November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

ছেলেদের কাজ বনাম মেয়েদের কাজ

আফরোজ ন্যান্সি।। স্কুলে আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র এক ছেলে ছিল। ও নাচতে পছন্দ করতো। উপজেলাভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদের গার্লস স্কুল থেকে অনেক মেয়ে অংশ নিতো, কিন্তু বয়েজ স্কুল থেকে শুধুমাত্র ওই একটা ছেলেই ছিল যে নাচে অংশ নিতো।

আমরা তো বটেই, ওর ক্লাশমেটরাও ওকে নিয়ে মজা করতো। এলাকায় ওর নামই হয়ে গেছিলো হাফ লেডিস। ছেলেটা যথেষ্ট ভদ্র ছিল, কখনো কোনো মেয়েকে টিজ করতো না, নিজের মতো পড়ালেখা আর নাচ নিয়েই থাকতো। তবু ওকে দেখলেই অকারনেই মানুষ আক্রমন করতো। ও যখন স্টেজে উঠতো চারদিক থেকে আজেবাজে মন্তব্য করে শ্লোগান দিতো ছেলে-মেয়েরা। তার পরিবার থেকেও চাপ ছিল- যে ছেলে এলাকায় হাফ লেডিস নামে পরিচিত তার জন্যে পাত্রী পাওয়া যাবেনা বলে। একটা সময়ে  নাচ ছেড়ে দিয়েছিল ছেলেটা।

সেদিন এক উদ্যোক্তা গ্রুপে ১৬/১৭ বছরের এক ছেলে পোস্ট দিয়েছে, সে কেক বানাতে ভালোবাসে কিন্তু তার আত্মীয়রা বাসায় এসে যখন শোনে ছেলে কেক বানায় তখন তার মাকে নানা রকম কটু কথা শোনায়। ছেলেটি লিখেছে, “শুধু মা পাশে আছে বলেই আমার পছন্দের কাজটা করে যেতে পারছি।”

এমন কেন হয় যে কোনো ছেলে নাচতে বা রাঁধতে পছন্দ করলে আমরা তা সহজ সুন্দরভাবে নিতে পারিনা? আবার কোনো মেয়ে রাধতে পছন্দ করেনা শুনলে আমরা ক্যামন অবাক চোখে তাকাই যেন এমন আশ্চর্যের কিছু জীবনেও শুনিনি! যেন নারীজন্ম মানেই তার প্রধান পছন্দের বিষয় হতে হবে রান্না করা আর সংসার করা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমদের মধ্যে এতো বেশি কূপমণ্ডুকতা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, আমরা নিজেদের জানার বাইরে নতুন কোনো চিন্তাকে গ্রহণ করতেই অপারগ।

আজকাল মেয়েরা চাকরি করছে, আবার অনেকে ব্যবসাও করছে। পুরুষ তো বটেই, অনেক মেয়েকেও বলতে শুনি, মেয়েদের জন্য শিক্ষকতাই নিরাপদ। যেসব মেয়েরা উদ্যোক্তা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই রান্না-বান্না, জামাকাপড় আর গয়না বেচার মধ্যেই আটকে থাকছে। ব্যতিক্রম কিছু নেই তা নয়, তবে তা হাতে গোনা। দেখে মনে হবে যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মানুষের গলায় গরুর মতো দড়ি বেঁধে রেখে দিয়েছে যেন সে তার গণ্ডির বাইরে বেরোতে না পারে। ভাবতে অবাক লাগে আজকের দিনেও ছেলের কাজ, মেয়ের কাজ বলে কাজকে আমরা ভাগাভাগি করে দিচ্ছি। ছেলেরা ঘরের কাজের ক’-ও জানবে না এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিই আবার মেয়েরা সবরকমের পেশাকে সচ্ছন্দ্যে বেছে নেবে এটাকে বাকাভাবে দেখি। আমরা যতই সার্টিফিকেট অর্জন করিনা কেন, আমাদের মধ্যে থেকে এই পুরুষতান্ত্রিক কূপমণ্ডুক স্বভাবটিকে নির্মূল করতে পারছি না।

মানুষের জীবন একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। এখানে বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় তার প্রতিটি কাজই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে জানা জরুরি। একজন মানুষের জন্য অর্থোপার্জন যতটা জরুরি ঠিক তেমনি রাঁধতে পারা, ঘর গুছিয়ে রাখতে পারা, সন্তান এবং বৃদ্ধ বাবা মায়ের দেখাশোনা করতে পারা, ট্যাক্স, বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে পারার মতো বেসিক জ্ঞানগুলি থাকা জরুরি। আমাদের দেশের পুরুষেরা শিশুকাল থেকে জানে যে, তাকে কেবল কোনোমতে একটা সার্টিফিকেট যোগাড় করে একটা চাকরিতে ঢুকতে পারলেই হবে। জীবনের আর বাকি দিকগুলি নিয়ে তাকে আর ভাবতে হবেনা। তিনবেলার খাবার তার সামনে চলে আসবে, ধোয়া ইস্ত্রি করা কাপড় তার মৌলিক অধিকার, তার ঔরসজাত সন্তান হোক কিংবা তার নিজের বাবা-মা, তাদের সেবাযত্নের জন্য আরেকজন নারী আছে। অতএব নয়টা-পাঁচটা চাকরির পরে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়ে বেড়াতে কোনো অসুবিধা নাই।

একইভাবে মেয়েগুলির মগজে শিশুকাল থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংসারই পরম ধর্ম। আজকের দিনে এসেও তাই আমাদের নারীরা সংসার করার পাশাপাশি সব থেকে সহজে যে কর্মটি করা যায় সেটিকেই বেছে নেন পেশা হিসেবে। যে পেশায় স্ট্রেস বেশি নিতে হয়, সময় বেশি দিতে হয়, সেসব পেশাকে নারীরা এড়িয়ে চলতে চান। আমি এমন দুই একজন নারীকে দেখেছি যারা বিয়ের পরে ডাক্তারি, সাংবাদিকতা ছেড়েছেন কেননা তিনি সংসারে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। আজকের দিনেও বিয়ের পরে মেয়েরা চাকরি করবে কি করবে না, মা হওয়ার পরে চাকরি করবে কি করবে না এটি বিবেচ্য বিষয়। আমাদের অনেক নারী জানেন না কিভাবে জমির খাজনা, ট্যাক্স রিটার্ন কিংবা বিদ্যুৎ বিল জমা করাতে হয়! জানার প্রয়োজন তারা বোধ করেন বলে মনে হয়না কেননা পুরুষ সঙ্গী তো আছেই এসব কাজের জন্য।

আমাদের বাবা-মায়েরাও বছরের পর বছর ধরে ছেলে-মেয়েকে এই শিক্ষা দিয়ে বড় করে যাচ্ছেন। এরপরেও যখন কোনো ছেলে বা মেয়ে তার ধারার বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করতে আগ্রহী হয় তখন হা রে রে রে করে ছুটে আসেন সমাজপতিরা। ছেলেমানুষ রান্না করলে তাদের আপত্তি, মেয়েরা মটরসাইকেল চালালে তাদের আপত্তি। কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর সাথে ঘরের কাজ ভাগাভাগি করে করলে তিনি হন হাসির পাত্র। খুব নোংরা ইঙ্গিত করে বলা হয় মাইগ্যা পুরুষ। অন্যদিকে কোনো নারী ঘরে-বাইরে সমস্ত কাজে সমানতালে পারদর্শী হলে, পুরুষের মুখাপেক্ষী না হলে তাকে বলা হয় ব্যাটাছেলে। সমাজের এই জঘন্য মানসিকতার ফলে দিনশেষে এমন এক অথর্ব জাতির জন্ম হচ্ছে যাদের বেশিভাগই অলস এবং অদক্ষ। এরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই অলসতা আর অদক্ষতা যাপন করছে বুক ফুলিয়ে। এরা কখনো স্বয়ংসম্পূর্ন একজন মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করা তো দূরের কথা, ভাবতেও পারেনা। এবং এই যে দিনের পর দিন এরা অলস এবং অদক্ষ হয়ে জীবন যাপন করছেন তা নিয়ে তাদের কোনো লজ্জাও নেই।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]