পুরুষতন্ত্রে পুরুষের প্রেম, অসহায়ত্ব এবং দখলদারিত্বের গল্প
সৈকত আমীন।। কয়েকদিন আগের কথা, ১৪ ডিসেম্বর, শীতকালের যেকোনো দিনের মতো আরেকটা দিন, সোমবার।
সেদিন বিকেলে একটা সংবাদ দেখে সমস্ত মনোযোগ কিছুক্ষণের জন্য আটকে গিয়েছিল মোবাইলের স্ক্রিনে। যার শিরোনাম ছিল “ স্ত্রী-সন্তানকে না পেয়ে আদালত প্রাঙ্গণে আত্মহত্যা”।
“প্রায় দুই বছর আগে বিয়ে হয়েছিল হাফিজুর রহমান ও বুশরা বেগমের। বিয়ের পর তাঁদের কোলজুড়ে এসেছে একটি পুত্র সন্তান। সম্প্রতি পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাফিজুর ও তার স্ত্রী বুশরার মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো। এরই জের ধরে কিছুদিন আগে বুশরা সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান। স্ত্রী ও সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে বারবার শ্বশুর বাড়ি গিয়েও ব্যর্থ হন হাফিজুর।
এক পর্যায়ে তিনি ১০০ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উদ্ধার মামলা করেন। মামলার প্রেক্ষিতে হবিগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ এ ধার্য তারিখে বুশরা জবানবন্দি দিলে আদালত বুশরাকে তার মা খুদেজা বেগমের জিম্মায় দেন। এরই ফলশ্রুতিতে ক্ষোভে-অভিমানে-অসহায়ত্বে হাফিজুর আদালত প্রাঙ্গণের নিমতলায় এসে ছুরি দিয়ে নিজ পেটে উপর্যুপরি আঘাত করেন। তাৎক্ষণিক উপস্থিত লোকজন উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।“
এই ঘটনা’কে আমরা চাইলে সরলভাবে ‘পাওয়া-না পাওয়া’ সংক্রান্ত একটা ট্রাজেডি বলতে পারি অথবা বলতে পারি ট্রাজেডিরই অন্য নাম অসহায়ত্ব আর নির্মমতার গল্প। কাঙ্ক্ষিত প্রেম না পেয়ে যেখানে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে প্রেমিক। এমন অনেক ঘটনাই ক্লাসিক্যাল প্রেমের গল্পে পড়েছি, শুনেছি বা প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। বারংবার আমাদের মায়া জন্মেছে নিহত মানুষটির প্রতি, নির্বিশেষে তাঁর সামাজিক লিঙ্গগত অবস্থান যাই হোক, এবং দিনশেষে মহিমান্বিত হয়েছে জীবন বিসর্জন দিয়ে উদাহরণ তৈরি করা অসহায় প্রেম। কিন্তু যদি বলি যেই অসহায়ত্বের কারণে যুগে যুগে একে অপরকে চেষ্টা করেও না পেয়ে নিজেদের জীবন দিয়ে গেছে এই গ্রহের প্রেমিক প্রেমিকারা, সেই অসহায়ত্ব আসলে প্রেমের কাছে নয়, সেই অসহায়ত্ব আসলে দখলদারিত্বের মানসিকতার কাছে, সেই অসহায়ত্ব আসলে পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে। এবং অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেওয়া মানুষের অনেকেই মোটেও প্রেমের শহীদ নয়, বরং তারা শিকার নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক অসহায়ত্বের।
কিন্তু সেটা কীভাবে?
যদি খুব সহজ করে বলি তবে পুরুষতান্ত্রিকতার অর্থ দাঁড়ায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’- এমন একটা সংস্কৃতি কিংবা মানসিক অবস্থান। এবং মোটা দাগে আমি আপনি আমরাসহ গত কয়েক হাজার বছরে এই বিশ্বের প্রায় সকলেই তেমন একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বিকাশ ঘটিয়েছি নিজেদের জীবনের। যেখানে আমরা জানি যা সহজে পাওয়া যাচ্ছে না কারো কাছ থেকে, নিজের তুলনায় কম শক্তিশালী কারো কাছ থেকে জোর করলে সেটাও পাওয়া প্রায় নিশ্চিত। এবং সেভাবেই অভ্যস্ত আমাদের যাপিত জীবনের সকল চিন্তা ভাবনা আচরণ ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয় যখন জোর করে পাওয়া যায়না এমন কোনো বিষয়ের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। যখন আমরা দেখি আমাদের দরকার এমন কিছু জোর করেও হাসিল করতে পারছি না। তখন শুরু হয় আমাদের মানসিক অসহায়ত্ব, আমরা বুঝতে পারিনা এখন আমাদের করণীয় কী! আমাদের সহজাত আচরণের স্বভাব তখন ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, আমাদের মাথা ঠিকঠাক কাজ করে না, আমাদের অভ্যস্ত চিন্তার ইতিহাস ভেঙে পড়ে। আমরা আরো অসহায় হয়ে পড়ি , জোর করে যা হাসিল করতে পারিনি- কখনো কখনো তৈরি হয়ে যায় তার প্রতি বিদ্বেষ। সে সব কিছুর প্রতি আমরা হয়ে উঠি আক্রমণাত্মক। আর যখন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে পাবার সম্ভাবনা আরো কমে, তখন আরো তীব্র অসহায়ত্বে হয়ে উঠি আমরা আত্মঘাতী। কিংবা এর মাঝামাঝি থেকে যাই বিষাদের মহাসাগরের তলে গভীর চাপ ও অন্ধকারে।
যেমন ধরুন হাফিজুরের কথা। তার স্ত্রী বুশরা, যাকে হয়তো তিনি সত্যিই ভালোবাসতেন। হয়তো ভালোবাসতেন পৃথিবীর যেকোনো মানুষ আরেকজন মানুষকে যতটা ভালো বাসতে পারে- তারচেয়েও বেশি। কিন্তু যখন যেকোনো কারণে বুশরা তাকে ছেড়ে চলে গেল, এবং তিনি বুশরাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্যর্থ হলেন কারণ বুশরার সম্মতি নেই ফিরে আসার। পরবর্তীতে হাফিজুর আশ্রয় নিলেন আইনের। এবং সেই আশ্রয় বুশরাকে আইনের দ্বারা তার কাছে ফিরে আসতে কনভিন্সড হবার জন্য নয়। বরং আইনের আশ্রয় নিয়েছিল সে বুশরাকে বুশরার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা সম্মতির বিরুদ্ধে আইনের মাধ্যমে জোরপূর্বক বাধ্য হয়ে হাফিজুরের কাছে ফিরে আসতে। যদিও বিচারে আইনের কাছে কাম্য আশ্রয় পায়নি হাফিজুর। এবং জোর যখন ব্যর্থ হয় তারপরের পরিনতি আপনারা ইতিমধ্যে জানেন।
পুরো আলোচনাটায় হাফিজুর বা বুশরা সংবাদের উদাহরণ না হয়ে রূপক কেউও হতে পারতো।
কিন্তু যে কথা বলার জন্য জীবনের অনেক অনেক অভিজ্ঞতাও নির্দ্বিধায় বলে ফেলা যেত, তা না বলে এই ঘটনাকে তুলে আনার অনেকগুলো কারণের মাঝে একটা হচ্ছে- এই সমাজে মহিমান্বিত হয় এমন ঘটনার মাঝেও লুকিয়ে রয়েছে কতটা অচেতন রূঢ় সত্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- একই ঘটনা যদি হাফিজুরের সাথে না ঘটে বুশরার ঘটতো তবুও আমি তাকে পুরুষতান্ত্রিকতার ভিকটিম বলতে প্রস্তুত ছিলাম কিনা? উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ। নির্দ্বিধায় সেও নিজের দখলদারিত্বের চিন্তার’ই শিকার হতো জোরপূর্বক কাউকে পাবার চেষ্টা করে। এবং পুরুষতন্ত্রকে এক কথায় যেহেতু বলা যাচ্ছে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন একটা মানসিক সংস্কৃতি সুতরাং নারী হবার পরেও বুশরার আচরণ’কে পুরুষতান্ত্রিক আচরণ না বলার কোনো কারণ অবশিষ্ট থাকতো না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে গায়ের জোরের এই সংস্কৃতি পুরুষেরই তৈরি, প্রথমে শারীরিক জোরে ও পরবর্তীতে সামাজিক অবস্থানের জোরে তারা টিকিয়ে রেখেছে পুরুষতন্ত্র। এই গ্রহের সিংহভাগ সমাজ পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজ, প্রায় সকল আইন’ই নির্মাণ হয়েছে পুরুষের চাহিদায়, প্রায় সকল মনোজাগতিক চিন্তার প্রভাবক হিসেবে কাজ করে প্রতিষ্ঠিত পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা, যার বলি পদে পদে সবচেয়ে বেশি হতে হয় নারী অথবা সামাজিক অবস্থানে পুরুষের চেয়ে কম শক্তিশালী যেকোনো লিঙ্গের মানুষের। কিন্তু যখন প্রশ্ন আসে এমন কোনো বিষয়ের যেখানে কোনো জোর জবরদস্তি কাজ করে না, সেখানে জোর জবরদস্তির চিন্তার, দখলদারিত্ব আর পুরুষতারন্ত্রিকতার আল্টিমেট ভিকটিম পুরুষ নিজেই। এবং যেই অসহায়ত্বের জন্য আর কিছুকে নয়, কেবল দায়ী করা যায় নিজেদের সামাজিক কাঁধে ও শারীরিক মগজে বয়ে বেড়ানো পুরুষতান্ত্রিকতাকে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]