May 16, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমতার জন্যে ক্লারা জেটকিন

কাজী নাজিফা লামিনূর ।।

সময়টা ১৯৩২ সালের ৩০শে আগস্ট। সেদিন জার্মানিতে এক বক্তৃতার মঞ্চ থেকে ভেসে আসে শ্রমজীবী  নারীদের উদ্দেশ্যে জোরালো বানী – “মনে রেখো বোনেরা, ফ্যাসিবাদ চায় তোমাদের শুধু দাসী ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানাতে। সেই নারীযোদ্ধাদের কথা ভুলে যেও না যারা ফ্যাসিবাদীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে এবং কারাবরণ করেছে।”

একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ জানানোয় জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন কমরেড ক্লারা জেটকিন। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এই নারী সারাজীবন শ্রেণিবৈষম্য ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি ছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নারী অধিকার আন্দোলনের কমিউনিস্ট নেত্রী। বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও ক্লারা হয়ে ওঠেন এক সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র সমাজতন্ত্রই পারে নারীকে মুক্ত করতে।

ক্লারা জেটকিন ১৮৫৭ সালের ৫ই জুলাই জার্মানির সাক্সনি গ্রামে জন্ম নেন। তার বাবা গটফ্রেড আইজেনার ছিলেন স্কুল শিক্ষক ও দক্ষ বেহালা বাদক এবং মা জোসেকিন ভেইটালে আইজেনার ছিলেন প্রগতিশীল মানুষ। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন ক্লারা। স্কুল জীবনে বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়ার আগ্রহ ছিল তার। শৈশবে জেটকিন তার বাবার মতোই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, কিন্তু পরবর্তীতে সমাজতন্ত্রের চর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৮৭৪ সালে জার্মানির নারী আন্দোলন এবং শ্রম-আন্দোলন বিষয়ক সংগঠনগুলোর সাথে কাজ শুরু করেন তিনি।

সেসময় সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীরা অনেক পিছিয়ে ছিল। এমনকি নারীদের শিক্ষার অধিকার ও ভোটাধিকার তখনও নিশ্চিত হয়নি। এ বিষয়টি ভীষণভাবে নাড়া দেয় ক্লারাকে। নারীদের নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করার লক্ষ্যে তিনি ১৮৭৮ সালে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক দলে যোগ দেন। বিপ্লবী হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক অভাব-অভিযোগ, রোগ-ব্যাধি, বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। একদিকে সংসার অন্যদিকে দেশ ও জাতির মুক্তির আন্দোলন। তবে কোনো ক্ষেত্রেই দায়িত্বের অবহেলা করেননি এই মহিয়সী। লেখালেখির মাধ্যমে নারী সমাজ ও সমাজতন্ত্র বিনির্মানের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ক্লারা জেটকিন। বুদ্ধিবৃত্তিক ও  সৃজনশীল চর্চার মধ্যদিয়ে সমাজে প্রগতিশীল পরিবর্তন আনা যেতে পারে; এমন চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় তার পত্রিকা ‘ইকুয়ালিটি’ বা ‘সমতা’। জার্মানির নারী জাগরণের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখে এই পত্রিকা। এর মাধ্যমেই ক্লারা নারীদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করার পাশাপাশি ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে উদ্ভুদ্ধ করেন। সারা বিশ্বে নারীদেরকে এক সমাজতান্ত্রিক সমতার পৃথিবী গড়ে তোলা ও অধিকারের জন্য লড়াই করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে এই পত্রিকা। সেসময়ে নারীদের  ভোটাধিকার অর্জনের জন্যও সমানভাবে লড়েছেন এই সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব।

এরপর থেকে নারীবাদ নিয়ে নিয়মিত কাজ শুরু করেন। ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলনে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। আজ বিশ্বব্যাপী যে নারী দিবস পালিত হয়, তার প্রস্তাব প্রথম তিনিই করেন। ১৯১১সালে জেটকিন ৮ই মার্চ’কে  আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব রাখেন। লিঙ্গ বিভাজন তৈরি করা এখানে উদ্দেশ্য ছিল না বরং সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা তুলে ধরা এবং একটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে সকল খেঁটে খাওয়া মানুষের মুক্তির সাথে নারীরমুক্তিও যে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সেই বার্তা ছড়িতে দিতে আজীবন লড়াই করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনো আন্দোলন করা যাবে না বলে তীব্র  নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ক্লারা জেটকিন এর প্রতিবাদ করেন এবং ১৯১৫ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারীদের নিয়ে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে নামেন।

পত্রিকায় সম্পাদনা করার সময় কমরেড লেনিনের সাক্ষাৎকার নেন জেটকিন। The Women’s Question – শিরোনামের ঐতিহাসিক এই সাক্ষাৎকারে  নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজ প্রগতির সংগ্রামে নারীর ভূমিকা, শ্রেণি সংগ্রাম এবং নারীমুক্তি এ সকল বিষয় তুলে আনেন তিনি। জেটকিন নারী অধিকার ও সমাজতন্ত্রের লড়াই এগিয়ে নিয়ে যেতে সমতালে কাজ করেছেন।

১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসের সদস্য ছিলেন। ১৯২১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্নের এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য পদে ছিলেন। পাশাপাশি  ১৯২৫ সালে জার্মান বাম সংগঠন Rote Hilfe বা ‘লাল সাহায্য’-এর সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। ১৯৩২ সালে প্রবীণ সদস্য হিসাবে রাইখস্ট্যাগের চেয়ারপারসন পদে নিযুক্ত ছিলেন ক্লারা। এডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসার পর পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। ধারণা করা হয় সেখানে ফ্যাসিবাদী শাসকদের অত্যাচারে ১৯৩৩ সালের ২০ জুন  মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন জেটকিন। মস্কোর ক্রেমলিনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

জীবনের চড়াই-উতরাই পেছনে ফেলে সমতার আদর্শে নিবেদিত প্রাণ ক্লারা জেটকিন; যিনি নির্যাতিত মানুষের কথা বলেছেন, সমতার কথা বলেছেন, উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন শ্রেণিবৈষম্য, নিশ্চিত করতে চেয়েছেন নারী অধিকার। একদিকে তিনি শ্রমিকদের মধ্যে দিনরাত একাকার করে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন অন্যদিকে পার্টি নিষিদ্ধ করে দেয়ায় দমন-পীড়ন সহ্য করেছেন, প্রতিকূল অবস্থায়ও নিজের আদর্শ থেকে পিছপা হননি। শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির সংগ্রামকে কীভাবে আরও অগ্রসর করা যায়, সমাজে নারীদের ন্যায্য অধিকারকে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং সকল বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি  সমতার সমাজ নির্মাণ করা যায় সেটিই ছিল তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নারীমুক্তি আন্দোলনের মহান এই পথিকৃৎ-কে সম্মান জানিয়ে ১৯৩৮ সালের ৮ই মার্চ ‘অর্ডার অব লেনিন’- এই মর্যাদাপূর্ণ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অদ্ভুত এক  ছন্দ ও সাবলীলতায় সারাবিশ্বে সমতার বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন এই মানুষটি। অবলীলায়  মানুষের সাথে মিশতে পারা, কথার মাধ্যমে যেকোনো গভীর বিষয়কে উপলব্ধিময় করে তোলার অসামান্য ক্ষমতা থাকায় জায়গা করে নিয়েছিলেন সকলের মনে। তাঁর কৃতিত্বই তাঁকে অমর করে রেখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *