November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

পুরুষতান্ত্রিক যোগাযোগমাধ্যম ও সাহিত্য: কবে আসবে পরিবর্তন?

নন্দিতা সিনহা।। আমাদের বর্তমান জীবনব্যবস্থায় একটি বড়সড় রকমের জায়গা দখল করে রেখেছে আমাদের প্রচার ও যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। বলা যায় অবিচ্ছেদ্য এক প্রয়োজনীয়তা হিসেবেই এগুলো বিরাজমান। গণমাধ্যম ছাড়া একটা দিন কল্পনা করাও আজ কষ্টসাধ্য। আর ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এই মাধ্যমগুলোর উপকারিতার কথাও অনস্বীকার্য। এগুলো সমাজ, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যাবশ্যক হয়ে দাড়িয়েছে সেটাও সহজে অনুমেয়।

প্রচার মাধ্যমগুলো জনমনে নানারকম প্রভাব ফেলতে সক্ষম, আর তা খুব শক্তভাবেই। একটি দেশের প্রচার ও যোগাযোগমাধ্যম সেই দেশের ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনধারণে ব্যবহৃত ও প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে গন্য হয়। আর টিভি সিরিয়াল, নাটক, মুভিসিনেমা, বিভিন্ন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে ব্যাপক জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও  ইউটিউবও এক ধরণের প্রচার মাধ্যমের আওতায় পড়ে। শিক্ষা, বিনোদন ও যোগাযোগের জন্য এই মাধ্যমগুলোর ভালো দিক রয়েছে ঠিকই, কিন্তু একইসাথে এগুলোর ভেতরে শ্রেণি ও লিঙ্গ বৈষম্যের ছাপ সুস্পষ্ট। যেহেতু এসব কন্টেন্ট নির্মাতারা এই সমাজেরই অন্তর্ভুক্ত তাই এগুলোতে সমাজের সব দিক সচেতন বা অসচেতনভাবেও উঠে আসবে এটা স্বাভাবিকও। কিন্তু সেগুলো যখন দর্শকের মনে গভীর ও সূদুরপ্রসারি প্রভাব ফেলে তখন বিষয়টা কোনোভাবেই আর এগুলোকে সামান্য বিষয় বলে হেলা করার উপায় থাকে না।

সাম্প্রতিক সময়ে শহর কিংবা গ্রাম যেখানেই হোক টেলিভিশনগুলোতে একটা উল্লেখযোগ্য সময় দখল করে রেখেছে দেশি বিদেশি, বিশেষকরে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো। আর নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর, তরুন, তরুণী, যুবক, বৃদ্ধ থেকে সবস্তরের মানুষ এইসব সিরিয়ালের দর্শক।  এসব সিরিয়ালের বেশিরভাগই প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী চিন্তা চেতনার ধার ধারে না। বিভিন্ন সংস্কার ও কুসংস্কারও সেগুলোতে অতি সহজ ও সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখানো হয়। ফলে এসব সিরিয়ালের অন্ধভক্তদের তাদের সেই চিরাচরিত জানা ও দেখার দৃষ্টিকোণের বাইরে গিয়ে দেখার কোনো প্রবৃত্তিই কাজ করে না। বরং এগুলো প্রায়ই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের নানা অন্ধবিশ্বাস ও কুপ্রথাকে সঠিক বলে ভাবতে ও সেগুলোকে টিকিয়ে রাখতে ইন্ধন যোগায়।

সাধারণত বিনোদনমুখী মাধ্যমগুলোর বেশিরভাগ কন্টেন্টই পুরুষকেন্দ্রিক। সেগুলোতে পুরুষতান্ত্রিক অসম চিন্তা চেতনা ও মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট। মূল চরিত্র হিসেবে পুরুষদের আংশিক ও অসত্য জীবনাচরণ, আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনার কথাই উঠে আসে; নারীর চরিত্রটিতে এসবের কিছুই গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত করা হয় না। হলেও তা হয় ভাসা ভাসা। এগুলোতে পুরুষতান্ত্রিক চেতনার উপর নির্ভর করে বানানো যা কিছুই দেখানো হয় তার প্রায় সবটাই এক প্রশ্নাতীত মনোভাব নিয়ে দর্শকেরাও মেনে নেন। কারণ প্রকট শ্রেণি ও লিঙ্গ বৈষম্যেভরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ৯৮% মানুষই এই চেতনা ও নীতিতে বিশ্বাসী। আর যখন সেই চেতনা ও নীতিভিত্তিক কিছু তাদের সামনে আসে, সেটা বাস্তবজীবনে হোক বা বিনোদনমাধ্যমেই হোক, তখন সেটা স্বাভাবিকভাবেই নিয়ে থাকে দর্শকেরা।

গণমাধ্যমে কিছুটা আলাদা ধাচের ও সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ মুক্তচিন্তার কিছু কন্টেন্টও দেখা যায় অবশ্য। আর আশ্চর্য হলো, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দর্শকেরা সেগুলোর তীব্র সমালোচনা করে থাকেন প্রায় সব ক্ষেত্রেই। কারণ একটাই, সমাজের গোড়ামীপূর্ণ মনোভাবের সাথে সেগুলো সামঞ্জস্যহীন, সে কারণেই এমন কন্টেন্টে চরিত্রগুলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হলেও দর্শক সেটাকে নেতিবাচকভাবে নিয়ে থাকে। তারপরও হাতেগোনা কিছু কন্টেন্ট বানানো হচ্ছে, যা আশাপ্রদ। কিন্তু বেশিরভাগই এর থেকে অনেক দূরে। আর অধিকাংশ বিজ্ঞাপনে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখানো, ব্যবহার করা, পিতৃতান্ত্রিক বাধাধরা ছকে নারীকে উপস্থাপন করার রীতির কথা বলাই বাহুল্য।

ফেসবুক ও ইউটিউব এ সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ব্যবহৃত মাধ্যম। এগুলো দৈনন্দিন জীবনে অভাবনীয় পরিবর্তন ও উপকার সাধন করেছে। যার কারণে আজকের জীবন নিঃসন্দেহেই সহজতর। কিন্তু এখানেও সেই পিতৃতান্ত্রিক বৈষম্য বিদ্যমান। এখানে কিছু ভিডিও প্রায়ই চোখে পড়ে যেগুলোতে লৈঙ্গিক বৈষম্য, বর্ণবাদী মানসিকতা, পুরুষকেন্দ্রিকতা আর অলীক বিষয়বস্তু প্রবলভাবে উপস্থিত। আর আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলো এক শ্রেণির মানুষের কাছে ব্যপকভাবে সমাদৃত হয়ে থাকে।

কিছুদিন আগে এমনি এক ভিডিও দেখেছিলাম সেখানে স্পষ্টভাবে বোকাসোকা মেয়েদের অতুলনীয় বলে উপস্থাপন করে মেয়েদের জ্ঞানার্জনে অনাগ্রহী করা হচ্ছে। আর বিভিন্ন ভুলভ্রান্তিপূর্ণ তথ্যও থাকে এগুলোতে, যেগুলো অনেকেই সহজে বিশ্বাস করে নিজের ও অন্যের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর মানের বিচারে এগুলোর অবস্থাও খুবই খারাপ। এখনকার সময়ে প্রায় সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন থাকায় এখানে যে কেউ যে কোনো যোগ্যতা নিয়েই এসব কন্টেন্ট বানিয়ে ফেলতে পারে, যেগুলোর জনসম্মুখে আসার আগে মান যাচাই ও নির্ধারণ করার তেমন কেউ থাকে না। ফলে যেকোনো ধরনের চিন্তা জনসাধারণের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া এখন অনেক  সহজ।

সিনেমা জগতের তারকাদের মুখরোচক নানা খবর প্রকাশিত হয়ে থাকে প্রচারমাধ্যমে। কিন্তু সেখানেও দেখা যায়  পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও চেতনার প্রতিনিধিত্ব। সেই কবে কোথায় একবার দেখেছিলাম, বলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী প্রিয়াংকা চোপড়া বলেছিলেন, ‘একজন নারীর জীবনে একমাত্র সন্তান উৎপাদন ছাড়া আর কোনো কিছুতেই পুরুষের প্রয়োজন হয়না।’ আরেক অভিনেত্রী বিদ্যা বালান বলেছিলেন,’আমি সন্তান উৎপাদনের মেশিন নই।’ একবার দেখার পর আর দেখিনি এই তথ্যসম্বলিত কোনোকিছুই। কিন্তু শ্রাবন্তী নামক অভিনেত্রী তার নিজ জীবনে তৃতীয় বিয়ে ভেঙে চতুর্থ বিয়ে করতে যাচ্ছে সেটা প্রায় প্রতিটি প্রচারমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে!

আমাদের সাহিত্যজগতেও পুরুষতান্ত্রিকতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণ চোখে পড়ে। প্রায়ই মনে হয় এমনটা পরিকল্পিতভাবে করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আবহমান কাল থেকেই পুরুষপ্রধান সাহিত্য রচিত হয়েছে, সেগুলোতে নারীর জীবনকে অনেকটাই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বা কাছ থেকে সততার সাথে নিঁখুতভাবে দেখানো হয়নি। নারীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, অনুরাগ, চাহিদা ও স্বপ্নকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। কিছু নারীকেন্দ্রিক সাহিত্যেরও দেখা পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলোতে লেখক পরিকল্পিতভাবেই নারীকে শেষ পর্যন্ত চিরাচরিত দুর্বল অসহায় নারীতেই প্রতিপন্ন করেছেন।

আহমেদ ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’তে প্রতিভাবান, প্রভাবশালী, শিক্ষিত, স্বনির্ভর, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভাবশালী মহলে ওঠাবসা করা শামারোখকে শেষ পর্যন্ত এক অপদার্থ নির্যাতক স্বামীর হাতে জুটিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীপ্রধান উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরানী’তেও দেখা যায় ‘নিচু বংশে’র মেয়ে বলে সংসার থেকে বিতাড়িত দেবী চৌধুরানী তার নিজ দক্ষতা ও প্রতিভায় পাঁচ বছরের প্রচেষ্টায় গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন ও কুস্তিতে দুর্ধর্ষ শৌর্যশালী ক্ষমতার অধিকারিনী হয়েও যাকে কিনা শেষ পর্যন্ত ‘পতিকর্ম পতিধর্ম পতিপরমপূজ্য’ বলে তার শ্বশুড়বাড়িতে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে বাসনকোসন মেজে ঘরকন্না করা এক সাধারণ রমণীতে পর্যবসিত করা হয়েছে! সন্ধান করলে এমন আরও উদাহরণ পাওয়া দুষ্কর নয়। আর এগুলো রচনা ও নারী চরিত্রগুলোর এমন পরিণতি ঘটানোর পেছনের মূল কারণ নিসঃসন্দেহেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মনমানসিকতা। এমনটা না করে লেখক যদি নারীকে নারীর স্বোপার্জিত অবস্থানটা ধরে রাখাতে বদ্ধপরিকর থাকতেন, চরিত্রগুলোকে মুক্তির পথ দেখাতেন, তাহলে হয়তো সমাজে ছেয়ে থাকা অনেক অপবিশ্বাস ঝেড়ে ফেলা অনেকাংশেই সহজ হতো, আর নারীমুক্তিও তরান্বিত হতো।

প্রচারমাধ্যমে কাজ করা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা দিনশেষে আমাদের এই সমাজেরই অংশ, সুতরাং অভিনেতা-অভিনেত্রী ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট যারা থাকেন তাদের সবারই সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রতি একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। পরিবর্তন বিশ্বের অবধারিত নিয়ম, পরিবর্তনকে কেউই আটকে রাখতে পারে নি, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই পরিবর্তন হয়। আর অনেক পুরোনো সংস্কার থাকে যা ভেঙ্গে পরিবর্তনের সাথে মানুষকে তাল মিলিয়ে যেতে হয়। আর এক্ষেত্রে জনমনে সবচেয়ে বেশি চমৎকার ও সূদুরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে যোগাযোগমাধ্যমগুলো। সমাজের শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্ম ও বর্ণভিত্তিক বৈষম্যগুলোর অপসারনে এ মাধ্যমগুলো সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করুক এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]