May 16, 2024
সাম্প্রতিকসাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

ট্রাম্পের বিদায় যেন ‘লৌহ যবনিকা’র অবসান

আতিকুল ইসলাম ইমন।। বামপন্থীদের নাকি ব্যঙ্গ করে দক্ষিণপন্থীরা বলতেন, ভিয়েতনামে বৃষ্টি হলে বাংলায় ছাতা ধরেন তারা। বিশ্বজুড়ে বামপন্থী রাজনীতির দাপট উবে গেছে। এখন ভিয়েতনাম, রাশিয়া বা চীনে বৃষ্টি হলে বাংলায় কেউ ছাতা ধরে না। তবে আমেরিকায় হলে পৃথিবীজুড়ে ছাতা ধরার লোকের অভাব নেই। আমেরিকার ব্যাপারটি ব্যঙ্গ করে বলছি না। বরং তাদের খ্যাতি গাইছি। কারণ আছে।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব-প্রতিপত্তি যেখানে গিয়ে ঠেকেছে তাতে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেখানে যা ঘটে তার প্রভাব সারা বিশ্বব্যবস্থায় একটু বেশি মাত্রায়ই পড়ে। আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দা চললে সারা পৃথিবীকে ভুগতে হয়। আমেরিকায় কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হলে এর ছোঁয়া লাগে বাকি বিশ্বে। আমেরিকায় উদারবাদ সুবিধা করলে সারাবিশ্বে দেখা যায় উদারবাদীরা এগিয়ে আসছেন, আবার আমেরিকায় কট্টরবাদ তুঙ্গে উঠলে অন্যখানেও তার আছর পড়ে।

অন্যকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার শক্তি আমেরিকার এসেছে অর্থনৈতিক ও সামরিক বিশাল সামর্থ্য থেকে। আমেরিকা যেভাবে একই সঙ্গে বৃহৎ উৎপাদক, তেমনি সে বড় ভোক্তাও। তাই আমেরিকার বাজারের উপর নির্ভরশীল তার শত্রুরাও। আমেরিকার উৎপাদন ক্ষমতার দিকে তাকালেই দেশটির প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সামর্থ্যের চিত্র বোঝা যায়। গত অর্থবছরে দেশটিতে উৎপাদন হয়েছে- ১৯ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য বা সেবা। যেখানে গণচীনের উৎপাদন ১২ দশমিক ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার সমমূল্যের। আর তিন নম্বরে জাপানের উৎপাদন ৪ দশমিক ৮৭ ট্রিলিয়ন সমমূল্যের। এ থেকেই বোঝা যায় আমেরিকা উৎপাদনের শক্তিতে অন্যদের চেয়ে কত এগিয়ে। একইভাবে ভোগের দিক থেকেও আমেরিকার বাজার সবচেয়ে বড়। আমেরিকার বাজারে প্রবেশাধিকার না পেলে ছোট-বড় উৎপাদক দেশগুলো মহা-বিপাকে পড়ে। অনিঃশেষ পুঁজিবাদী শক্তির ভাণ্ডার আমেরিকা যেভাবে সারা বিশ্বকে কুক্ষিগত করে রেখেছে, তা অভিমান করে এক বাক্যে অস্বীকার করা যেতে পারে, কিন্তু তথ্য উপাত্ত তাতে সায় দেবে না।

অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা একমাত্র পালের গোদা। কেউ না চাইলেও বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকার প্রভাব থেকে বাইরে থাকা কঠিন। আগেই যেমনটা বললাম- আমেরিকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রভাব সারা বিশ্বে পড়ে, পড়তে বাধ্য।

ট্রাম্প ছিলেন মার্কিন ক্ষমতার রাজনীতিতে নেপথ্য শক্তির একজন প্রতিনিধি। তবে তিনি আজীবন নেপথ্য শক্তির ভূমিকায় থাকতে ভালোবাসেননি, ফলে গতবার রাজনীতিতে গাত্রোত্থান করেন। ক্ষমতার শীর্ষে যেতে তার বেগ পেতে হয়নি, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের অহংয়ে তাল দিয়ে লেলিয়ে দিলে বাক্সে কিভাবে অকৃপণভাবে ভোট জমা পড়ে তা ছিল তার জানা।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দেখা গেল সারা বিশ্বেই কর্তৃত্ববাদী শাসকবর্গ যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। যেখানে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের পায়ের তলার মাটি নরম ছিল সেখানে তা শক্ত হয়ে গেল। এর কারণ আর কিছুই নয়—ট্রাম্প নিজে কর্তৃত্ববাদী, তাই তার ঝোঁকটাও ছিল কর্তৃত্ববাদীদের পক্ষে।

২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে বসার পর এমন কিছু বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা সমর্থন/বিরোধিতা করেছেন যার প্রভাব সারা বিশ্বে অত্যন্ত জোরালোভাবে পড়েছে। জলবায়ু অভিঘাত মোকাবিলায় বহু কাঠখড় পুড়িয়ে নেওয়া উদ্যোগগুলোতে জল ঢেলে দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। জলবায়ু সংকট বিজ্ঞানীদের একটি ভুয়া আশঙ্কা বলে মন্তব্য করে তিনি আমেরিকাকে এ সংক্রান্ত নানা উদ্যোগ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে ট্রাম্পের শাসনামলে জলবায়ুর বিরুদ্ধে লড়াই স্তিমিত হয়ে যায়। যখন সারাবিশ্ব চরম জলবায়ু ঝুঁকিতে ঠিক সে সময় আমেরিকার পিছুটানে অন্য কিছু কর্তৃত্ববাদী সরকারও ঢিল দেয়। যেমন দক্ষিণ আমেরিকায় মহাবন আমাজান পুড়ে ছারখার হয়ে গেলেও তাতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বরং দাবানলের জন্য দায়ীদের পক্ষেই ওকালতি করতে চক্ষু লজ্জাও করেনি তার।

ট্রাম্পের শাসনামলে নানা সামাজিক ইস্যুতে আমেরিকার বুদ্ধিবৃত্তিক ও সুশীল সমাজের পাশাপাশি হোয়াইট হাউজও যে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসে তাতে বড় ছেদ পড়েছে। আমেরিকা নামক দেশটি লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, বর্ণবাদবিরোধী আচরণ ইত্যাদি ইস্যুতে বহু দিন ধরে তালিম দিয়ে আসছে। গত চার বছরে আমেরিকায় ক্রমাগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনে প্রেসিডেন্টের মদদ, বর্ণবাদে উস্কানি, লিঙ্গভিত্তিক টিটকারি ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে বরং লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণবাদ, গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ ইত্যাদিকে উস্কানি দিয়েছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা তার সাঙ্গপাঙ্গরা যখন কৃষ্ণাঙ্গদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারে মৌন সমর্থন দেন তখন সারাবিশ্বেই বর্ণবাদী নেতারা তা জায়েজ মনে করেন ও তার নিজ দেশে অনুসরণ করতে উৎসাহ পান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যখন হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট নামক বর্ণবাদীদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে যান, তখন অন্য দেশের জাতিগত সংখ্যাগুরু কট্টরপন্থীরা আস্কারা পায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যখন একাধিক যৌন হেনস্থার মারাত্মক অভিযোগ উঠে এবং তাতে তিনি গা-ছাড়া ভাব দেখান এবং অভিযোগকারীকে দোষ দিয়ে অভিযোগ উড়িয়ে দেন, তখন তার এমন আচরণে অন্য প্রভাবশালী দোষীরাও লাই পেয়ে যান। ফলে আমেরিকায় ট্রাম্পের মতো শাসক দীর্ঘস্থায়ী হলে তা ভবিষ্যত বিশ্বের জন্য আশঙ্কার হতো। তবুও ইতিমধ্যে ট্রাম্পের রেখে যাওয়া ট্রাম্পবাদ কতদিন তাড়া করবে তা নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে।

গত চার বছর কোনো মূল্যবোধের প্রতি ন্যুনতম শ্রদ্ধা দেখাতেও কার্পণ্য করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে এক নম্বর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটি শাসন করেছেন তা বিশ্বের জন্য শুভ ছিল না। লৈঙ্গিক টিটকারি, জাতিগত বিদ্বেষ, বর্ণবাদী উস্কানি দেওয়ার পরেও গত ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হলে বড় যে সমস্যাটি হতো তা হলো- এসব বিষয় নিয়ে অনেক দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রধানরা আর সতর্ক থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন না। দেশে দেশে যে লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণবাদ, সংখ্যাগুরুদের আধিপত্য ইত্যাদি ইস্যুতে কঠিন সংগ্রাম চলছে তা হুমকির মুখে পড়ত।

ক্যাপিটল হিলে হামলার পর অনেকেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘আগেই বলেছিলাম, এটাই আমেরিকা’। পুতিন, শি জিনপিংরা মুচকি হেসেছেন। অন্যরা নাক উঁচু করে বলেছেন, ‘এই দেশটির গণতন্ত্র বড়ই নাজুক’। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন, এর প্রতি শ্রদ্ধা এবং চর্চার ধারে কাছেও কি আছে এসব মুচকি হাসি দেওয়া সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী দেশগুলো? উত্তর হলো- না, নেই। তাই আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে আঘাতে আমাদের মন নেচে ওঠেনি, বরং আশঙ্কা হয়, অন্য অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে নিজেদের কাজের জায়েজিকরণে ব্যবহার করবে। এই হামলার পেছনেও ট্রাম্পের প্রত্যক্ষ উস্কানি ছিল, তাই গণতন্ত্রের জন্য চূড়ান্ত খারাপ এক নজির রেখে যাওয়ার দায়ও তার।

এমন নানা প্রকারে বিশ্ব সভ্যতার উন্নতির পক্ষে ক্ষয়ক্ষতির কারণ হওয়া ট্রাম্পের চার বছরের শাসন দেখার পর তার পরাজয়কে লৌহ যবনিকার অবসানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সেকালে জার্মানিতে দেওয়াল তুলে বিশ্বকে দুই রাজনৈতিক আদর্শের শিবিরে ভাগ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত কারো জন্য ভালো হয়নি। এর পতনেই বরং সকলের মঙ্গল ছিল। আর এবারের লৌহ যবনিকা ছিলেন ব্যক্তি ট্রাম্প নিজেই।