November 24, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

ছেলেরা কাঁদে নাকি?

কিযী তাহনিন।।

 

কেমন আছ?

-কেমন যে আছি, বুঝতে তো পারছিনা।

কেন কেন?

-এই যে নানাবিধ সমস্যা…

এই তো জীবনের ধরণ, জীবনের সৌন্দর্যও বটে।

-এইগুলো কঠিন কথা, সাহিত্যে লেখা থাকে। জীবনে যে কত জ্বালা।

তা তুমি জ্বলছ তাহলে সে জ্বালায়?

-তা জ্বলছি তো বটেই, নইলে কি আর তোমার কাছে আসি বল।

তাও কথা, মানুষ বিপদে না পড়লে আমার কাছে আসেনা।  আমি তো নিতান্তই এক বটগাছ।

– হুম মানুষের অনেক কাজ, বিপদ আপদ না হলে, বটগাছের কোলের কাছে এমন অলস  হয়ে বসে কি আর দুঃখের কথা বলে?

ঠিক কথা।  তা মানুষ যে এতো বুদ্ধিমান, তার যে এতো কাজ, তবু এতো জ্বালা কেন?

-যে জ্বলে বেশি, তার জ্বালা তো বেশিই হবে, নাকি?

হু

-এই দেখ মানুষ আমরা, সারাদিন রোদে পুড়ে, ,ঘামে ভিজে, কত কাজ।  সেও তো জ্বলে যাওয়া।

তা এত জ্বলে পুড়ে, খাঁটি সোনা মানুষ তোমরা, নিখাদ। তবে কষ্ট কিসের?

-সেই জন্যই তো তোমার কাছে আসা। তুমিও তো বেশ পুড়ে ভিজে, আটখানা হয়ে দাঁড়িয়ে আছো বট গাছ।

তা আছি। তা তোমার সমস্যা কি?

– সমস্যা হল, আমার খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে।

হ্যাঁ তা ভাল কথা।  তোমরা মানুষেরা চাইলে হাসতে পার, কাঁদতেও। তো ইচ্ছে হলে কাঁদ, কে আটকাল?

-সমস্যা তো সেখানেই।

কি সমস্যা?

– আমি কাদঁতে পারিনা। কাঁদতে ভুলে গেছি।

কাঁদতে ভুলে গেছো? এ কেমনতর কথা?

-হু আর বলনা।

হাসতেও কি ভুলে গেছ, গাইতে?

-না হাসতে ভুলব কেন? সে তো প্রতিদিনই হাসি।  অট্টহাসি, মুচকি হাসি, ঝেড়ে কেশে হাসি। সুর মনে ধরলে গুনগুন গাইও।

তাহলে কাঁদতে ভুললে কিভাবে?

-অনেকদিন কাঁদিনা যে। অনেক বছর, যে বছর জন্মালাম বেশ কান্নাকাটিতে গেছে। মা বলে। আর ওই যে ছোটবেলায় একবার  পরীক্ষায় ফেল করবার পর বাপের পিটুনি খেয়ে একবার, আর ওই একবার সুমিকে ভালবেসে হারিয়ে ফেলে হালকা চোখ ছলছল। ওইটুকুই। এরপর তো আর কেঁদেছি বলে মনে করতে পারিনা।

কেন?

– এই ধর ছোটবেলায় কাঁদলে আসে পাশের সবাই বলত, “এই দেখ মেয়েদের মতন ফ্যাচফ্যাচ করছে। ছেলেরা কাঁদে নাকি?”

ওমা, ছেলেরা কাঁদে না?

– না মানে, কান্না তো পায়।  কিন্তু কাঁদতে নাকি হয়না।

কেন?

-জানিনা।

ছেলেরা কাঁদলে কি হয়? ঝড়, তুফান, ভূমিকম্প?

– জানিনা, তবে নাকি বড় লজ্জা।

হাসলে সমস্যা নাই, কাঁদলে কেন সমস্যা?

-জানিনা

হাসলে শক্তি? কাঁদলে পরাজয়?

-জানিনা।

আচ্ছা তোমরা খিদা পেলে কি করো?

– খাই

ঘুম পেলে?

-ঘুমাই

খুশি হলে?

-হাসি

কষ্ট পেলে?

– এই তো সমস্যা।  কান্না পায়।  কিন্তু কাঁদতে যে পারিনা।

হুম, তোমরা কি যেন বল সব খটমট শব্দ, আবেগ এক্সপ্রেশন, তো যে আবেগে জীবন শুরু, যে আবেগে শেষ, সে তো কান্না।  তবে সে আবেগ বেঁচে থাকায় এতো লজ্জার কেন?

-জানিনা

মানুষ কাঁদে, প্রাণী কাঁদে।  এই যে এমন ভরা শীতের হুহু রাত, কুয়াশায় জাপ্টে সেও কেমন কাঁদে। আমি তো দেখি প্রতিক্ষণ।  তবে তোমরা কাঁদবেনা কেন? ছেলেরা কি আলাদা?

-জানিনা

আচ্ছা, এটা বলত, যারা চোখে দেখেনা, যারা হাঁটতে পারেনা, তাদের যেন তোমরা কি এক আলাদা নাম ডেকে করুণা কর?

– ওহ, প্রতিবন্ধী

তবে, যে কাঁদতে পারেনা, সেও প্রতিবন্ধী। না?

-তা হবে কেন? না না।  কাঁদতে ইচ্ছে তো করে।  কিছু সময়ে সবাই কাঁদে। ছেলেরাও।

যেমন?

-এই কাছের কেউ মরে গেলে, চলে গেলে, বিদায়ে, কষ্টে। বাহ খুব আনন্দে। হালকা। এইটা নিয়ম। সর্বহারা মানুষও কাঁদে। কিন্তু নিয়ম হলো, “ছেলেরা কাঁদেনা।”

নিয়ম কে বানাল?

-ইয়ে নিয়ম তো নিয়মই। এমনটাই সবাই করে।

ওহ নিয়মের বাইরে কাঁদা যায়না? এই ধর সেই প্রিয়জন যার উপিস্থিতি কেমন মিষ্টি সুঘ্রানের মতো, ধর সে যদি হুট করে হারিয়ে যায়?  কিংবা যদি  দেশ জিতে যায়, পৃথিবীর কাছে?

-হ্যাঁ, তখন তো কান্না পায়। চোখ ভেজে।  হালকা, অল্প চোখে পানি। হাউমাউ করে ভেসে ভেসে জোরে কাঁদা হয়না। নিয়ম নাই। আমরা অমন করে কাঁদলে সবাই অদ্ভুত ভাবে।

চোখ ভেজে ? বাহ্।

-হু কিন্তু কাঁদতে যে পারিনা। আমার কি হবে বটগাছ।  জলের স্রোতের মতন ঢেউয়ে ঢেউয়ে, বৃষ্টির ফোঁটার মতন টুপটাপ। আমারও কাঁদতে ইচ্ছে করে।  কিন্তু ওই যে, ‘ছেলেরা কাঁদে নাকি?’  শুনতে শুনতে, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এবং ধীরে ধীরে না কাঁদতে কাঁদতে, ভুলে গেছি।  ভুলে গেছি কেমন করে কাঁদতে হয়।  কিন্তু আমার ও যে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে বটগাছ।

যখন কাঁদতে পারনা, তখন কি কর?

– তখন? তখন জ্বলে উঠি, রেগে উঠি, ভেঙে ফেলি, আঘাত করি। চুরমার করি।

শোন হে, দেখেছ শীতকালে কেমন অবহেলায় জমতে থাকা পুরোনো জল, হিমশীতল কাঁচের বোতলে জমে থাকে বরফ হয়ে। আলোয়, তাপে, ভাপে কেমন আবার ঠিক সময়ে জল হয়ে ওঠে।

-হু

সময় দাও, একটু অনভ্যাসে জমে আছে আর কি।  তুমিও কাঁদবে। আলো লাগবে, অনেক আলো।  সে আলোর তাপে, ভাপে, তুমিও একদিন তরল হবে পানির মতন স্বচ্ছ। গলে যাবে, ভেসে যাবে।

-কাঁদব?

হ্যাঁ কাঁদবে।  মানুষ যদি তুমি, প্রাণ যদি থাকে তোমার, তুমি কাঁদবে।

-বাহ্, সত্যি!

সত্যি।  মানুষ কাঁদে, প্রাণ কাঁদে।  পুরুষ ও কাঁদতে জানে। কিন্তু ভুলে যায়। কাঁদতে পারেনা অন্য একজন। তোমাকে কাঁদতে দেয়না অন্য একজন।

-কে বলত?

যে তোমাকে কাঁদতে দেয়না সে তোমার মগজে বসত করা, সাদা সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো, চিনির মতন অতি ভয়ঙ্কর কৃত্তিম মিষ্টি মাখানো চিটচিটে এক কিম্ভুত।

-কে সে?

ওই যে, যাকে তোমরা আদর করে সমাজ বলে ডাক।

– তো এখন কি করি বটগাছ?

হারিয়ে ফেলা জলহীন সেই খরার দিনগুলোর শোকে বরং এবার কাঁদতে পার। দেরি হয়ে যাবার আগে শুরু কর।

চল কাঁদি, চল কাঁদি।