টিকে থাকার বিষয়টুকুর জন্য। একজন মানুষ যিনি আজীবন প্রেম, মমতা, ভালোবাসাকে চেয়েছেন জীবনে, চেয়েছেন নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথকে ধরে রাখতে। তাকে একটা সমাজ অসহযোগিতাই করেনি, সুযোগ পেয়ে প্রতারিত করেছে, দূর্যোগ দুর্বিপাকে ফেলেছে। দুইটি প্রেমের সময়েই তার লেখালেখি ছিল সবচেয়ে কম, এছাড়া সারা জীবন জুড়েই, বিশেষ করে গডউইনের পাশে তার লেখালেখি, বিকশিত জীবন কিন্তু থেমে থাকেনি। এই দশকে একজন নারীর কি এর চেয়ে ভালো অবস্থানে আসার কথা ছিল না? কিন্তু মেরির জীবন এখনও কোন নারীর জন্য এই সমাজ ভাবতে পারে? বা নারীই নিজেই এখনও ভাবতে পারে?

এদেশের নারীর বোধ চিতায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে স্বর্গে যাওয়ার চিন্তায়, তাদের কী করে এক প্রোগ্রেসিভ জীবনে আর আনা যায়? আমি নিজেও দুর্বিপাকে পড়ে দেখেছি, গর্ত থেকে তুলতে হয় নিজেকেই টেনে। অন্যান্যরা হাত কেবল ধরতে পারে, যা ধরা সম্ভব গর্ত থেকে হাতটুকু আলোতে বেরুতে পারলেই!

ডিভোর্স দেয়া বা সিঙ্গেল হওয়া নারীর একেবারে প্রাথমিক কিছু সমস্যা আমি দেখেছি। প্রথম সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘর থেকেই শুরু হয়। স্বামী পাশে থাকা একজন নারীর চলাফেরা যতটা না সমাজ খেয়াল রাখে, স্বামী না থাকলে তার ঘরে কে আসে আর না আসে তা বেশি খেয়াল করে। একজন প্রথিতযশা নারী একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, ডিভোর্সের পর অ্যাপার্টমেন্টের দারোয়ানও খেয়াল রাখতো তার ঘরে কে কখন আসে। অথচ উনি তখন টেলিভিশন অভিনেত্রী। আর যেমন হয়েই থাক না কেন, তার পাশে যদি কোন পুরুষ বন্ধু জুটে যায়, তাহলে তো সমাজ বলবেই, এই নারীর চরিত্রের সমস্যার জন্যই একসাথে থাকতে পারলো না। অথচ একটা সংসার না পারতপক্ষে কেউই ভাঙতে চায় না। মাদকাসক্তি, দায়িত্বপালনে অপারগতা, শারীরিক অক্ষমতা বা ভালোবাসার অভাবেই একজন নারী সংসার ভাঙে। আর তা সম্ভব হয় নারীটি যদি যথেষ্ট আত্মসম্মানবোধের অধিকারী হয়।

একজন সিঙ্গেল নারীকে দেখবার মতোন বোধ আর চোখ এখনও এ সমাজের হয়নি। তারা আজীবন পরাশ্রয়ী হিসেবে নারীকে দেখে অভ্যস্ত। ফলে সিঙ্গেল হবার সাথে সাথেই তার সাথে ভিন্ন রকম আচরণ শুরু হয় প্রতিটি স্তরে। নারীটি যদি স্বাধীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়, তাতে আসে নানা বিধিনিষেধ। পরিবারের একজন সন্তানও মায়ের পাশে আর অন্য কোন মানুষকে সহজভাবে নিতে পারেনা। আসলে সেই বোধটুকুর চর্চা নেই বলেই সন্তানটি মায়ের স্বাভাবিক কোন জীবন যাপনকে সহজভাবে নিতে শেখে না। অনেক সময় সন্তানের কথা ভেবে নারীটি বয়ফ্রেন্ড দূরে থাক, বিয়ে পর্যন্ত করতে পারে না। সেই নারীটিই একসময় সন্তানের সংসারে অপ্রীতিকর আচরণ করেন। সন্তানের জন্য তার আজীবনের সন্ন্যাস জীবনের ত্যাগ তাকে সাইকো, বিকারগ্রস্ত, শারীরিক অসুস্থ একজন নারীতে পরিণত করে।

আরেকটা বিষয়ও দেখা যায়, ডিভোর্সের পর ব্লেইমিং। সংসার ভাঙবার জন্য গ্রহণযোগ্য বা অনেক যুক্তি না থাকলে সংসার কখনও ভাঙে না। স্বামীকে দিয়ে নির্যাতন জনসমক্ষে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা তখনই যখন তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে। তার শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। নতুবা দুর্বলের মতো সেই স্বামীকে নিয়ে পেছনে কথা বলে সময় নষ্ট করার গ্রহণযোগ্যতা কতটা? যতটুকু সময় প্রাক্তনের কথা বলে সময় নষ্ট করবে, সেই সময় যদি নিজেকে প্রগ্রেসিভ করার কাজে ব্যয় করে তা যথেষ্ট ইতিবাচক জীবন নিয়ে আসবে। মেরির ঘটনা বলার অর্থই আমার এজন্য। হ্যাঁ প্রবল প্রেমে পড়ে মেরিও আত্মহত্যা করতে চলে গিয়েছিল। কিন্তু মেরি তো কাউকে ব্লেইম দেয়নি। মেরির লেখায় ভ্যানিটি নারীর এক উদাহরণ আছে, যারা স্বামীর পাশে কড়া লিপস্টিক আর গহনার আবরণে পরাশ্রয়ী হয়ে কেবল ঘুরে বেড়ায়। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার চাইতে তারা অন্যের ঘরের খবর নিতে আগ্রহী। এই শ্রেণিই মেরির মতো নারীকে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ করেছে মেরির জীবদ্দশায়। তা এই যুগেও করবে সন্দেহ নাই। এরা প্রত্যেকেই পুরুষতন্ত্রের রোল মডেল। পুরুষের ছত্রছায়ায় থাকাকেই তারা জীবনালেখ্য বলে ভাবেন। তবে আরেক শ্রেণির নারীও আছেন, যারা ডিভোর্স হবার পরে স্বামীর বর্তমান স্ত্রী বা প্রেমিকাকে নিয়ে অতিমাত্রায় কনসাস থাকেন। তারা নিজেকে তূলণামূলক বিচারে ফেলে প্রতিনিয়তই ভাবতে থাকেন, স্বামী বা প্রেমিকার পাশে থাকা নারীটিকে নিয়ে স্বামী যদি সুখী থাকেন, তাহলে তার প্রতি কেন ছিল এতটা উদাসীন?

এই প্রশ্নের উত্তরে আমার বলতে ইচ্ছে হয়, প্রাক্তন কাউকে নিয়ে চিন্তাভাবনাই যদি কারো করতে হয়, তাহলে তার সামনে এগুনোর পথটা কোথায়? আর এর মধ্য দিয়ে নিজেকে দুর্বল আর অসহায় দেখিয়ে আত্মসম্মানহীন কি করছে না? একজন মর্যাদাশীল মানুষ কখনও বিলাপ করে না, বরং সে নিজেকে এগিয়ে নিতে পারে। নারীদের মাঝে ইকিউ (EQ) বেশি বলেই নারী পারেই নিজেকে গুছিয়ে নিতে। প্রয়োজন কেবল নিজেকে স্থির রাখা। এক গ্লাস পানি নিয়ে স্থিরতা দিয়ে চললেই পানিটি গ্লাস উপচে পড়ে যায় না। নিজের জীবনটাও তো তাই। স্থিরতা না এলে কী করে নিজেকে সঠিক পথে নেয়া সম্ভব? পুরুষটি আপনার প্রতি যথেষ্ট সহৃদয়বান না থাকাতে, হয়তো নির্যাতন করাতে বা দায়িত্বশীল না থাকার জন্যই তো সম্পর্ক আর রাখা সম্ভব হয়নি। তাহলে সেই মানুষটি কার সাথে কী করে চলছে, তা দেখে সময় নষ্ট করবেন? নিজেকে অসহায় হয়ে দেখানো বা প্রেমিক বা স্বামীর বর্তমান স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত আচরণ তো আরও হাস্যকর! আমাকে ভালোবাসতে অক্ষমতা দেখাবার অর্থ কি তা যে সে অন্য কারও প্রতি ভালোবাসাও দেখাতে পারবে না? এই চিন্তাধারাই তো আত্মসম্মানহীন এক কাজ।

আফসানা মিমি এদেশের একজন নামকরা নাট্যব্যক্তিত্ব। গাজী রাকায়েতের সাথে ডিভোর্সের মাসখানেক পরেও মহিলা সমিতিতে তাদের হেসে একে অপরের সাথে কথা বলতে দেখেছি। এমনকি গাজী রাকায়েতের কয়েক মাসের মাঝে বিয়ের কার্ডও মিমি আপাকে পাঠাতে দেখেছি। আজ মিমি আপার অবস্থানই বলে দিচ্ছে সে কতটা শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের পরিচয় ধারণ করে। শিল্পকলা একাডেমির নির্বাহী হিসেবে তার অবস্থান নিঃসন্দেহে আরও দশটা নারীকে একক থাকার, নোংরা সংসার নিয়ে পড়ে থাকার থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখাতে পারে। যা পারে না ডিভোর্সের পরে হায় হুতাশে ভুগতে থাকা নারীকে দেখে।

একজন নারীকে প্রতিদিনই যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধটা করা উচিৎ সবল ক্ষমতাবানের বিরুদ্ধেই। তাকে এক হাত না দেখাতে পেরে তার পাশে থাকা দুর্বল নারীকে ক্ষমতা দেখানো আধিপত্যেরই এক নোংরা খেলা, যা পুরুষতন্ত্রকেই রিপ্রেজেন্ট করে। একজন নারীর আত্মসম্মান ভীষন গুরুত্বপূর্ণ। তার ব্যক্তিত্বই কেবল পারে তাকে পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজের মনমতো জীবন যাপন করতে দিতে। একটা সময় পর্যন্ত বাধা দেয়া সমাজই একসময় শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের কাছে নতজানু হয়।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]