May 15, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

সন্তানের জীবনে বাবা-মায়ের অধিকার কতটুকু?

তৌকির ইসলাম।। বাবা-মা এর প্রসঙ্গ আসলেই আমরা অনেক বেশি আবেগাক্রান্ত হয়ে যাই। বাবা-মা অবশ্যই আমাদের ভালোবাসেন। কিন্তু সন্তানের জীবনে বাবা-মা এর অধিকার পুরোটুকু নয়। আমি জানি এই কথায় অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। তা আপনি করতেই পারেন। সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলেই আপনি তার উপর সর্বময় অধিকার রাখতে পারেন না। বিষয়টি আমি একটু আমার মত করে ব্যাখ্যা করছি।

সন্তান জন্মের পর সে বড় হওয়া পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট সময় বাবা-মা সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটি সত্য। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে বাবা-মায়েরা আমৃত্যু সিদ্ধান্ত দিতে ভালোবাসেন। আর যদি কোনো সন্তান তাদের সিদ্ধান্ত না জানতে চায় তবে সেই সন্তান বাবা-মায়ের চোখে দুষ্ট সন্তান।

আমার মতে সন্তান কৈশোর পার হয়ে যৌবনে উপনীত হলে সন্তানের ব্যক্তিগত জীবনে বাবা-মায়ের অধিকার দাবি করা উচিত নয়। বাবা-মা তার মতামতটুকু শেয়ার করতে পারেন, কিন্তু চাপিয়ে দিতে পারেন না। বাবা-মায়েদের অধিকারবোধ আবার সন্তানের লিঙ্গের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে অনেক বেশি আগ্রহী। কন্যা সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও বাবা-মা ঠিক করে দিতে চান সে কোথায় যাবে, সে কী পড়বে, এবং কী পরবে, সে কার সাথে কথা বলবে, সে কীভাবে ধর্ম পালন করবে। এটার একটা বড় কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। নারী স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেবে তা আমরা আজ অব্দি মানতেই পারি না।

আপনি ভাবছেন ছেলে সন্তান বুঝি বেঁচে গেছে? মোটেও নয়। ছেলে সন্তানের ব্যক্তিগত জীবনে, এমন কি বিয়ের পরের জীবনেও বাবা-মায়ের অনধিকার চর্চা বেশ চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে মায়েদের ভূমিকা। ছেলে এবং তার স্ত্রী হয়তো বাকবিতণ্ডায় আছে, সেখানে বিশেষ করে ছেলের মায়ের অনধিকার প্রবেশ, ছেলের বউ নিজে কোন সিদ্ধান্ত নেবে সেখানেও সেই একই অবস্থা। মূলত এই পুরো ব্যাপারটি দাঁড়িয়ে আছে সমাজের নীতিগত অবস্থানের উপর।

আপনি যখন সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে নারীপুরুষ না ভেবে মানুষ ভাবা শুরু করবেন তখন এই অনধিকার প্রবেশ কমাতে পারবেন। আর যদি পুরোপুরি নির্মূল করতে চান তবে সমাজের সাথে সাথে দরকার আমাদের বাবা-মায়ের মূল্যবোধগত অবস্থার পরিবর্তন। আমি একটু আমার বিষয় থেকে অফট্র্যাক-এ চলে এসেছি। এর কারণ হলো অনেক বাবা-মা সন্তানের জীবনে অধিকার খাটাতে চান সমাজ এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে। কিন্তু এটা হচ্ছে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এবং ধর্মান্ধতার একটা নিদর্শন। আপনি যদি একটু খেয়াল করেন দেখবেন যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা কন্যা সন্তানের স্বাধীনতা, সক্ষমতা, যোগ্যতা প্রত্যক্ষভাবে হজম করতে পারেন না, কেননা সমাজের ভয়, আর তাই ছেলের বউয়ের ক্ষেত্রেও তারা একই ধরণের অনধিকার চর্চা করে থাকেন।

ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটে অন্যভাবে। বাবা-মায়েরা খুবই পছন্দ করেন যে ছেলেরা সব কিছুতে আগে তাদের সিদ্ধান্ত নেবে, যা পুরোপুরি একটি অমানবিক ব্যাপার। কেননা এতে শুধু ছেলে নয় ছেলের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ ঝামেলায় পড়ে। সন্তানের যতটুকু কর্তব্য বাবা-মায়ের প্রতি তা অবশ্যই পালনীয় কিন্তু তার বাইরে সন্তানের জীবনে অধিকার খাটানোর অধিকার বাবা-মায়ের থাকে কি? সন্তান নিজে শেয়ার করলে হয়তো থাকে, নতুবা থাকার কোন প্রশ্নই হয়তো থাকে না।

বাবা-মায়ের এই অনধিকার প্রবেশের কারণে ছেলেদের চেয়ে কন্যা সন্তানেরা অনেক বেশি ভুক্তভোগী হয়। ডিভোর্স নেবে? বাবা-মার বাঁধা। ডিভোর্স নিয়ে সিঙ্গেল হবে? মা হবে বাবা-মার বাঁধা। মেয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে কিছু করার? বাবা-মার বাঁধা। বাবা-মা ধরেই নেন যে তারা যা করছেন তা তাদের সন্তান, বিশেষ করে কন্যা সন্তানকে স্বর্গের সুখে ভাসিয়ে নিচ্ছে, যেটা একটা চরম মিথ্যে।

আমি ‘ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে’ লিখছি বলেই যে কন্যা সন্তানের কথা বারবার বলছি তা নয়, আমাদের সমাজে অনেক কন্যা সন্তান রয়েছেন যারা গোপনে কাঁদছেন প্রতিনিয়ত, যেন তার বাবা-মা কান্না না দেখে। অনেক ছেলে সন্তান হয়তো চানই না তার কোনো ব্যাপারে, তার পার্টনারের ব্যাপারে বাবা-মাকে ইনভলভ করতে। আর তাই হয়তো সমাজের চোখে অবাধ্য সন্তান হয়ে বাবা-মার থেকে দূরে আছেন। সন্তান, বিশেষ করে কন্যা সন্তান এবং ছেলে সন্তানের পার্টনারদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। কী হবে, কীভাবে হবে তা তাদেরকেই ভাবতে দিন। পৃথিবীর সকল বাবা-মায়ের প্রতি রইলো আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]