পরী অথবা জীবন দর্শন
রাজনীন ফারজানা ।।
ক্ষয়ে যাই নিস্তব্ধ রাত্রির ঝরে পড়া কুয়াশার সাথে
মিশে যাই রাতকানা ডাহুকের ডাকে
মাঠ ছাড়ায়ে, ঘাট পারায়ে উড়ে উড়ে যাই
পারায়ে সহস্র রাত, দিন, বিকেল আর সন্ধ্যা,
যাই অচিনলোকে ভেসে
ওই ওখানে খয়েরি রঙের টিনের চালের মসজিদ
পুরনো নিচু পোতার ঘর, মিম্বরের জায়গাটা বাইরের দিকে গোলচেমতো, ব্যাঁকা
ছোট্ট খুপরির মতো জানলা…
মসজিদের মধ্যি দিনেরবেলাও কেমন ছমছমে অন্ধকার
মসজিদের আঙিনার চারধারে হলুদ-সবুজ পাতাবাহার আর তাকে ঘিরে প্যাচানো স্বর্ণলতার বেড়া
এর সামনেই খেলি সকাল, বিকেল;
ছোট্ট কুড়ির মতো বয়স তখন,
ধপধপে সাদা, পরীর মতো বাচ্চা আমি,
মা মরে গেছে, বুড়ো বাপ সারাদিন মসজিদে থাকে
আব্বা যখন মসজিদের মধ্যি নামাজ পড়ত নাহয় জিকির করতো, পরীর মতো আমি বাগানঘিরা আঙিনায় খেলে বেড়াতাম
একদিন সকালবেলা মাটির হাড়িতে পাতার তরকারি চড়ায়ে দিব্বি ঘরকন্না করছি
চারপাশে ঝিঁঝিঁর ডাক, এমনই ঘন গাছের বন চারদিকে
এমন সময় খসখসে শব্দে গেন্দাফুলের ঝাড়ের দিকে তাকায়ে দেখি সেখানে দাঁড়ায়ে
অপূর্ব এক নারী
সাদা জামায় ঢাকা শরীর,
জামার মতোই সাদা যেন তার গা,
আমাকে ইশারায় ডাকলো।
পাঁচবছরের আমি পায়ে পায়ে আগোচ্ছি সেদিক
যেন বেহেশত থেকে আমার শিশুকালে মরে যাওয়া মা।
আমি যাচ্ছি, যাচ্ছি, কাছে যাতিই অপূর্ব সুন্দর গন্ধ
গেন্দাফুলের গন্ধ না, অন্যকিছু…
মায়ের কাছে গেলেই কি যেন হল
গন্ধটা আমার মাথার মধ্যে যেয়ে কি যেন করলো আর আমি ঘুমায়ে গেলাম
পাঁচদিন পর জ্ঞান ফিরলো।
শুনলাম পরীতে পাইছিলো আমারে
সেইদিন থেকেই তীব্র জ্বর
এরপর কী কী যেন হলো, অত কিছু মনে পড়ে না।
শিশুকালে বিয়ে হল ভিন গাঁয়ে
বিরাট পরিবার, আমার বাপজানদের মতোই উঁচু বংশ
শাশুড়ি, ননদ, জা’য়েদের ভয়ে ভয়ে থাকি সারাদিন,
কী করতে করতে কী ভুল হয়…
সংসার শিখতে শিখতে বড় হতে হতে বুড়ো হয়ে গেলাম
ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতিনের ভরা সংসার দেখলাম
এরমধ্যে আমি যে কে তা-ই জানলাম না
সারাটা জীবন, অমুকের বউ, তমুকের মা, এর দাদী, ওর নানীই হয়ে থাকলো আমার পরিচয়
কোনোদিন এসব নিয়ে ভাবিওনি অবশ্য
শুধু মাঝেমধ্যে, ভরদুপুরে, নিঝুম নিরালায় দাওয়ায় বসে রান্নাঘরের ঠান্ডা কড়কড়ে ভাতে মরিচ ডলতে ডলতে মায়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করতাম
চোখ দিয়ে পানি গড়ায়ে ভাতের গামলায় পড়ত
আর খাওয়া হত না
বিড়াল আর কুকুরদের দিয়ে উঠে পড়তাম
বিকেলের পাড়াবেড়ানো শেষ করে সন্ধ্যায় রানতি রানতি গনগনে আগুনের দিকে চাইলে মনে পড়ত সেই পরীর মুখ
কে যে মা, কে যে পরী তা গুলায়ে ফেলতাম
একের পর এক ছাওয়াল-মায়ে জন্ম দিতে দিতে জরায়ু গেল ঝুলে;
প্রসাব করার সময় বেরয়ে যেত
হাত দিয়ে ঠেলে উঠোয় দিতাম,
কি ব্যথা, কি যন্ত্রণা
তাও রক্ষা নাই
বুড়োটা মাঝেমধ্যেই চড়ে বসত গায়ে!
একসময় আমিও বুড়ো হলাম,
ততদিনে বুড়ো চলে গেছে ওপারে।
আট বছর পর আমিও চলে আসলাম;
সারাজীবন ধরে ভাবিছি, শিশুকালে দেখা সেই পরী আকাশে থাকে
আশা ছিল, মরার পর দেখা হবে
তারে জিজ্ঞেস করবো, সে আমার চেহারা না দেখা মা কিনা!
কিন্তু নিজে আকাশে এসে দেখলাম-
কেউ নাই, কিছু নাই…