September 20, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীবাদ, ধর্ম এবং কিছু ভাবনা

মাহমুদুল হাসান উৎস।। ধর্ম এবং নারীবাদের বিপরীতমুখী অবস্থানকে সমান্তরালে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। তার আগে যুক্তি এবং বাকস্বাধীনতার কথা বলাটা আবশ্যক। প্রসঙ্গত, মুতাজিলা মতবাদের উদাহরণ খুবই উৎকৃষ্ট। মুতাজিলারা মনে করতেন ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বরের অস্তিত্বের অংশ নয়। বরং, ধর্মগ্রন্থগুলো সংশোধনযোগ্য সৃষ্টি। তারা এ-ও মনে করতেন, মানুষের ভাগ্য ঈশ্বর নির্ধারণ করতে পারেন না। ঈশ্বরের প্রভাবের বাইরে গিয়েও মানুষজন নিজেদের ভাগ্য বা সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারে। যুক্তি এবং স্বাধীন চিন্তাধারা প্রয়োগ করে নিজেদের স্বাতন্ত্র রক্ষার্থে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্য তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মানে হচ্ছে, সেই প্রাচীনকালেই একদল লোক ধর্মের রিফর্মেশন-এর চেষ্টা করেছিলেন। এই দলের লোকেরা ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণের দিকে না গিয়ে ঈশ্বর এবং ধর্মকে অধিকতর সহনশীল করার চেষ্টা করেছিলেন।

“হেডস্কার্ফ অ্যান্ড হাইমেন” বইয়ের লেখক মোনা এলটাহাওয়ে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, I’m a muslim; I’m a feminist; I’m LGBTQ supporter; I’m here to confuse you.”

স্টেরিওটাইপ জিনিসগুলো সমাজে ভাইরাসের মতো সংক্রমিত হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশে নারীবাদ মানেই তসলিমা নাসরিনের নাস্তিকতা কিংবা ছেলেদের মতো খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা এবং রোকেয়ার বলা পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলে জারি করিয়াছে- এই উক্তিকে মনে করা হয়। আবার, নারীবাদ মানেই কপালে ইয়া বড় টিপ কিংবা বয়কাট চুল; জিন্স প্যান্ট কিংবা টি শার্ট পরা। আদতে, এই বিষয়গুলোর সাথে নারীবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে একটি জায়গায় নারীবাদের সাথে এর যোগসূত্র আছে। সেটি হচ্ছে, পোশাক পরার স্বাধীনতা। একজন নারী অথবা পুরুষ কোন্ পোশাকে কমফোর্ট ফিল করবে, সেটি যার যার ব্যক্তিগত বিষয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা হরণ করার সুযোগ নেই।

এদেশে নারীবাদী আন্দোলনে রোকেয়া কিংবা তসলিমাকে নিয়ে যতটা আলোচনা হয়- সেটাই কিন্তু এদেশীয় নারীবাদের সূচনা স্তম্ভ নয়। এক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার বন্ধু মাসুদা খাতুনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। মাসুদা খাতুন ছিলেন মুসলিম নারীবাদীদের একজন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। শুধু নারীবাদই নয়, তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য নিয়েও কাজ করেছেন। এদেশে সর্বপ্রথম এই মাসুদা খাতুনই পর্দা প্রথা ভেঙে সিনেমা, মঞ্চ নাটকসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বোরকা এবং হিজাব নিকাব না পরে যোগ দিতেন। ঐ সময়ের নারীদের অবস্থা কেমন ছিলো সেটা জানতে হলে রোকেয়ার “অবরোধবাসিনী” অবশ্যপাঠ্য বই। সেই ভয়ংকর অবস্থাতে মাসুদা খাতুন বারুদ হয়ে জ্বলে উঠেছিলেন। শেষ বয়সে এই মহীয়সী নারী পতিতাবৃত্তি পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামী ছিলেন।

মাসুদা খাতুনের সাথে আরও একজন বাঙালি মুসলিম নারীবাদীর নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি হচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা নওয়াব, যাকে আমরা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হিসেবে চিনি। নারীশিক্ষা প্রসারে তিনি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে রোকেয়া দারুণভাবে নওয়াব ফয়জুন্নেসা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই নারীবাদ বা নারীবাদী আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যে নতুন কোনো বিষয় নয়, বরং শতবছর পুরনো একটি টার্ম।

আমরা বুঝতেই পারছি, নারীবাদের লক্ষ্য এবং মূল মেসেজ এখনও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পৌঁছাতে পারেনি।ঠিক একারণেই নারীবাদবিরোধী সমাজের জন্ম হয়েছে; যারা কি না পদে পদে নারীকে অবজেক্টিফাই করছে। তাদের কাছে নারী মানে পণ্য এবং বস্তু বিশেষ।

নারীবাদ কায়েমের জন্যে স্টেরিওটাইপ বিষয়গুলোকে কঠিনভাবে আঘাত করতে হবে। বলা হয়, মুসলিম মেয়েরা  পিরিয়ডের সময় অশুচি হয়ে যায়, ধর্ম পালন করতে পারে না। হিন্দু মেয়েরা পূজো করতে পারে না, এমনকি অঞ্জলিও দিতে পারে না। যারা নারীকে অস্পৃশ্য করার জন্যে এই বাঁধাগুলো সৃষ্টি করেছে, তাদের স্পষ্ট যুক্তির মুখোমুখি করতে হবে। ইদানীংকালে “ইসলামিক নারীবাদ” নামক আলোচিত সমালোচিত বিষয়টি নিয়ে আমরা সবাই অবগত আছি। মোনা এলটাহাওয়ের মতো অন্যান্য মুসলিম নারীবাদীদের বক্তব্যও এরকম; যেমন, পিরিয়ড চলাকালে মেয়েরা মসজিদে গিয়ে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়বে।

এখন বলা হবে, এই কাজগুলিকে ধর্ম সমর্থণ করে কি না। এই জায়গায় এসে নারীবাদী আন্দোলন কি আমাদের প্রচলিত ধর্মগুলোকে বাতিল করে দেয় কিংবা ধর্মই কি নারীবাদী আন্দোলনকে বাতিল করে দেয়! আসলে ধর্ম আর নারীবাদকে একসাথে রাখতে হলে প্রয়োজন হবে ধর্মের রিফর্মেশন। মোনা এলটাহাওয়ে কিংবা মুসলিম নারীবাদীরা এই কাজটাই করতে চাচ্ছেন।

ধর্মে যেসব মিসোজিনিস্টিক কথাবার্তা আছে, সেগুলোকে তৎকালীন সময় দিয়ে বিবেচনা করা হবে, এবং বর্তমান সময়ের জন্যে নারী পুরুষের সমান অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হবে। কোন ধর্ম নারীকে বেশি অথবা কম সন্মান দিয়েছে তা বিবেচ্য নয়। সম্মান এবং অধিকার কেউ কাউকে দিতে পারে না। সম্মান এবং সমঅধিকার আমাদের প্রাপ্য। যেমন, মোনা এলটাহাওয়ে তার শরীরে ট্যাটু করেছেন। সেখানে আরবি হরফে “স্বাধীনতা” শব্দটি লেখা আছে।

শুধুমাত্র মোনা এলটাহাওয়েই নন, আমিনা ওয়াদুদ, নাদিয়া ইয়াসীন, মুসদাহ মুলিয়াসহ মালালা ইউসুফজাই এর নাম বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়। এরা প্রত্যেকেই স্টেরিওটাইপ জিনিসগুলো ভেঙে সমাজ এবং ধর্মের সংস্কার করতে কাজ করে চলেছেন।

মুসলিম নারীবাদীদের নীতি আর মোতাজিলা মতবাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে বেশ মিল আছে। ধর্মকে নারী ও পুরুষের জন্যে সমান এবং সহনশীল করতে মোনা এলটাহাওয়ের মতো নারীবাদীদের প্রস্তাবনা সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য।

এখন একদল প্রগতিশীল বলতে পারে, নারীবাদের সাথে ধর্মের কোনো যোগসূত্র নাই, তাই দুটো বিষয়কে সমান্তরালে আনবার মানে নেই। তাহলে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের মতো ইসলামিক দেশগুলোতে নারীবাদ কখনোই সহজ এবং স্বাভাবিক হতে পারবে না। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ম এবং ঈশ্বর মানুষের মাঝে খুবই প্রবলভাবে কাজ করে৷ আপনি আমি চাইলেই ধর্ম আর ঈশ্বরকে বাতিল করে দিতে পারবো না। যদি ধর্ম আর ঈশ্বরকে বাতিল করতে চান, তাহলে এই দুটো জায়গায় শক্তিশালী বিকল্প তৈরি করতে হবে। আপনি অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাছ থেকে তাদের বিশ্বাস ছিনিয়ে নেবেন কিন্তু তার বদলে কিছু দেবেন না, তা তো হয় না!

তাই আসুন, নারীবিদ্বেষী সমাজের বিরুদ্ধে মোনা এলটাহাওয়ের মতো করে বলি, “I’m a muslim/hindu; I’m a feminist; I’m LGBTQ supporter; I’m here to confuse you!”

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]