May 15, 2024
কলামফিচার ২

আপনি কি কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন?

মেহেরুন নূর রহমান ।। নিজের গল্প দিয়ে শুরু করি। তখন বয়স ২৩/২৪। বিবিএ শেষ সেমিস্টারে ইন্টার্নশিপ করতে ঢুকেছি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ। আমার যে সুপারভাইজার ছিলেন তিনি একজন কান্ট্রি ম্যানেজার। বেশ ভদ্র, স্মার্ট। আমার সাথে ব্যবহারও বেশ ভালো ছিল কিন্তু সবাই তার মত ছিলনা।  ওখানে পরিচয় হয়েছিল আরো কিছু উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে। একজন ছিল সবসময় টিপটপ, স্যুটেড বুটেড, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে হিন্দি গান গুনগুন করে গাইতে গাইতে চলাফেরা করতো। দেখা হলেই খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলতো। তার রুমে যেতে বলতো। বলাবাহুল্য তার রুমে সে একই বসতো। সেই লোকের কথা বলার ভঙ্গি, তাকানোতে কী যে ছিল, আমার খুব অস্বস্তি হতো। ওখানে কর্মরত নারী কলিগরা আমাকে নিষেধ করলো সে লোকের রুমে একা যেতে কারণ তার চরিত্র ভালো না, নারী সংক্রান্ত  অনেক বদনাম। আমিও তাকে এড়িয়ে চলতাম কিন্তু সেই লোক গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাইতো, নিজের প্রেম কাহিনী শোনানোর চেষ্টা করতো। অল্পবয়েসী আমি ঠিক বুঝতে পারতামনা কী করবো।

সেসময় আরো একজন উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হলো যে বলতো আমি নাকি তার মেয়ে কারণ তার কোন মেয়ে নাই। বেশ স্নেহ করতো। আমিও আমার কোনো সমস্যা বা কাজের জন্য তার কাছে যেতাম। ইন্টার্নির শেষ দিন, আমি তার রুমে গেলাম বিদায় নিতে। বের হয়ে আসবো তখন দরজা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আমাকে বললো তাকে চুমু দিতে। হতভম্ব আমার মুখ দেখে সেই লোক হাসতে হাসতে দরজা ছেড়ে দিয়ে বললো কেন মেয়ে বাবাকে আদর করে চুমু দিতে পারে না? তখনও বিষয়টি আমার মাথায় ঢোকেনি বা অনভিজ্ঞ আমার মগজ পুরুষদের এই কদর্য রূপটিকে চিনতে দিতে চাইছিল না। তার কদিন পরই সেই লোকের ফোন এলো, আমাকে তার বাসায় যেতে বললো। বললো তৎকালীন বিমান প্রতিমন্ত্রী তার বন্ধু, সেই প্রতিমন্ত্রী তার বাসায় আসবে, সাথে আরো কিছু বন্ধুবান্ধব, আমি গেলে আমার ভালো লাগবে এবং সেই বিমান প্রতিমন্ত্রী নাকি চাইলে আমাকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ অফিসার হিসেনে জবও দিয়ে দিতে পারবে। আমি বললাম আপনার স্ত্রী, ছেলেরা কি বাসায় আছে? অদ্ভুতভাবে হাসতে হাসতে লোকটি বলেছিল, ওরা থাকলে কি তোমাকে ডাকি? চলে আসো, অনেক মজা হবে আর আখেরে তোমার লাভই হবে। কাঁপা হাতে ফোন রেখে কতক্ষন যে কেঁদেছিলাম জানি না। পিতৃহীন আমি লোকটির মাঝে পিতার ছায়া দেখছিলাম। বাবা মারা যাবার পর আমাদের খানিক আর্থিক অসচ্ছলতার কথা সে জানতো, তাই চাকরির টোপ দিয়েছিল। মা ভাইবোন কাউকে একথা বলতে পারিনি। নিজেকে যে কি সস্তা আর নোংরা লাগছিল!

এবার এমবিএ ইন্টার্নশিপ। কাজ করছি বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। আমার যে সুপারভাইজার ছিল আইবিএ থেকে এমবিএ করা স্মার্ট, চৌকষ, চোস্ত ইংলিশ বলা, মধ্যতিরিশের একজন। এমবিএ’র রিপোর্ট তৈরি করতে গিয়ে আমাকে বেশ খানিকটা সময় তার সাথে কাজ করতে হয়েছিল। তো সেই সময় সেই লোক তার বৌয়ের গল্প করা শুরু করলো। বিষয়বস্তু তার বৌ তাকে ভালোবাসেনা। বৌ শুধু টাকা চেনে, নিজের ইচ্ছা মত চলে, নিজেকে নিয়েই শুধু  ব্যস্ত, তাকে কোনো সময় দেয় না, তাদের মধ্যে অন্তরঙ্গ কোনো সম্পর্ক নেই। এমনিতে হাসিখুশি থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে খুব একা। আবারো অনভিজ্ঞ আমি লোকটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। আহা দুঃখী ভেবে লোকটির প্রতি মায়া লাগা শুরু করলো। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথার ভেতর টিকটিক করতো লোকটি বিবাহিত।  এসব যৌন সুযোগসন্ধানীরা এতো ধুরন্ধর হয়, কথার জাদুতে আপনাকে ভুলিয়ে দেবে। তো সেই সময় ওই অফিসেই আমার ঘনিষ্টতা হয়েছিল আর্ট ডিরেক্টর এক সিনিয়র আপুর সাথে। তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একদিন আমাকে সাবধান করলেন। বললেন এই লোক আগেও এরকম অনেক কাজ করেছে। নতুন অল্পবয়েসী মেয়েরা আসলেই সে টার্গেট করে। বৌ নিয়ে সে ভালো আছে। বৌ ভালো জব করে। তাদের বছরখানেকের মেয়ে আছে। এতই যদি খারাপ হয় তাহলে বৌকে ছেড়ে দিক? তা তো করবে না, শুধু এদিক ওদিক মুখ ঢোকানো আর বৌ সংক্রান্ত মিথ্যা কথা বলে মেয়েদের বোকা বানিয়ে কব্জায় নেয়ার চেষ্টা। আমি সেই আপুকে বিশ্বাস করেছিলাম, কারণ আমি জানতাম উনি সঠিক। দ্রুত আমি দূরে সরে এসেছিলাম। এই কারণে রিপোর্ট লেখা নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। চরম অসহযোগিতা করেছিল। অনেক ঝামেলা করে রিপোর্ট শেষ করতে পেরেছিলাম।

যখন জবে ঢুকলম তখন আশেপাশে অনেক যৌন সুযোগসন্ধানীকে ঘুরঘুর করতে দেখেছি। ইনিয়ে বিনিয়ে কত গল্প, কত প্রশংসা। একজন ছিলেন যার কাছে যাবার আগে আমরা ওড়না ঠিক করে পরে নিতাম কারণ সে মুখ না, বুকের দিকে তাকিয়ে কথা বলতো। সিনিয়র পজিশনে আছেন এমন একজন ছিল যে কারণে অকারণে পিঠে হাত দিতো এবং তার হাত ঘুরে ফেরা করতো ব্রায়ের হুকের চারপাশে। এসব করার সময় মুখে কিন্তু অমায়িক হাসি। এছাড়া ডাবল মিনিং জোকস, ফিগার নিয়ে কমেন্টস এসব চলতো। কোনো মেয়ে লজ্জা পাচ্ছে দেখলে এদের উত্তেজনা আরো বাড়তো।

চাকরি করে এমন নারীরা প্রায় সবাই উপরের ঘটনাগুলোর সাথে নিজেকে রিলেট করতে পারবেন কারণ এরকম যৌন হয়রানির মুখে তাদের কম বা বেশি সবাইকে কখনো না কখনো পড়তে হয়েছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যৌন হয়রানকারীরা অফিসে আসা অল্প বয়েসী মেয়েদের টার্গেট করে। কখনো মিষ্টি কথা বলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে, কখনো চাকুরির উন্নতির টোপ দেয়, কখনো পাওয়ার প্রেসারের মাধ্যমে মেয়েদের নিজের কব্জায় আনার চেষ্টা করে। এসব পুরুষদের কাছে নারীর মেধার চেয়ে শরীর প্রধান্য পায়। নারীদের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধ নাই কারণ নারী শুধুই ভোগ্যপণ্য তাদের কাছে। এসব যৌন সুযোগসন্ধানীদের কোনো ভয় নেই। কারণ তারা জানে তাদের কর্মকাণ্ড ফাঁস হয়ে গেলেও তেমন কোনো বিপদ হবেনা। আমাদের দেশের অফিসগুলোর মানবসম্পদ বিভাগ সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোন পদক্ষেপ নেয় না বরং কোনো মেয়ে অভিযোগ করতে গেলে তারই চাকরি বিপদের মুখে পড়ে। বদনাম হয়, হুমকি ধামকি শুনতে হয়, তাই বহু মেয়ে মুখ বুঁজে থাকে আর বেহায়াগুলো নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করে যায়।

বাইরের দেশে কাজ করি বলে জানি, এখানকার ম্যানেজমেন্টের সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট এবং সেক্সচুয়াল অপর্চুনিস্টদের বিরুদ্ধে অবস্থান কত শক্ত তা সে লোক যে পজিশনেই থাকুক না কেন। একজন পুরুষ (কিংবা নারী) নোংরামী করার আগে দশবার ভাবে, ভয় পায়।

আসুন দেখি কর্মক্ষত্রে কী কী ধরনের যৌন হয়রানির মুখোমুখি আপনি হতে পারেন যা আপনাকে একজন যৌন সুযোগসন্ধানীকে চিনতে সাহায্য করবে।

– সেক্সিস্ট কমেন্টস। শারীরিক কাঠামো বা ফিগার নিয়ে যৌনতাভিত্তিক মন্তব্য করা
– যৌনতাভিত্তিক কৌতুক/ডাবল মিনিং কৌতুক বলা
– অতি আগ্রহ, অতি প্রশংসা, অযাচিত সাহায্য করতে চাওয়া। রোমান্টিক বা যৌন অভিজ্ঞতাসহ আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা
– অনুমতিবিহীন শারীরিক স্পর্শ। খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে অন্তরঙ্গভাবে কথা বলা
– প্রমোশন বা বেতন বৃদ্ধি বা বিদেশে যাবার লোভ দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক তৈরির ইচ্ছাপোষণ
– চাপ সৃষ্টি করে (চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া, প্রমোশন আটকে দেয়া, বেতন বৃদ্ধি না করা) যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা
– ইমোশনালি ফাঁদে ফেলে, মিথ্যা বলে, বোকা বানিয়ে যৌনসম্পর্ক করা বা করার চেষ্টা। জোর করে তাদের নিজস্ব যৌন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলা বা বলার চেষ্টা করা। কাজের বাইরে একা দেখা করার চেষ্টা
– পর্নোগ্রাফিক জিনিসপত্র দেখানো, বা পর্নোগ্রাফিক সিনেমা বা গান বা গল্প এই জাতীয় অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জোর করে কথা বলার চেষ্টা বা দেখানোর চেষ্টা

আপনার অনিচ্ছা বোঝার পরও যদি তারা না থামে, এবং উপরোক্ত আচরণগুলো করতে থাকে তবে সে একজন সেক্সচুয়াল অপর্চুনিষ্ট যে আপনাকে সেক্সচুয়ালি হ্যারাস করে যাচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে আপনি অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। বাইরের দেশে প্রমাণসাপেক্ষে যৌন হয়রানকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন  ব্যবস্থা নেয়া যায় কিন্তু আমাদের দেশে এসব ক্ষেত্রে সঠিক বিচার পাওয়া বেশ কঠিন।

তাই মেয়েরা সচেতন হন, আওয়াজ তুলুন। আপনার সমস্যা সমাধানে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারলে নিচের কাজগুলো করুন।

– প্রমাণ সংগ্রহ করুন, হতে পারে সেটা স্ক্রিনশট, ভিডিও না অডিও রেকর্ডিং
– নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকুন। এসব যৌন হয়রানকারীদের কাছ থেকে পারতপক্ষে কোনো সাহায্য নেবেন না। এদের যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন
– আপনার সহকর্মীদের ইনফর্ম করুন। পারলে সমমনাদের নিয়ে একটি গ্ৰুপ তৈরি করুন
– মিষ্টি কথায় সহজে ভুলবেন না। আপনার বয়স হয়তো কম, আপনি অনভিজ্ঞ কিন্তু সঠিক-ভুলের সংজ্ঞা আমরা ছোটবেলা থেকে জানি। বিবাহিত কোনো পুরুষ বৌ সম্পর্কে নাঁকিকান্না শুরু করলে তাকে সহজে বিশ্বাস বন্ধ করুন। যাচাই করুন, সময় নিন। স্ত্রী নিয়ে অসুখি এমন কেউ আপনার সাথে আহ্লাদ করতে আসলে প্রথমেই তাকে বউকে ডিভোর্স দিয়ে ক্লিন হয়ে আপনার কাছে আসতে  বলুন
– সেক্সিস্ট কমেন্টস বা কৌতুকে অংশগ্রহণ করবেন না। আপনার অভিব্যক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিন আপনি এসব পছন্দ করেন না। লজ্জা পাবেন না। আপনার লজ্জা, আপনার ব্রীড়া এদের আরো উৎসাহী করে তুলবে। মাথা উঁচু করুন, প্রয়োজনে সেই স্থান ত্যাগ করুন বা সিনিয়র কাউকে রিপোর্ট করুন
– অযাচিতভাবে কেউ গায়ে হাত দিলে প্রথমে ভদ্রভাবে হাত সরিয়ে দিন। তারপরও না শুনলে কঠিন ভাষায় না বলুন।
– সেক্সচুয়াল অ্যাডভান্সমেন্টে সহযোগিতা না করার জন্য যদি আপনার চাকুরি বিপদের মুখে পড়ে বা আপনার প্রমোশন আটকে যায় বা বেতন আটকে যায় তবে যাবতীয় প্রমাণ নিয়ে মানব সম্পদে রিপোর্ট করুন। অফিসে কলিগদের জানান, প্রয়োজনে আইনি লড়াইয়েও যেতে পারেন। জানি এসব বলা সহজ কিন্তু এছাড়া সত্যিকার অর্থেই এদের বিরুদ্ধে কিছু করা কঠিন। ভয় পেয়ে চুপ করে থাকলে তারা আপনাকে আরো বেশি পেয়ে বসবে তাই মুখ খুলতে হবে
– নিজের কাছে সৎ থাকা খুব জরুরি। উন্নতির স্বপ্ন আমাদের এগিয়ে নেয় কিন্তু তা যেন সঠিক উপায়ে আসে, সেটা বোঝা দরকার। নিজের ক্ষমতা এবং পরিশ্রমের উপর বিশ্বাস রাখুন। শর্টকাট উপায় খুঁজতে যাবেন না। অন্যের উপর ভর করে উপরে ওঠার মানসিকতা থেকে দূরে থাকবেন। অল্প পরিশ্রমে বেশি পাবার ইচ্ছা অনেক সময় যৌন সুযোগসন্ধানীদের কাছে নিজেকে সহজলভ্য করে তোলে।

আমি বিশ্বাস করি মেয়েরা যদি আরো বেশি সচেতন আর সাহসী হয় তবে এ অবস্থার উন্নতি হবে। মেয়েরা আরো বেশি তেজস্বী হোক। নারীকল্যাণ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে আরো কঠিন অবস্থান নিক, জোর আন্দোলন করুক। প্রতিটি সংস্থায় যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” পলিসি চালু হোক এবং সঠিক প্রয়োগ হোক। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে তৈরি একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম এই ইস্যুর উপর। ভালো লাগলো। এভাবে এ ব্যাপারে আরো কথাবার্তা হোক, আলোচনা হোক, সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি পাক এই আশা করি। পুরুষসহ সকলের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, আমার সবাই আরো একটু বেশি সৎ হই, মেয়েদের জন্য একটি সুস্থ কাজের পরিবেশ তৈরি করি যাতে প্রতিটা মেয়ে নিজের যোগ্যতায় পুরুষদের পাশাপাশি সামনে এগিয়ে যেতে পারে নির্বিঘ্নে – এই স্বপ্ন দেখি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *