May 15, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর জন্য হয়রানিমুক্ত কাজের পরিবেশ – আদৌ সম্ভব?

আফরোজ ন্যান্সি ।। আমাদের দেশে প্রতিনয়ত বাড়ছে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা। কিন্তু সেই তুলনায় বাড়ছে না নারীর জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিয়ে আলোচনার পরিধি। যেহেতু আমি নিজে একজন কর্মজীবী নারী তাই আমি একাই অন্তত কর্মক্ষেত্রের এক হাজার প্রতিবন্ধকতার কথা বলতে পারবো যা আমার কাজের স্বাভাবিক স্পৃহাকে নষ্ট করে। অথচ এসব নিয়ে জোরালো আলাপ খুব কমই হয়। যেসব আলাপ হয়, সেসব মূলত নারী পোশাক শ্রমিক কেন্দ্রিক। অথচ পোশাক শিল্পের বাইরেও আরো যেসব ছোট-বড় শিল্প ও প্রতিষ্ঠান আছে তার প্রায় সবগুলিতেই নারীরা কাজ করছেন। কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে নারীর জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ ওই অর্থে নেই বললেই চলে।

নারীর জন্য কর্মপরিবেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং জটিল আলাপ হচ্ছে, যৌন হয়রানি ও সহিংসতা। জটিল বলছি, কেননা যৌন হয়রানি বিষয়ে আমাদের আইনে স্পষ্ট কোনো ধারনা নেই। শ্রম আইনের ৩৩২ নং ধারায় নারীর প্রতি “অশ্লীল ও অভদ্রজনিত” আচরণের উল্লেখ আছে। তবে সেই যৌন হয়রানি এবং সহিংসতার আওতায় কী কী বিষয় ধরা হবে তার কোনো উল্লেখ নেই। আবার শুধু আইন থাকলেও তো হবেনা, পাশাপাশি দরকার আইনের বাস্তবায়ন এবং সচেতনতা। আমি দেখেছি, আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই যৌন হয়রানি বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারনা নেই। অনেক পুরুষ তো দূরের কথা অনেক নারীরও যৌন হয়রানি বিষয়ে সঠিক জানাশোনা নেই। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, যৌন হয়রানি মানেই হচ্ছে ধর্ষণ অথবা শরীরের বিশেষ কোনো অংশে বাজে স্পর্শ করা। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে একজন নারীর সাথে কীভাবে কথা বলা হচ্ছে, কী কথা বলা হচ্ছে, কীভাবে তাকানো হচ্ছে, রসিকতার ছলে অশ্লীল কথা বলা হচ্ছে কিনা এগুলো আরো বেশি গুরুত্বপূর্ন। কেননা আপাতদৃষ্টিতে এগুলিকে খুবই সামান্য আলাপ মনে হলেও, একজন নারী এসবের দ্বারা প্রতিনয়ত শারীরিক, মানসিক এবং মৌখিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন।

ধরা যাক, একজন বেসরকারি কর্মজীবী নারী যে কিনা ২০/২৫ জন পুরুষের সাথে একা বসে কাজ করছে। সেই পুরুষ সহকর্মীরা হয়তো ঐ নারীকে সরাসরি কিছু বলছে না। কিন্তু তারা নারীর শরীর, নারীর পোশাক, নারীর চরিত্র কিংবা যৌনতা নিয়ে উচ্চস্বরে এমন সব আলাপ করছে যা ঐ নারীর জন্য বিব্রতকর। এটাকে আপনি কেন হয়রানি বলবেন না? আবার শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে তার বেতন বৃদ্ধি কিংবা পদন্নোতি হলে তার চরিত্র নিয়ে বাজে মন্তব্য করাকে কেন যৌন হয়রানি বলা হবে না? আমি হলফ করে বলতে পারি এদেশের প্রায় সব কর্মজীবী নারীই এই পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত সহ্য করে যাচ্ছেন। কিন্তু এগুলিও যে যৌন হয়রানি তা অনেক নারীই জানেন না আর জানলেও যেহেতু যৌন হয়রানির বিষয়ে স্পষ্ট কোনো আইন নেই, আইন থাকলেও সচেতনতা নেই, এবং অভিযোগ জানানোর কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নেই তাই মুখ বুঁজে কাজ করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা তাদের। এদেশের বেশিরভাগ নারী-পুরুষের এই বোধটুকুই নেই যে কীভাবে ও কতভাবে যৌন হয়রানি সংঘটিত হচ্ছে। আবার অনেকে মনে করেন, পুরুষেরা একটু অশ্লীল কথা বলবে, স্ল্যাং বলবে এটাই স্বাভাবিক।

আমাদের দেশের দরিদ্রতা এবং চাকুরির বাজারের অপ্রতুলতাও একটা বড় ভূমিকা রাখছে এই ক্ষেত্রে। কর্মজীবী নারীদের একটা বড় অংশ মধ্যবিত্ত অথবা দরিদ্র। প্রয়োজনের তাগিদে যে নারীরা চাকুরি করতে এসেছে তারা চাকুরি হারানোর ভয়ে অনেক সময় মুখ খোলেন না। চাকুরি হারানো এবং পরবর্তীতে চাকুরি পাওয়া ইত্যাদি অনিশ্চয়তার মধ্যে যখন তার সাথে যৌন হয়রানি কিংবা সহিংসতার ঘটনাগুলি ঘটছে তখন ওই নারী উপায়হীন হয়ে  সহ্য করছে অথবা চাকুরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।

আইনী জটিলতাও যৌন হয়রানি জারি রাখার অন্যতম সহায়ক। যেদেশে ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত হলে ভিক্টিম নারীটির ধর্ষনের আলামত প্রমানের জন্য জটিল মেডিকেল প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, ন্যায়বিচার পেতে বছরের পর বছর কোর্টের বারান্দায় ছুটে বেড়াতে হয় সেই দেশে অশ্লীল স্পর্শজনিত যৌন হয়রানির ঘটনা তো প্রমানই করাই কঠিন হবে। আবার এই বাস্তবতায় অশ্লীল বাক্যবান, কটুক্তি,  ইঙ্গিতপূর্ন কথা ও অঙ্গভঙ্গি, কুপ্রস্তাব ইত্যাদির বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা এবং অভিযুক্তের শাস্তি নিশ্চিত করাটা অসম্ভব প্রায়। আর তাই যৌন হয়রানি হলেও বেশিরভাগ নারী আইনের দ্বারস্থ হন না। যদিও সরকারিভাবে এই বিষয়ক হটলাইন চালু হয়েছে; তবে এখানেও রয়ে গেছে আইনি জটিলতা।  অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান কিংবা পরিবার থেকেও সহযোগিতা পায় না যৌন হয়রানির শিকার নারীটি। প্রতিষ্ঠান তার নিজ ইমেজ রক্ষার জন্য এ ধরণের অভিযোগগুলি ধামাচাপা দিয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে অভিযোগকারীকেই চাকুরি থেকে অব্যহতি দিয়ে দেওয়া হয় আর অভিযুক্ত থেকে যায় বহাল তবিয়তে।

পক্ষান্তরে, পরিবার সচ্ছল হলে ভিক্টিমকেই বলে, চাকুরি ছেড়ে দিতে। দরিদ্র পরিবারগুলি হয়তো চেপে যেতে বলে, মানিয়ে নিতে বলে। ‘চাকুরি করতে গেলে এমন অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়’ এই মানসিকতা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছে অনেক নারী। এতো প্রতিবন্ধকতার পরেও যদি কোনো নারী অভিযোগ আনে সেক্ষেত্রে অভিযুক্তের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান মাত্র পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা।

শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতিটি অফিসে নারীর সুরক্ষা বিবেচনায় “যৌন হয়রানি ও অশ্লীলতার” অভিযোগ বাক্স থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগ অফিসেই এমন কোনো অভিযোগ বাক্স নেই। আর যেসব অফিসে অভিযোগ বাক্স আছে, সেসব অভিযোগ বাক্সে কীভাবে অভিযোগ জানাতে হবে, কার বরাবর অভিযোগ করতে হবে, অভিযোগের পরে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি কোনো নীতি-নির্ধারনী নেই। অন্যদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে “যৌন হয়রানি অভিযোগ কমিটি” থাকতে হবে এবং কমিটির বেশিরভাগ প্রতিনিধি নারী হতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনারও বাস্তব প্রয়োগ নেই। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠান মালিকেরা এই বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কোনো এক আশ্চর্য জাদুবলে নারীর জন্য কর্মপরিবেশ বিষয়ে তাদের না আছে কোনো উদ্বেগ, না আছে কোনো উদ্যোগ, আর না আছে কোনো সদিচ্ছা। অভিযোগ বাক্স দূরে থাকুক এমন অনেক অফিস আছে যেখানে নারীদের জন্য আলাদা ওয়াশরুম পর্যন্ত নেই। ওয়াশরুম থাকলেও সেখানে ডাস্টবিন রাখা হয়না। নারী কর্মীদের জন্য জরুরি প্রয়োজনে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখা হয় এমন অফিস বাংলাদেশে আছে কিনা আমি জানি না। কিছু কিছু পোশাক কারখানা বাদে নারী নিরাপত্তাকর্মীও রাখা হয় না, অথচ এসব অফিসে কর্পোরেট এবং ফ্যাক্টরি লেভেলে অনেক নারী কাজ করছে। বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে গার্মেন্টসগুলিতে মানা হয় না গর্ভকালীন ছুটির আইনও, বরং গর্ভকালীন ছুটিতে যাওয়া নারী কর্মীদের বিনা নোটিশে ছাটাই করে দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলিতে মাসিকের প্রথম দিনগুলিতে আলাদা ছুটি বরাদ্দ থাকা কিংবা  গর্ভবস্থায় কাজের পাশাপাশি বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকা – এসব সুবিধা এদেশের কর্মজীবী নারীদের কাছে স্বপ্নের চাইতেও দুর্লভ।

এতো অন্তরায় থাকার পরও বর্তমানে দেশে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কম-বেশি নারীরা কাজ করছেন, এদের নিরাপত্তা না দিতে পারার এই লজ্জা রাষ্ট্রের, আইনের, প্রতিষ্ঠানের, মালিকপক্ষের, ব্যক্তির অর্থাৎ সবার। একজন কর্মজীবী নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে যদি সারাক্ষনই তটস্থ থাকতে হয়, যদি কর্মঘণ্টার আট ঘণ্টা মুখে তালা কানে তুলো দিয়ে কাজ করতে হয়, যদি যোগ্যতা থাকার পরেও বৈষম্যের শিকার হতে হয় তবে কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠানকে শতভাগ সার্ভিস দেওয়া সম্ভব হয় না স্বাভাবিকভাবেই। দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধিতে নারীর জন্য আদর্শ কর্ম পরিবেশ সব থেকে বড় নিয়ামক। নারী যদি কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করেন, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার না হন তবে তাদের দ্বারা আউটপুটও অনেক বেশি আসবে। আবার নারীরা নিরাপদে বাইরে কাজ করতে পারার পরিবেশ তৈরি হলে আরো  বেশি নারী বাইরে কাজ করতে আগ্রহী হবে। তাই নারীর জন্য আদর্শ কর্মপরিবেশ তৈরিতে সব পরিসরে আরো বেশি আলোচনা হওয়া উচিৎ, আরো বেশী উদ্যোগ নেওয়া এবং এর বাস্তবায়ন করা উচিৎ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *