November 21, 2024
কলামফিচার ৩

ধর্ষণ, প্রেম, প্রতারণা এবং নারীবাদ

ক্যামেলিয়া আলম।। আমার কিশোর বয়সে একটা গল্প পড়েছিলাম, সম্ভবত শরৎচন্দ্রের কোনো গল্প। নামটাও মনে নেই। গল্পটা ছিল এমন যে, এক দম্পতি, বউটি স্বামীটির ভীষণ সেবা করে। সারাক্ষণই স্বামী কী খাবে, পরবে- এটা সেটা নিয়ে খুব মাত্রায় উদগ্রীব। পাড়া প্রতিবেশির কাছে এমন আদর্শ বউ দুইটি মেলা ভার। স্বামীর প্রতিদিন অফিস সেরে বাড়ি ফেরার সময়টুকুতে বউ এক মুহুর্তের জন্যও জানালা ছেড়ে কোথাও যায় না। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই স্বামীর সেবা। পায়ের জুতা খোলা থেকে শুরু করে খাওয়া অবধি অনড়। গল্পের বাঁকে গিয়ে দেখা গেল, বউটির এই পতিপ্রেম রীতিমতো বাতিকগ্রস্ততার পর্যায়ে। স্বামীর জীবন আস্তে আস্তে বন্দী হতে লাগলো তার সেবার জালে। স্বামীর দিন-রাত্রি, ভালো লাগা, মন্দ লাগা প্রতিটিতে বউটির ভয়ংকর নিয়ন্ত্রণ। বাহ্যিকভাবে প্রত্যেকে দেখে সেবা। একটা সময় কঠিন অসুখে পড়লো বউটি। সবাই দোষ দিলো পুরুষটারই। স্বামীটির অবহেলা সবার মুখে মুখে। তটস্থ স্বামী ভালো ডাক্তার দেখায়, নিয়মিত ওষুধ খাওয়ায়। কোনো সময়ে স্বামীটি সামান্য সময়ের জন্য বাইরে থেকে, অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে, গোপন শাস্তি হিসেবে বউটি নিজের ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। এভাবে দিনের পর দিন যেতে যেতে একসময় বউটি মারা যায়। আর চারপাশের সমাজের কাছে স্বামী প্রবরটির চরিত্রটি হয়ে থাকে প্রশ্নবিদ্ধ! সম্পর্কের মাঝে এই কায়দাটির নাম ইমোশনাল ব্লাকমেইল।

গল্পটা পড়লে অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠবেন। নারী নিপীড়ন এখনও যেখানে বিশাল এক সংখ্যায় সেখানে এমন আত্মঘাতী গল্প কেন আমি নারীবাদী কোন পোর্টালে লিখলাম। আর লিখে কী বোঝাতে চাইছি বা বলতে চাইছি?

নির্যাতনের এই চেহারাটা আমাদের খুব বেশি অচেনা না, কিন্তু নারীর উপর নির্যাতনের ভয়াবহ মাত্রার জন্য মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের বিপরীতমুখী এই বিষয়টি খুব একটা আলোচিত হয় না। এবার জানাই আরেকটি বিষয়। ধরে নেই, মেয়েটি সদ্য কলেজে পা দিলো, প্রেমে পড়লো তার শিক্ষকের। ধীরে ধীরে তাদের মাঝে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপিত হলো, ফলে মেয়েটির নির্ভরতা আর আস্থা একটু একটু করে বাড়তে থাকলো। এক পর্যায়ে পুরুষটি সেই সম্পর্ক থেকে সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে মেয়েটি নিয়ন্ত্রণ হারায় নিজের উপর। যেহেতু বিয়ে ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক আইনে অবৈধ, এ নিয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে এক মোক্ষম বিষয় ধরে এগুতে হবে পুরুষটির প্রতারণার শাস্তি দিতে। ফলে ধর্ষণের দায়ে ফেলে পুরুষটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়। এর ফলাফল নিয়ে কথা বলার আগে সামান্য কিছু আইনী তথ্য জানাই-

আইনে প্রেমের প্রতারণা বিষয়ক সরাসরি কোনো ধারা বা অনুচ্ছেদ নেই, পৃথিবীর কোনো দেশের আইনই খুঁটিনাটি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে না কিন্তু প্রচলিত আইন থেকে ব্যাখ্যার মাধ্যমেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হয়, কৌশল খাটাতে হয় যেটা আবার স্থান কাল ও অবস্থান ভেদে আলাদা হয়। আবার কখনও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা যা দেয়া হয় তা মেনে বিজ্ঞ উকিলের মামলা পরিচালনা করতে হয়। গুগলের ল হেল্প বিডি থেকে প্রাপ্ত কিছু তথ্য জানাচ্ছি-

# প্রেমের সম্পর্কে প্রতারণা করে অর্থ বা সম্পদ আত্মসাৎ
দন্ডবিধির ৪১৫-৪২০ ধারায় এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে। কোন ব্যক্তি অসৎ উদ্দেশ্যে কারো উপর প্রভাব বিস্তার করে তার কাছ থেকে কোন কিছু আদায় করে (তার সম্মতি নিয়ে করলেও) সেটা হবে প্রতারণা। এই প্রতারণার কারণে তার দন্ডবিধির ধারা ৪১৭ এর অধীনে এক বছরের কারাদন্ড/ অর্থদন্ড/ উভয়ই হতে পারে।

আবার এই একই ধরনের কাজ যদি কেউ মূল্যবান সম্পত্তির ক্ষেত্রে করে থাকে তবে তিনি দন্ডবিধির ৪২০ ধারা অনুসারে অপরাধী হবেন এবং যার সাজা হতে পারে সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং অর্থদন্ড।

# মিথ্যে পরিচয় দিয়ে প্রেম করে প্রতারণা করলে
কোন ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির নকল হিসেবে নিজেকে পরিচিত করলে এবং সেই পরিচয়ে প্রেম করে ধোঁকা দিলে বা প্রতারণা করলে দন্ডবিধি ৪১৬ ধারার অধীনে সে অপরাধ করেছে এবং এর জন্য তার তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড হতে পারে।
আর এই একই কাজ যদি কেউ ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে করেন (ফেসবুক, ফোন, ইন্টারনেট ইত্যাদির মাধ্যমে) তবে সে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮ এর ধারা ২৪ এবং সেক্ষেত্রে তারা ৫ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সাজা সাথে ৫ থেকে ১০ লক্ষ পর্যন্ত অর্থদন্ড পাবেন।

# বাগদানের পর প্রতারণা করলে
৪১৮ ধারা অনুসারে যদি বাগদানের পর একজন আরেকজনের আর্থিক ক্ষতি করে তবে তার ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড বা উভয়ই হতে পারে।

# অন্তরঙ্গ ছবি/ ভিডিও দিয়ে প্রতারণা ও ব্লাকমেইল করলে
অন্তরঙ্গ ছবি দিয়ে যদি ব্লাকমেইল করে, টাকা চায় বা হয়তো সম্পর্ক না রাখতে চাইলে সেসব ছবি বা ভিডিও দিয়ে যৌন সুবিধা নিতে চেষ্টা করে, পেনাল কোডের ৩৮৩ ধারার অধীনে এটি একটি অপরাধ যার সাজা আছে ৩৮৪ ধারায়; এখানে অপরাধীর ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হতে পারে, অন্যদিকে এমন ছবি/ভিডিও ধারণ ও ছড়ানোও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ধারা ৮ অনুসারে অপরাধ, যার সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর এবং ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।
তাছাড়া এটি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮ এর অধীনে কয়েকটি ধারার আওতায় পরে যেমন ; ধারা ২৫: হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য উপাত্ত প্রকাশ, ধারা ২৯; মানহানি কর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার; যার ফলস্বরূপ ঐ ব্যক্তিকে ৩- ৫ বছর পর্যন্ত সাজা পেতে হতে পারে সাথে ১০ লক্ষ পর্যন্ত টাকা অর্থদন্ড।

# বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে
দুজনই যদি প্রাপ্তবয়স্ক এবং দুজনেরই সম্মতি ছিল, সেক্ষেত্রে এটি আসলে অপরাধের মধ্যে পড়ে না। দেখা যায় অনেকে এটাকে ধর্ষণের মামলায় ফেলতে চেষ্টা করেন কিন্তু আদতে কোন লাভ হয় না বরং বাদী বিব্রত হবেন এবং মিথ্যা মামলার কারণে ফেঁসে যেতে পারেন। কেবল যদি কারও বয়স ১৪ বছর বা তার কম থাকে বা তার সম্মতি না থাকে তবে সেটা ধর্ষণ হবে এবং এক্ষেত্রে যাবজ্জীবন সাজা পর্যন্ত হতে পারে। দন্ডবিধির ধারা ৩৭৫, ৩৭৬।

# মিথ্যে বিয়ের অভিনয় করলে বা তা করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে
দন্ডবিধির ধারা ৪৯৩ তে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনা শ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন
প্রথম যে গল্পটি বললাম, এ ধরনের অপরাধকে যত না অপরাধ ভাবা হয় তার চেয়েও মানসিক অসুস্থতার বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়। যদিও সব ধরনের অপরাধই মানসিক অসুস্থতাজনিত কর্মকান্ড। সেক্ষেত্রে যে দেশ যত বেশি সুস্থ মানসিক বিকাশে ভূমিকা নেবে সেই দেশ তত কম অপরাধী পাবে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশ। যে কোন প্রবণতা জন্ম নেয় কোনো না কোনো কারণবশত, তবে তা বিকশিত হয় সমাজ কতটা সেই পরিবেশ বিকাশে উর্বর তার উপর।

মানসিক কিছু সাধারণ রোগ হচ্ছে-
প্যারানয়েড পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার এবং নার্সিসিস্ট পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার- এই তিনটির আচরণগত দিকগুলো খানিকটা কাছাকাছি, তিন ধরনের পার্সোনালিটিতে মিথ্যাবাদিতা, সন্দেহবাতিকতা, সারাক্ষণ নিজেকে সুপিরিয়র বা ইনফিরিয়র ভাবাসহ নানা ধরণের অবস্থান থাকে আর তার প্রতিক্রিয়ায় নানা মাত্রার প্রবণতার জন্ম দেয়। এই প্রবণতার আরেকটি বড় বিষয় এখানে নিজে দুর্বল হলে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খুব কৌশলে বা সূক্ষ্মভাবে অন্যের ক্ষতি সাধন যেমন করতে চেষ্টা করে, নিজে ক্ষমতাসীন হলে দুর্বলের উপর ভয়াবহ মাত্রায় নির্যাতন আর নিপীড়ন দিয়ে অপরাধগুলো সংঘটিত করে। ফলে এটি নির্মূল করার খুব সহজ উপায় নিজেকে স্পষ্টভাবে চেনা আর সেই অর্থে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। যা অনেক ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র সমাজ ব্যবস্থা, মূল্যবোধ আর দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই নেয়া হয়না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজ অন্ধভাবে ক্ষমতাসীনকে সমর্থন করে যায়। ফলে সমাজে এই ডিজঅর্ডার বাড়তে বাড়তে একসময় পুরোই বিশৃংখল হয়ে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার আর অবস্থাই থাকে না, রোগ দূর করা তো দূরের কথা।

প্রথম গল্পটির ঘটনার পেছনের কারণও পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার। এখন এ ব্যাপারগুলো দাম্পত্য জীবনের একান্ত সমস্যা হিসেবে চাপা দেয়া থাকে। কিন্তু এর ফলাফল হয় ভয়াবহ মাত্রায়। কেবল বর্তমান বিপর্যস্ততাই নয়, পরবর্তী জেনারেশনের মাঝেও এর বিস্তৃতি ছড়ায়। তাই দরকার প্রত্যেকের সচেতন হওয়া, অনেক বেশি কাউন্সেলিং সংগঠন গড়ে তোলা। তা না করে, যদি একবার পুরুষটির পরিবার টের পেয়ে যায় সেক্ষেত্রে নারীটির জীবনেও বড় বিপর্যয় নেমে আসে।

আর পরের যে বিষয়টি এমন যে, একটি অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে আরেকটি অপরাধের আশ্রয় নেয়া। শারীরিক সম্পর্কের জন্য প্রেম ও পরবর্তীতে প্রতারিত হওয়াটা যেমন প্রতারণা, এর শাস্তি নিশ্চিতের জন্য ধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত করাও আরেক ধরনের প্রতারণা। পরের অপরাধটি শুধুমাত্র সেই পুরুষটির জন্যই না বরং প্রকৃত ক্ষেত্রে যে নারীটি বা বাচ্চা ছেলে বা মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়, তাদেরও আইনের আশ্রয় পাওয়া, সমাজের সবার সহযোগিতা পাওয়া, সহানুভূতি পাওয়ার পথটি বিভ্রান্ত হয়ে যায়। এ ধরনের প্রতারণার ঘটনা যত বেশি ঘটতে থাকে, তত বেশি নারীর জীবন বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পড়ে। যেহেতু এখনও নারীর অবস্থান উল্লেখযোগ্য পরিবর্তিত হয়নি। আর তাছাড়া এমনিতেই তো ভিকটিমকে ন্যাক্কারজনক উপায়ে প্রমাণ করতে হয় ধর্ষণের সত্যাসত্যটি।

যদিও বর্তমানে ধর্ষণের বিচারে মৃত্যুদন্ড ছাড়াও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভিকটিমের পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও মেডিকেল পরীক্ষা করাতে হয়, ডি এন এ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। সংশ্লিষ্ট আইনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা থাকলেও সেখানে ধর্ষণের শিকার যে কোনো লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তা বা প্রতিবন্ধিতার বিচারের বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। ভুক্তভোগীর জন্য ধর্ষকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যাও নেই। ধর্ষণ মামলায় ভাষা, শ্রবণ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ, ভিকটিমের বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় কাউন্সেলিং সুবিধা, ভিকটিমের নিরাপত্তা, ডিএনএর নমুনা সংগ্রহের সময়সীমা নির্ধারণ ও রিপোর্ট প্রদানকারীর সাক্ষ্যের বিধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে আইনে কোন সুস্পষ্ট বিধান ও গাইডলাইন না থাকায় বিচার প্রক্রিয়া জটিল আকার ধারণ করে।

এখন সমাজে যদি এই উদাহরণগুলো একের পর এক ক্ষমতার রাজনীতি দিয়ে ঘটতে থাকে, অপরাধ কখনও সমাজ থেকে কমতে পারে না। খোলস বদলায় মাত্র। নারীর উপর বৈষম্য দূরের জাতীয় আইন ছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও আছে, রয়েছে জাতিসংঘের নারীর বৈষম্য দূর করার আলাদা ইউনিট, সনদ , নারীর বহুমাত্রিক উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ গড়েছে ফান্ড, গবেষণা সেল। কারণ নারীর উপর সহিংসতা, নির্যাতনের মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ আকারের যে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য বিশ্বমাঝে একধরনের ঐক্যবদ্ধ চেতনা গড়ে তোলা হচ্ছে। এখন যদি প্রতিহিংসাবশত, রাগে, ক্ষোভে কেউ এর সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে, সংকটে পড়া নারীর জন্য নিজেকে প্রমাণ করাটা আরও অবমাননাকর জায়গায় পৌঁছাবে।

নারীবাদী মুভমেন্টগুলো দিয়ে সামাজিক উন্নয়ন এতো হওয়ার পরেও এদেশে নারীবাদ/নারীবাদী মানুষ উপহাসের স্বীকার হচ্ছে। নারীবাদীদের প্রতি ভীতি/ঘৃণা তৈরি হচ্ছে। কেননা নারীবাদকে দিয়ে নারীর মানবিক জীবন নিশ্চিত করতে যে আইন হচ্ছে, যে সুযোগ তৈরি হচ্ছে তা দিয়ে প্রয়োজন বৈষম্য দূর করা, নতুন বৈষম্যের পথ রচনা না। পুরুষতন্ত্রের জন্ম পুরনো, শাখা প্রশাখা শেকড় বাকড় ভয়ংকর শক্তিশালী। তা থেকে বৈষম্যহীন, আধিপত্যমুক্ত সিস্টেম রচনা সহজ কোনো বিষয় না। এখন নীতি যদি হয় এমন, আধিপত্যের জোড়ে আমি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবো, তাহলে নতুন কাঠামো সৃষ্টি হবে কী করে? সেই ‘বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়া’র নীতি থেকেই তো এতো অরাজকতা।

আমরা যদি নির্যাতিত নারীটির পাশে আমাদের সঠিক অবস্থান রাখতে চাই, নির্যাতিত পুরুষটির পাশেও রাখতে হবে। হ্যাঁ, পুরুষতন্ত্রে পুরুষ থাকে অত্যন্ত সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে। আইন থাকলেও আইনের জটিল প্যাচ দিয়ে পুরুষটির অবস্থান বরাবরই জয়ের। এই সমাজে আইনের ক্ষেত্রে বিচার চাইতে গিয়ে হেনস্থা হয়নি এমন নারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। প্রত্যেকের কাছে জবাবদিহি, নোংরা প্রশ্নে জর্জরিত হতে হতে যেতে হয়। এখন এর সমাধান কী, নিজের অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটিয়ে, ক্ষমতার জোরে প্রতিপক্ষের এমন শাস্তি নিশ্চিত করা যে, সেই মানুষটি যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে? এ দিয়ে সবাই বেনিফিটেড হবে? সব প্রতারণার শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে?

আমি যে কোন উদ্যোগের বৃহত্তর ফলাফলে বিশ্বাসী। আধুনিক চীনের জনক দেং জিয়াও পেং অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে উক্তি দিয়েছিল ‘বিড়াল সাদা কি কালো, এটা বড় কথা নয়, বড় কথা বিড়াল ইঁদুর মারে কি না’। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, আধুনিকায়নের ও উন্নয়নের পথগুলো সব কয়টিই স্বচ্ছ নয়। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ব্যবস্থাপনায় আদৌ মুক্তি ঘটছে কিনা তা দেখবার বিষয়।

ধর্ষণ নিয়ে প্রচলিত যে আইন আছে তার মারপ্যাচ দিয়ে সঠিক বিচার পাওয়াটা কতটা যে কঠিন আর দীর্ঘমেয়াদী বিষয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। প্রত্যেকেই পূর্ণিমার মতোন ভাগ্যবান বা শক্তিশালী হতে পারেন না। ফলে এই অপরাধের সঠিক বিচার পায় দশভাগ। যারা ক্ষমতাবান থাকেন, জনমত গড়ে তুলতে পারেন, মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন। এবার আসি প্রেমের ক্ষেত্রে প্রতারণা। হ্যাঁ, এই প্রতারণার ক্ষেত্রে একজন নারী কত বহুমাত্রায় যে পড়ে তার ইয়ত্তা নেই। একবার আমার একজন বিদেশি বন্ধু আরেক লেখক বন্ধুর বহুজনের কাছে আপত্তিজনক ইনবক্স মেসেজ বা ভার্চুয়াল প্রেমের বিবরণ দেখে আতঁকে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, আমাদের দেশে এই অবস্থা করলে তো শাস্তি হয়ে যেতো এর। ফলে যেভাবে যতভাবেই এই বিষয়টির ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করিনা কেন, প্রতারণা প্রতারণাই। একসাথে থাকার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন দেখিয়ে কিছু সুবিধা আদায় করে বা যৌনসম্পর্ক ঘটিয়ে সম্পর্ক ভঙ্গ করার কোন সুস্পষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই। প্রতারণার মামলা থেকে আইনি ব্যাখ্যা দিয়ে মানবিক উপস্থাপনার মাধ্যমে এই বিষয়টি তোলা হয়তো যায়, কিন্তু তা কতটা শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে তা জানা নেই। হয়তো সামাজিকভাবে কিছুটা অসুবিধাজনক পরিস্থিতিতে পড়বে, এর বাইরে সেই পুরুষটির তেমন কোন ক্ষতি করা সম্ভব না। ফলে প্রয়োজন আইনের সংশোধন। যে কোন প্রতারণার দায়ে নারী/পুরুষ সে যেই হোক না কেন, তা যদি হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ, তাহলে কিছু হলেও কিন্তু সুবিধা পাবে প্রতারণার শিকার হওয়া মানুষটি। এখন সে যদি প্রচলিত কাঠামোর মতোই তাকে আইনের প্রতি চ্যালেঞ্জ না ছুড়ে দিয়ে ভিন্ন প্রতারণার কৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার নীতি নিতে থাকে, তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবে নারীরাই।

এদেশে নারীবাদ/নারীবাদী বর্তমানে উপহাসে পরিণত হচ্ছে, ভীত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ভেবে নেয়া হচ্ছে নারীবাদ মানেই পুরুষের উপর নারীর আধিপত্য বিস্তার, নারীর ক্ষমতায়ন মানেই পুরুষের উপর নারীর শক্তির প্রয়োগ। আমার একটা ঘটনা এখনও মনে আছে, লকডাউনের মাঝে একজন নারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা একজন বয়স্ক পুরুষকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছে, তা ভাইরাল হওয়ার পর ভয়ংকর এক অবস্থা দেখলাম সবার। নারীটি ভয়াবহ অন্যায় করেছেন, কারণ প্রশাসন তাকে বসিয়েছে জনসেবা নিশ্চিত করতে, কোনো শাস্তি প্রয়োগের অধিকারই তার থাকার কথা না, আবার তিনি তার প্রশাসনিক নিয়ম ভঙ্গ তো করেছেনই, সাথে পুরুষটির মানহানিও ঘটিয়েছেন ভাইরাল করে। সেই পুরুষটি মামলা করে দিলে তার ৭ থেকে ১৪ বছরের জেলও হয়ে যেতে পারতো!

এখন সে এই কাজটি কেন করেছেন, প্রশ্ন সেটাই। তিনি বেড়ে উঠেছেন পুরুষতন্ত্রের চর্চার মাঝ দিয়ে, এখানে ক্ষমতা পেলে তার প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণের বোধটুকু শিখেছেন, শেখেন নাই সেবা। ফলে  ভুলটি করেছেন। তবে তার এই অপরাধ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অধিকাংশ আক্রমণ কিন্তু এই মানসিকতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে হয়নি, হয়েছে ‘এতো বড় সাহস, নারী হয়ে পুরুষরে শাস্তি দেয়’। এই মানসিক বোধটা পুরোই পুরুষতান্ত্রিক। ফলে সেখানে অপরাধ কিন্তু কমলো না। অন্য কোন ক্ষমতাবান পুরুষ কিন্তু বয়স্ক অধস্তনের উপর গায়ে হাত চালিয়েই যাচ্ছে, মাসল পাওয়ার ব্যবহার করে আশেপাশে নিয়ন্ত্রণ করছে।

ক্ষমতার এই চেহারাকে পাল্টে দিতেই পারে সম্মিলিত চেষ্টা, পদক্ষেপ। সেজন্য দরকার নারীবাদের একনিষ্ঠ একটা চেহারা। যিনি বা যার প্রতিনিধিরা থাকবেন স্বচ্ছ। কারণ এই পর্যন্ত যতগুলো ইজম তৈরি হয়েছে- মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ- তার থেকে পৃথিবীর মানুষের মানবিক অবস্থান তৈরিতে বেশি ভূমিকা রেখেছে নারীবাদ। থার্ড জেন্ডারের অধিকার থেকে সমকামী অধিকার নিয়ে আজতক নারীবাদীরা ছাড়া কেউ ভূমিকা রাখতে পারেনি। নারীবাদ সমাজের প্রতি স্তরের সমস্যা চিহ্নিত করেছে, বৈষম্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। নির্যাতনের প্রকৃতি/ ধরণ/ বহুমাত্রিক রূপকে সামনে তুলে এনে স্পষ্ট করেছে, তা থেকে মুক্তির পথ বের করার রাস্তা বাৎলেছে। অথচ এদেশে নারীবাদের চর্চা ক্রমশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে, বিতর্কিত হচ্ছে নানা সুযোগসন্ধানী ঘটনা দিয়ে, যা এদেশে নারীবাদকেই না, সাধারণ নারীর জীবনও বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আরও কঠোর হচ্ছে, আরও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। অথচ বিংশ শতকে এ হওয়ার কথাই তো না, কিন্তু হচ্ছে। আমরা বদলাই, যে কোন অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হোক এটুকু নিয়েই আগে একসাথে কাজ করি, চলুন!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]