November 2, 2024
সম্পাদকীয়

নিজের শরীর ও মনকে মুক্তি দেবার কর্তব্য নারীর নিজের

শারমিন শামস্।। নানা সময়ে অনেক বিপদগ্রস্থ, দ্বিধান্বিত, সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, মনোকষ্টে ভোগা, নির্যাতনের শিকার মেয়ের সাথে কথা বলার প্রয়োজন হয়। তারা আমার সাথে যোগাযোগ করে। এসব ক্ষেত্রে আমি প্রধানত যা করি, তা হলো- শোনা। আমি মন দিয়ে ওদের কথা শুনি। আমি চেষ্টা করি, যেন তারা মন খুলে নিজের সমস্যা ও কষ্টের কথাগুলো আমার সাথে শেয়ার করতে পারে। কারণ আমি বিশ্বাস করি, নিজেকে খুলে মেলে ধরতে পারলেই সমস্যা সমাধানের পথে অন্তত বিরাট বড় একটা ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। আমাদের বেশিরভাগ সমস্যারই সমাধান হয় না, কারণ আমরা স্পষ্ট করে সমস্যার কথা বলতে পারি না। এমনকি কেউ কেউ নিজের কাছেও যেন নিজেকে খুলে মেলে ধরতে পারেন না। এই খুলে মেলে ধরতে না পারাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি করে, সমাধান তো দূরের কথা।

তো, অনেক মেয়েকেই দেখি, সে নিজের সমস্যাটা জানে, বোঝে, কারণগুলো উদঘাটন করতে পারে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে- এটা টের পায়; কিন্তু এত কিছু বুঝবার পরেও সে অ্যাবিউসিভ রিলেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। বিশেষ করে যদি সে বিবাহিত হয়। তার উপর যদি একটা দুটো সন্তান এসে যায়, তাহলে তো হলোই, এই সম্পর্ক থেকে মুক্তির সবগুলো দরোজা সে নিজে হাতে বন্ধ করে রাখে। কারু সাধ্য নেই সেটি খুলবার।

এই যে বেরিয়ে আসতে না পারা, নিজের মুক্তির দ্বার নিজেই বন্ধ করে রাখা- এটি কিন্তু শুধু অর্থনৈতিকভাবে পার্টনারের উপর নির্ভরশীল মেয়েরাই করে তা নয়, বড় অবস্থানে ও পদে কাজ করা, ভালো আয় রোজগার করা মেয়ের ক্ষেত্রেও একই জিনিস দেখি। তাদের অনেকেই একদিকে মুখে নারীমুক্তির কথা বলে, স্বাবলম্বী হবার গল্প করে, অন্যদিকে বাড়ি ফিরে হয় সঙ্গীর হাতে মার খায়, নয় তো বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয় রাতের পর রাত। অনেকেই মেনে নেয় সঙ্গীর স্থায়ী পুরুষত্বহীনতার ব্যাধি, নানা ধরণের অসহযোগিতা, লাম্পট্য, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাচারসহ আরো বহু কিছু। নেশাগ্রস্থ স্বামীর নোংরা পরিস্কার করে সারারাত পার করে বহু উচ্চশিক্ষিত, বড় পদে কাজ করা মেয়ে, সকালে তারাই দামি মেকাপ করে, ভালো ভালো পোশাক পরে অফিসে যায়, এদিকে মুখে লেগে থাকে সারারাতের ক্লান্তি আর মনের ভেতরে ভয়, দ্বিধা, সংশয়।

আমার খুব কাছের একজন মানুষ, একজন নারী, তিনি নিজে বড় পদে বড় জায়গায় কাজ করেন, বহু বছর বিবাহিত এবং এক সন্তানের মা। তিনি বহুকাল ধরে শারীরিক ও মানসিকভাবে হাসব্যান্ডের দ্বারা নির্যাতনের শিকার। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি এই সব নির্যাতন সহ্য করছেন, অশান্তি চরমে উঠেছে। তো পরিস্থিতি যখন খুব বেশি ঘোলাটে হয়ে উঠলো, তখন এক পর্যায়ে তার হাসব্যান্ডই ডিভোর্সের প্রস্তাব রাখলেন। ঠিক তখুনি মাথা এলোমেলো হয়ে গেল ভদ্রমহিলার। উনি কোনোভাবেই হাসব্যান্ডকে ছাড়বেন না। সংসার টিকিয়ে রাখবেন। এদিকে হাসব্যান্ডের বাড়ির লোকজনও তার সাথে চরম দুর্ব্যবহার করে। হেন কোনো গালি নেই যা তাকে শুনতে হয় না। এসবের বাইরেও লোকটির নানা লাম্পট্য ও নোংরা অভ্যাসের কথা ক্রমে জানা গেল। প্রকাশ পেতে শুরু করলো অন্য নারীদের প্রতি তার নোংরা দৃষ্টির কাহিনী। প্রমাণসহ এসব জানতে পারলেন মহিলা। তবুও কি আশ্চর্য, তিনি সংসারই করতে চান! নানাভাবে নানা অযুহাত খাড়া করেন। যেমন সন্তানের কথা বলেন। এদিকে সন্তান বেশ বড় হয়ে গেছে। সে সবই বোঝে।

অবশেষে আমরা বুঝলাম, আসল সমস্যা ভদ্রমহিলার নিজের ভেতরেই। সংসার করার অভ্যাস, আর্থিক অতি-স্বাচ্ছন্দ্যের আরাম, মাথার উপরে একটা পুরুষকে বসিয়ে রাখার নিরাপত্তা বোধ, শান্তি, আয়েশ- এর কোনোটাই তিনি ছাড়তে চান না। বিনিময়ে নিজের আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস, নিজের চাহিদা, ভালোবাসা, রুচি, সৌন্দর্যবোধ- সমস্ত কিছু বিসর্জন দেবেন। তবু সংসার নামের এই ভণ্ডামিটা তিনি আঁড়কে ধরে রাখবেন। যে সংসারের ভেতরে পুরোটাই ফাঁপা, ভালবাসাহীন, সম্মানহীন- সেই সংসার তিনি টিকিয়ে রাখবেন, কারণ তাতেই তার আরাম, তাতেই তার বেঁচে থাকা। কারণ নিজের মনুষ্য সত্তাটাকে হারিয়ে কবে যে তিনি মানুষ থেকে একটা আস্ত তেলাপোকা হয়ে উঠেছেন, তা তিনি নিজেই জানেন না।

তাই, বলি, নারীর প্রথম মুক্তি ঘটতে হবে তার মনের, তার মননের। তার আত্মার। তার সত্তার। নিজের ভেতরের ‘আমি’টাকে স্বাধীন সার্বভৌম ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ বলে স্বীকার করতে না পারলে, অনেক বড় চাকরি, লাখ টাকা রোজগারও নারীর মুক্তি ঘটাতে পারে না। কারণ শেষ পর্যন্ত নিজের আয় করা টাকাও নিজের হয়ে থাকে না, নিজের চাকরি ক্ষেত্রে ও পরিবারের ভেতরেও নিজের চাকরি নিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নষ্ট হয়, ক্ষমতা থাকেও না, যদি না নিজের ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাসী, আত্মসম্মানবোধওয়ালা মানুষ তৈরি হয়। একজন অল্পশিক্ষিত, স্বল্প আয়ের নিম্নবিত্ত নারীও বহু ক্ষেত্রে নির্যাতন থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসেন, কারণ তার ভেতরে সেই আত্মবিশ্বাসী আত্মাটা নিজের মত করে বাঁচতে চায়। নিজেকে অসম্মান করা তার পোষায় না বলেই নিজের আর্থিক অস্বচ্ছলতাকে থোড়াই কেয়ার করে হলেও, নিজের জন্য নতুন জীবন তিনি প্রত্যাশা করেন, সে লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেবার মত সাহস ও প্রত্যয় তিনি ধারণ করেন নিজের ভেতরে।

নারীর ‍মুক্তি তাই নিজের ভেতরের মুক্তিতেই। নির্যাতন নিপীড়ন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে নিজের ভেতরের সত্তাকে সাহসী ও আত্মনির্ভরশীল একটি মানুষে পরিনত করা নারীর নিজের দায়। নিজের শরীর ও মনকে মুক্তি দেবার কর্তব্য নারীর নিজের। নতুন জীবন বেছে নেবার ইচ্ছাশক্তি জেগে ওঠা চাই নিজের ভেতরে।

নতুন বছর নতুন প্রত্যাশা নিয়ে আসে। নতুন দিন নতুন স্বপ্ন দেখায়। চারিদিকে যে মেয়েরা ক্রমাগত নিজের আত্মসম্মান বলি দিয়ে সংসারের নামে কোনো মিথ্যের জগতে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছে, তাদের বোধ বুদ্ধি জেগে উঠুক। তারা নিজেকে ভালবাসতে শিখুক। নিজেকে নিয়ে ভাবতে শিখুক। পরগাছা হয়ে নয়, নিজের মানসিক ক্ষমতা ও একা চলার শক্তিতে জীবন কাটাবার সাহস করুক তারা। সে নিজে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ- এটি বিশ্বাস করতে শিখুক। নতুন বছর তাদের নতুন জীবন দিক।

সবাইকে ভালবাসা। শুভ হোক নতুন বছর।