পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে বেড়ে ওঠা এক নারীবাদী মেয়ের গল্প
প্রমুগ্ধা লিয়েনা চৌধুরী।। সেদিন বসে বসে ছোট এক বোনের ফর্ম ফিল আপ করছি অ্যাডমিশনের। তো করবার সময় তার মুখে শুনলাম, জার্নালিজম বা সাংবাদিকতা বিষয়টা সে লিস্টে দিতে চায় না, টিকলেও পড়বেনা- মা কঠিনভাবে বারণ করে দিয়েছে। হুট করে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি সময়ে ফিরে গেলাম। প্রচন্ড ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চারুকলায় পরীক্ষা দিতে পারি নাই, কারণ বাবার যুক্তি- চারুকলায় ভাত নাই, আর মেয়েদের জন্যে চারুকলা অত্যন্ত বিপদজনক!
এই যে ‘মেয়েদের জন্য’- কথাটা শুনতে হয়েছে জীবনে বহুবার। নারীবাদের প্রতি পুরুষদের ভেতর যে ভয়, সেটা আমি স্পষ্ট দেখেছি আমার পরিবারে, আমার শিক্ষক বাবা’র মধ্যে। রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন একজন পুরুষ হয়েও যিনি কার্যত নারীবাদবিদ্বেষী। একজন মেয়ে কেন সন্ধ্যা ৬টার পর বাইরে থাকবে, বিশেষত একজন ‘কুমারী ভদ্র ঘরের মেয়ে’! মাঝে মধ্যে নিজের ভেতর প্রশ্ন জাগে, এই দেশের রাস্তায় আমি কবে রাত ১২ টার পরে হাঁটতে পারবো!
আমি একজন পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে বেড়ে ওঠা নারীবাদী মেয়ে। আমার জন্য শেকল ভাঙাটা দুরূহ হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই লেখা দেখবার পর হয়ত আমাকে নারীবাদী নাস্তিক ডেকে বা ড্রাগ অ্যাডিক্ট ডেকে কোন একটা মেন্টাল অ্যাসাইলামে বা রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে পাঠায়ে দেবে আমার পরিবার। কিন্তু না লিখলে মনে শান্তি পাইতাসিনা বলেই লেখা।
আমার বাবা চান, আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের বড় মেয়ে হিসেবে নিজের পড়াশুনা শেষে সরকারি চাকরির চেষ্টা করি, একটা বিয়া করি, তাদের দেখভাল করি। মানে সাধারণত উন্নয়নশীল দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে যেমন চিত্র দেখা যায়। ইদানীং এই কোভিডের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বলে উনারা আশা করেন বাইরে না বেরিয়ে ঘরে বসে থাকি, অন্যান্য ‘ভদ্র ঘরের মেয়েদের’ মতন। অথচ আমি নিজের হাতখরচ নিজেই টুকটাক ছোটখাটো ব্যবসা’র মাধ্যমে চালাই বলে, আমাকে কাজেই বের হওয়া লাগতেসে। বাবা’র বড়ই দুশ্চিন্তা- আমি কী করছি, টাকা কই পাই, এই যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উনার নিয়ন্ত্রণ বলয়ের বাইরে চলে যাচ্ছি –এইটা উনি কোনভাবেই মানতে পারেন না।
এই যে নিয়ন্ত্রণের মনোভাব, ব্যাপারটা এমন না যে ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই উনি এমন করতো, (যদিও মুখে তাই বলেন)। যখন থেকে আমি বুঝতে শিখেছি আমার চিন্তাভাবনা আমার পরিবারের প্রত্যেকের থেকে একটু না, পুরোপুরি অন্যরকম, তখন থেকেই এই বলয় থেকে বেরুবার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমার নিজের প্রসঙ্গ টেনে আনবার কারণ, আমার আশপাশে প্রচুর মেয়েদের দেখছি ঠিক একই ভাবে সাফার করে যাচ্ছে, কিন্তু পারিবারিক বলয় থেকে বেরুনোর সাহস যোগাড় করতে পারছে না, বা বাবা-মা’র আদেশই শিরোধার্য এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এই কারণে কত শত ট্যুরে যে যায় নাই, পুরো বাংলাদেশ কেন পুরো দুনিয়া দেখাই বাকি রয়ে গেছে, কত লক্ষ আফসোস যে মনের মধ্যে কবর দেওয়া লাগতেসে তার কোন হিসাব নাই। এই বলয় ভেঙ্গে বের হয়া আসা খুবই জরুরি।
পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে নারীকে বাইর হয়ে চিন্তা করতে হবে, কাজ করতে হবে, নিজের ইচ্ছাপূরণ করতে হবে, করতে পারতেই হবে। এর জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি আরেকটা জিনিস প্রয়োজন, সেটা হল নারীর নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা।সমাজের লোকে কী ভাববে- এই কথার তোয়াক্কা না করে নিজের ভাল কীসে সেইটা ভাবেন, নিজের ইচ্ছা কীসে সেইটা ভাবেন। নিজে যদি এই পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আইডেন্টিফাই করে এর থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেন তাইলেই আপনি আমাদের আগামী প্রজন্মকে নারী ও পুরুষ সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলার শিক্ষা দিতে পারবেন, তার আগে নয়।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]