November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষের প্রতি যে সমাজের পক্ষপাতিত্ব চক্ষুলজ্জাহীন

নন্দিতা সিনহা।। একটা মেয়ের জন্ম নেয়া এবং জন্মদাত্রী নারীকেও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা এই সমাজে একজন নারীকে  মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কী পরিমান পক্ষপাতের শিকার হতে হয় সেটা পুরুষের কল্পনাতীত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলাটাও আমার ঠিক হয়নি, মৃত্যুর পরেও এই পক্ষপাতিত্বের ধারা অব্যাহত থাকে।

এক মৃত দম্পত্তির স্মরণে পিরামিড আকৃতির দুটি বেদী নির্মাণ করা হয়েছে, পাশাপাশি। দেখি যে দুটি বেদীর আকৃতি এক হলেও আকারে একটা অন্যটার তুলনায় ছোট করা হয়েছে। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ছোট বেদীটা স্ত্রীর। স্ত্রীজাতি স্বামীজাতির নিম্নস্তরের বলেই এই ব্যবস্থা। এই আমাদের সমাজ। এখানে নারীকে মানুষ হিসেবে মানবিক অধিকারটা পর্যন্ত বিভিন্ন রকমের অপ্রীতিকর লড়াই করে পেতে হয়। নয়তো বঞ্চিত হতে হয়। বিশেষ করে আমাদের এই উপমহাদেশে আজো নারীকে নারী হওয়ার কারণে আজীবন খেসারত দিয়ে যেতে হয়। আজো নারীর বাইরে যাওয়াকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখা হয়।

লেখাপড়া করা উচ্চশিক্ষিত নারী মানেই আমাদের তথাকথিত সমাজের চক্ষুশূল। আজো মেয়েদের  লেখাপড়া মানেই অহেতুক আর্থিক লোকসান। আর ছেলেদের বেলায় সেটা বিনিয়োগ বলে গন্য হয়। পুরুষের যে কাজে আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ গুরুতর কোনো দোষ দেখতে পায় না সেই একই কাজ মেয়েদের বেলায় অপরাধ বলে মানা হয়, নির্লজ্জভাবে যার একমাত্র কারণ দেখানো হয় লিঙ্গীয় পরিচয়ে মানুষটা একজন নারী। আর দুঃখজনকভাবে এসবের পেছনের মূল হোতা হিসেবে থাকেন আমাদের সমাজের নারীরাই।

জন্মের পর থেকেই নারীদের উপর যে মগজধোলাই চলে তার তার প্রেক্ষাপটে নারীমাত্রই পুরুষের অধীন। যেসব কাজ পুরুষ অনায়াসে অবলীলায় করে সেসব করতে নারীকে হাজারবার ভাবনাচিন্তা করতে হয়। এমন না যে নারী তার সামর্থ্যের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, বরং একচোখা এই সমাজের হাজার বাধানিষেধ নিয়েই তাকে ভাবতে হয় বেশি। যেখানে নারী তার পরিবারের সাপোর্টটুকুও পায় না সেখানে সমাজের অলিখিত  বিধিনিষেধের তোয়াক্কাবিহীন কিছু করাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর বিয়ের পর তো কথাই নেই। বিয়ের আগে যেন নারী ছিল পুরুষের অঘোষিত দাস, আর বিয়ের পর হয়ে যায় ঘোষিত দাস। আর দাসমাত্রই মনিবের আজ্ঞাবহ, বিশ্বস্ত। আজও আমাদের সমাজে বিবাহ মানেই চুক্তিতে কাজের মেয়ে আনা।

নারীও এই সমাজে পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করবে, নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে তা আমাদের এই পুরুষতন্ত্রের বীজ বহনকারী সমাজের নারী বা পুরুষ কেউই হতে দিতে রাজি নয়। নারীকে চিরাচরিত অবয়বে কাঁদতে দেখতে অভ্যস্ত এ সমাজ। এখানে পুরুষমাত্রই পরম প্রাপ্তি। হোক তা পুত্র হিসেবে, ভাই হিসেবে বা স্বামী হিসেবে। হোক সে নৈতিকতা বিবর্জিত চরিত্রহীন অমানুষ। দিনশেষে আসল পরিচয় তার পুরুষত্ব, পুরুষ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পরম সাধনার ধন, যার সাতখুন আমরা চোখ বুজে মাফ করে দিতে পারি।

এই সমাজই নারীকে নিজেদের পুরুষের অধীন ভাবতে শেখায় তার শৈশবকাল থেকেই। তোমার এটা করা যাবে না ওটা করা যাবে না, তুমি মেয়ে, ও ছেলে- এ ধরনের পক্ষপাতমূলক আদেশ উপদেশের সাথে আমরা চিরপরিচিত। এমন পরিবেশে থেকে বড় হওয়া বেশিরভাগ নারীই কখনও বুঝে উঠতে পারে না মানুষ হিসেবে তারও মানবিক অধিকার বলে কিছু একটা আছে, যা নারী পুরুষ সকলের জন্যই সমান।

একজন নারী যত সফল হয়ে দেখাক না কেন, তার সফলতা নির্ধারণ করা হয় তার পারিবারিক তথা বৈবাহিক বিষয়াদি বিবেচনা করে। নারীর স্বীয় যোগ্যতায় অর্জিত সাফল্য এখানে অপাংক্তেয়ই। আর বিবাহ বিষয়ক অযৌক্তিক অসভ্য আচরণের কথা বলতে গেলে প্রথমেই দেখা যায়, চৌদ্দ ঘাটে ভিড়েছে যে ভেড়া সেও বিয়ে করার জন্য চায় সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত পরিশুদ্ধ একখানা আনকোরা ভার্জিন বউ। উশৃংখল, চরিত্রহীন, অশিষ্ট পুত্রের পিতামাতাও ছেলের জন্য পেতে চান একটা শান্তশিষ্ঠ গুনবতী পুত্রবধূ। কারণ আর কিছুই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীন পুত্রের সমস্ত স্বৈরাচারি আচরণ ও অত্যাচার মেনে নিয়ে সমস্ত পরিবারের দাসত্ব করার মতো মনমানসিকতার ও সন্তান জন্ম দেওয়ার একটা মেশিনের দরকার এসব পুত্র ও তার অভিভাবকদের। তারপর নারীর বিবাহ পরবর্তী জীবনের দুর্দশার কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরেকটা কথা সমাজে বহুল প্রচলিত আছে যে, মেয়েমানুষের বেশি বুদ্ধি হলে নাকি সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। সেদিন ফেসবুকে নিউজফিডে একটা ভিডিওতে বলা হচ্ছে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী ও সুখময় করতে একটু বোকাসোকা ধরনের প্রেমিকা বা স্ত্রী-ই শ্রেয়। কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে এসব ভিডিও প্রমোট হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়ায়। হায়রে আমাদের সমাজ!যেখানে সারা উন্নত পৃথিবীতে মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে নিজেদের ও পৃথিবীর উৎকর্ষ সাধনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, সেখানে আমাদের এই সমাজে জীবনসঙ্গী হিসেবে মাথামোটা সঙ্গীকে জীবনে যুক্ত করার উপযোগী মনে করা হচ্ছে। আসলে জীবনে বা মনে জায়গা দেওয়ার বিষয়টা এখানে উপেক্ষিত, প্রথমেই যে বললাম, সিংহভাগ বিবাহেরই মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবারের অমানবিক দাসত্ব মেনে এক গণ্ডমূর্খের সংসারে আরো একাধিক গণ্ডমূর্খের জন্ম দেয়া।

আমরা আমাদের পরিবারগুলোর দিকে একটু গভীর পর্যবেক্ষণ করলেই জানতে পারবো আমরা পরিবারের কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তানের মধ্যে কীরকম অসামঞ্জস্য বিধান করে রেখেছি। অধিকাংশ মানুষই নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারেন না। একটা এনজিওর উদ্বোধনী সভায় একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বললেন, নারীর নাকি চারটি পরিচয়- মা, বোন, কন্যা ও স্ত্রী।আমি শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি নারীর ‘মানুষ’ পরিচয়টা শোনার, শুনতে পাইনি। আমি আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, সাধারণ মানুষের কথা না হয় বাদ দিলাম, এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও কি মনে করেন না নারীরাও প্রাণিজগতে মনুষ্যজাতির অন্তর্ভুক্ত!

আমরা নারীরা দিনশেষে সবাই শোষিত শ্রেণির। নারীদের দ্বারাই যখন নারীকে ঘরে বাইরে বিড়ম্বিত হতে হয় তখন ব্যপারটা খুবই দুঃখজনক। নারী শক্তির আধার বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি। এক নারী যখন অন্য নারীকে সাহায্য করে তখন চমৎকার সব জিনিস ঘটতে থাকে। ‘নারী পুরুষ সমান’ এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে আমরা নারীকে অনবদমিত করা বন্ধ করি, দেখা যাবে এই সুন্দর পৃথিবী আরো সুন্দর হয়ে গেছে।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]