একে কি আপনি ব্যক্তিস্বাধীনতা বলবেন?
মেহেরুন নূর রহমান।। হেফাজতের এক নেতাকে নারীসহ হোটেলে আটক করা হয়েছে। নানাজন নানা মতবাদ দিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলছেন, কেউ কেউ ওই নেতাকে তুলোধুনো করছেন যেহেতু সে নারী-পুরুষের মেলামেশের ব্যাপারে নানা সময় নানা ফতোয়া জারি করেছে, এবং ধর্মের নামে সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করে গেছে ক্রমাগত। আমি এসব বিতর্কে না গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা ভাবছিলাম। নারীবাদে বিশ্বাসী বলে আমি স্বাতন্ত্রবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা এসবে কঠিনভাবে বিশ্বাস করি। ভাবছিলাম ব্যক্তি স্বাধীনতার সাথে দায়বদ্ধতার সম্পর্ক কতটুকু।
ইন্ডিভিজুয়ালিজ্যম বা স্বাতন্ত্রবাদ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা নারীবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট ফেমিনিজম বা স্বাতন্ত্রবাদী নারীবাদ, লিবার্টরিয়ান ফেমিনিজম বা উদারপন্থী নারীবাদের একটি অংশ। স্বাতন্ত্রবাদী নারীবাদ ব্যক্তিত্ববাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তিগত স্বায়ত্তশাসন, পছন্দ, সম্মতি, যে কোন লিঙ্গ বা যৌন পরিচয়ের মানুষের জন্য সমতা ইত্যাদি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রণয়নের কথা বলে ।
স্বাতন্ত্রবাদী নারীবাদ লিঙ্গ ভিত্তিক আইনি বৈষম্য এবং সামাজিক অসুবিধা, অসামঞ্জস্যতা দূর করার চেষ্টা করে। এই মতবাদ বিশ্বাস করে নিজের ইচ্ছেমত জীবন যাপন তোমার অধিকার। নিজের শরীর, সম্পত্তি, ইচ্ছা/অনিচ্ছা এসবের উপর তোমার মতামতই সর্বোচ্চ, রাষ্ট্র বা সমাজ তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
এ কারণেই নারীবাদ নারীদের নিজের জীবনের পুরো দায়িত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ নিতে উৎসাহিত করে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের শরীর সম্বন্ধীয় (বিবাহ, যৌনতা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ) যে কোন বিচারে নিজের রায়কে প্রধান্য দিতে অনুপ্রাণিত করে।
আমরা আমাদের বিভিন্ন লেখালেখিতেও স্বাতন্ত্রবাদ এর কথা বলি, ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলি। অনুরোধ করি নারীদের যেন তারা তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়। নিজের ইচ্ছা, পছন্দগুলোকে অন্যের জন্য বলি না দেয়। নিজের শরীর সম্পর্কে সে যেন সচেতন হয়। বিয়ে, সন্তান জন্মদান, জন্ম নিরোধ এবং যৌনতার ক্ষেত্রে তারা যেন নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। নারীবাদ শুধু নারী নয়, যে কোনো লিঙ্গের, এবং যে কোনো যৌন পরিচয় বহনকারী মানুষকে তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে, অন্যের ক্ষতি না করে নিজের মত জীবনযাপনে উৎসাহিত করে।
এখন কথা হলো আমরা কতটা স্বাতন্ত্রবাদী হবো এবং কতটা পারস্পরিক সমঝোতায় বিশ্বাস করবো? আমরা কি নিজেদের নিয়েই নিজেরা থাকবো, না পরিবারকেও প্রাধান্য দেবো? সন্তান প্রতিপালন কতটা গুরুত্ব বহন করবে আমাদের জীবনে? মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, অন্যের উপকারে আসা, ন্যায়-অন্যায় বোধ এগুলো যদি আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা/অনিচ্ছার সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবে আমরা কোনটা গ্রহণ করবো এবং কতটা নিজের জীবনে প্রতিফলিত করবো? যদি অন্যের কথা ভেবে নিজে ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে কম্প্রোমাইজ করি, তবে কি তা ব্যক্তিস্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্রবাদের বিপক্ষে যেতে পারে?
আমার ভয় হয় অনেক সময় ব্যক্তিস্বাধীনতা না আবার স্বেচ্ছাচারিতায় গিয়ে ঠেকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি চূড়ান্ত স্বাতন্ত্রবাদ অনেক সময় বিচ্ছিন্নতা, পারিবারিক অস্থিতিশীলতা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে লালনপালনের ব্যর্থতায় গিয়ে ঠেকতে পারে। একথা শুনে অনেকেরই রাগ হতে পারে, ভাবতে পারেন পরিবার, সামাজিক দায়দায়িত্ব, শিশুপালন এসব কি নারী শোষনের হাতিয়ার নয়? এর বেড়াজালে পরে নারীরা কি ঊনমানুষ হয়ে নেই? এসবের মাধ্যমেই কি নারীকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে না যুগের পর যুগ?
আপনার প্রতিটি অভিযোগ সত্যি।
তবে কথা হলো মানুষ যেহেতু আমরা, তাই কিছু দায়দায়িত্ব মানুষ বলেই আমাদের উপর বর্তায়। এবং সেটা নারী এবং পুরুষ এবং অন্যান্য যে কোনো লিঙ্গের মানুষের জন্য প্রযোজ্য। মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্ব থাকাটা খুব জরুরি।
আপনি যদি বিয়ের সম্পর্কে না যেতে চান, ভালো কথা। কারো অধিকার নেই আপনাকে জোর করার। কিন্তু যদি হন আপনি বিবাহিত, তবে আপনি স্বইচ্ছায় এই সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এই সম্পর্কের ভেতরে কিছু দায়দায়িত্ব থাকে। নারী পুরুষ দুজনেই যেন দায়িত্বটুকু সমভাবে পালন করে এটা দেখা খুব জরুরি, এবং একপক্ষ আরেক পক্ষকে দমন করার চেষ্টা করলে প্রতিবাদ অপরিহার্য। বিবাহিত সম্পর্কে সততার প্রয়োজন কতটুকু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন বিবাহিত অবস্থায় আপনি অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়ে যদি ভাবেন এটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা তবে কিন্তু সমস্যা। না পোষালে বেরিয়ে আসুন সম্পর্ক থেকে কিংবা দু পক্ষ রাজি থাকলে ওপেন রিলেশনশিপেও যেতে পারেন, সে আপনার ইচ্ছা কিন্তু ইন্ডিভিজুয়ালিজ্যমের নামে আপনার সঙ্গীকে আপনি ঠকাতে পারেন না।
মা-বাবা বৃদ্ধ হয়েছে, তাদের দেখভাল করতে হয়। আপনার ক্লান্ত লাগে, আপনার ইচ্ছা হয় না বলে পিছিয়ে এসেছেন এবং আপনার বাবা-মা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এটা কিন্তু অন্যায় ইচ্ছা। এ ইচ্ছার প্রাধান্য দেয়া কতটুকু ঠিক আপনারা ভেবে দেখেবেন। পরিচিত এক মেয়ের গল্প জানি। নিজের কেরিয়ার নিয়ে এতো ব্যস্ত যে ক্যান্সারে আক্রান্ত মা’কে দেখতে যাবার সময় পায় না।
আপনি যদি সন্তান জন্ম না দেবার সিদ্ধান্ত নেন তবে কিছু বলার নেই। এ আপনার নিজের সিদ্ধান্ত এবং তাতে পূর্ন সমর্থণ থাকবে। কিন্তু যখন আপনি নিজের ইচ্ছায় সন্তানদের পৃথিবীতে এনেছেন, তখন তাদের যত্ন নেয়া, তাদের সুস্থভাবে বড় করা, সুশিক্ষা দেয়া, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন দেয়া আপানার কর্তব্য। কিন্তু আপনি নিজেকে নিয়ে এতো ব্যস্ত যে সে সময় পাচ্ছেন না। স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করছেন, তার প্রভাবে সন্তানদের বকছেন বা মারছেন। বিয়ে ভেঙে গেছে, নিজের সুখের কথা ভেবে সন্তানদের অবহেলা করে নানা সম্পর্কে জড়াচ্ছেন, সে সব সম্পর্কের টানাপোড়নে আবার নিজেই কষ্ট পাচ্ছেন, সেই সাথে কষ্ট দিচ্ছেন সন্তানদের। বোঝাতে গেলে বলছেন আমার নিজস্ব কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা নাই? সন্তান সন্তান করে নিজেকে শেষ করে দেবো? কথা সত্য, নিজের কথা আমাদের সবারই ভাবা উচিত। সমস্যা হলো নিজেকে এতো প্রাধান্য দিতে গিয়ে আপনি যে আপনার একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অবহেলা করছেন সেটা বুঝতে পারছেন না। আপনি নিজের সুখ, আনন্দ, দুঃখ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে এতোটাই মত্ত যে সন্তানদের উপর আপনার অবহেলার প্রভাব আপনার চোখে পড়ছেনা। অসুস্থ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসুন, প্রেম করুন, সব ঠিক আছে, সেই সাথে সন্তানদের প্রতিও সঠিক দায়িত্ব পালন বজায় রাখুন।
আমি খুব কাছ থেকে এমন বহু পরিবার দেখেছি। দেখেছি কত সহজে বাবা কিংবা মা’কে নিজের সুখের জন্য সন্তানদের অবহেলা করতে। একজন শিক্ষিত চাকুরীজীবী নারীর গল্প বলি। বিয়ের পর প্রেম করে নিন্মবিত্ত স্বামীকে ছেড়ে পয়সাওয়ালা এক লোকের কাছে চলে গিয়েছিল। নতুন স্বামী তার সন্তানদের পছন্দ করে না বলে স্বামীর কাছে ফেলে গেছে। সন্তানদের পিতা স্ত্রীর উপর প্রতিশোধ নিতে বাচ্চাগুলোকে ঠিকমত দেখভাল করতো না। বাচ্চা দুটি রীতিমত রাস্তাঘাটে পড়ে থাকতো। কয়েক বছর আগে একটা খবর পড়েছিলাম। লন্ডনে এর নারী তার ৫ আর ৭ বছরের শিশুদের ঘরে রেখে তিন দিনের জন্য বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে চলে গেছে। শিশুদের কান্নাকাটিতে প্রতিবেশিরা পুলিশকে কল করলে তারা এসে উদ্ধার করে। একে কি আপনি ব্যক্তিস্বাধীনতা বলবেন?
আমরা জেনে গেছি, শিশু লালন পালন শুধু মায়ের দায়িত্ব এটা একটি সামাজিক নির্মাণ, এর কোনও বিবর্তনীয় প্রয়োজনীয়তা নেই। পুরুষরাও চমৎকার শিশু পালন করতে পারে। মেয়েদের জন্য মাতৃত্বই একমাত্র নারীত্বের মাপকাঠি এ ধরণের বস্তাপচা ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া দরকার; তাই বলে কি আমরা মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষাকে ছোট করে দেখবো? সন্তান পালনকে ছোট করে দেখবো? কেউ যদি অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাবে বলে নিজের সম্ভাবনাময় চাকরি ছেড়ে মা’কে নিয়ে বিদেশে বিদেশে ঘোরাঘুরি করে, তাকে কি আমরা বোকা বলবো?
এমনি অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায় যেখানে আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং দায়বদ্ধতাকে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। আপনি নারীবাদে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন ব্যক্তিস্বাধীনতায় এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে। আপনি অন্য নারীর জন্য আদর্শ হতে পারেন আপনার কথায়, কাজে এবং জীবনাচারে। মনে রাখা দরকার আপনার কোনো কাজ ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা হয়ে যাচ্ছে না তো? ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের নামের আপনি জরুরি কোনো দায়িত্ব অবহেলা করছেন না তো, বা আপনার কোনো কাজে অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না তো?
নারীবাদ শুধু ব্যক্তিস্বাধীনতার কথাই বলে না, সেইসাথে বলে সহমর্মিতার কথা। বলে দায়িত্ববোধের কথা। শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, অন্যের জন্য ভাবার কথা বলে। তাইতো নারীবাদীরা নারীসহ সকল লিঙ্গের, সবরকম যৌন-পরিচয় বহনকারী মানুষের অধিকারের কথা বলে। শিশুসহ সকল বয়সের মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার কথা বলে। নারীবাদ আপনার ভেতর মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করতে সাহায্য করে, সাহায্য করে আরো বেশি মানবিক হতে।
আমার নিজের কাছে আমার স্বাধীনতা, নিজস্বতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া- পাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এবং আমি তা পূরণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আবার সেই সাথে সাথে শুধু নিজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে কাউকে পরোয়া না করে কোনো দায়-দায়িত্ব না নিয়ে স্বার্থপরের মত শুধু নিজের জন্য বেঁচে থাকতে চাই না।
নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মেলবন্ধন করে সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই আমার উদ্দেশ্য। এজন্য মাঝে মাঝে নিজের সাথে নিজের সমঝোতা করতে হয় বৈকি, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যেহেতু আমার নিজের তাই কোন দুঃখবোধ নেই। নিজেকে ছোট না করে, নিজের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে, নিজের স্বপ্নপূরণের সাথে সাথে সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্যেই আনন্দ খুঁজি। সহজ নয়, কিন্তু চেষ্টাটা অব্যাহত।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]