মুনিয়ার মৃত্যু ও নারীকে ‘বেশ্যা’ প্রমাণে ভিক্টিম ব্লেমিং
কায়সুল খান।। গত ২৬ এপ্রিল, ২০২১ তারিখে ঢাকার গুলশানের একটি আলিশান ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়ার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে তদন্তে একে আত্মহত্যার ঘটনা বলে মনে করা হলেও এটি পরিকল্পিত হত্যা বলেও ধারণা করা হচ্ছে। এই ঘটনার সাথে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্পপতি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সংশ্লিষ্ট থাকার একাধিক প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। যা হোক, প্রকৃত ঘটনা নিশ্চয় পুলিশী তদন্তে বেরিয়ে আসবে। যেহেতু এটি এখন তদন্তাধীন বিষয় তাই এটি সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা শ্রেয়তর। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন তা হল ভিক্টিম ব্লেমিং।
বাংলাদেশে কোন নারীর সাথে যে কোন ধরণের অপরাধ সংঘটিত হলে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিক্টিম ব্লেমিং শুরু করে। যার ফলে তদন্ত প্রক্রিয়া তো প্রভাবিত হয় তো বটেই, একই সাথে ভিক্টিমের সামাজিক মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। এ ঘটনায় নিহত মুনিয়া একজন কলেজ পড়ুয়া টিনেজার। যে কোনভাবেই হোক তিনি একটি টক্সিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পিতা-মাতাহীন এই মেয়েটি খুব সম্ভবত পরিবার থেকেও যথেষ্ট তদারকি পান নি। ফলে একটি অস্বাভাবিক সম্পর্কে জড়িয়ে থেকে নিজের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন তিনি। সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অডিও ক্লিপের সূত্রে জানা যায়, যে পুরুষের সাথে তিনি সম্পর্ক স্থাপন করেন সে নানাভাবে মেয়েটিকে অপদস্ত করেছে। সামাজিক ও মানসিকভাবে হেয় করার চেষ্টা করেছে। অডিও ক্লিপ প্রচারিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের প্রথম সারির প্রায় সব পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন মিডিয়া বহু সময় ধরে অভিযুক্তের নাম পর্যন্ত নিতে সাহস করেনি। উল্টো এ ঘটনায় নিহত নারী ভিক্টিম মুনিয়া সম্পর্কে নানা মুখোরোচক সংবাদ পরিবেশন করেছে।
এরপর সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত সংবাদের নিচে মন্তব্য কলামে আমরা নানা জনের নানা মত দেখতে পাই। সেখানে ভিক্টিমকে অভিযুক্ত শিল্পপতি আনভীরের ‘রক্ষিতা’ হিসেবে মুনিয়াকে চিহ্নিত করা হয়। অস্বাভাবিক একটি সম্পর্কে দু’জন নর-নারী লিপ্ত থাকলেও, শুধুমাত্র ভিক্টিম মেয়েটির চরিত্রান্বেষণ শুরু হয় সর্বত্র। মানুষের হাজার কৌতূহল ভিক্টিমের ব্যাপারে। অভিযুক্তের ব্যাপারে সকলে নিঃস্পৃহ। এমন কি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদে ভিক্টিমের ছবি প্রকাশ ও অভিযুক্তের ছবি ব্লার করে দেওয়ার মত অন্যায় কাজও আমরা দেখতে পেয়েছি। যদিও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ পরে ক্ষমা প্রার্থনা করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছে।
বাংলাদেশ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানকার যে কোন প্রাপ্তবয়ষ্ক নাগরিক তার পছন্দ অনুযায়ী সম্পর্ক স্থাপনের অধিকার রাখেন। প্রেম-ভালোবাসা করার অধিকার রাখেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় মৌলবাদি গোষ্ঠীর উন্থানের সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে প্রেম-ভালোবাসার মত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। বিশেষত নারীকে অপরাধী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রেমের মত স্বর্গীয় সম্পর্ককে অন্যায় হিসেবে দেখানো, বিয়ের আগে প্রেম করলে জাহান্নামের ভয় দেখানোর মাধ্যমে ভালোবাসাহীন অসার পৃথিবীর প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। মুনিয়ার ঘটনায়ও একই চিত্র দেখা গিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ভিক্টিমকে লক্ষ্য করে নানা কদর্য ভাষার ছড়াছড়ি দেখা গিয়েছে। অর্ধশিক্ষিত ও কুশিক্ষিত সম্প্রদায় ভিক্টিমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। তাকে গোল্ড ডিগার, লোভী, দুশ্চরিত্রা, পাপী হিসেবে অভিহিত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা গিয়েছে। শুধুমাত্র মুনিয়ার ঘটনা নয় বরং বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছরে নারীর সাথে সংঘটিত প্রত্যেক অপরাধের ঘটনায় একই ধারা লক্ষ্য করা গিয়েছে। তনু, নুসরাত, ঢাবি শিক্ষার্থী, সিলেটের এমসি কলেজে সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনায় আমরা ভিক্টিম ব্লেমিংয়ের চিত্র দেখতে পাই।
বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করে ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক জড়িত। রাত বেরাতে একা নারী বাইরে বের হলে ধর্ষণ হবেই বলে মত দেয় বেশির ভাগ মানুষ। অথচ একজন মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষ যে কেউ তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরার স্বাধীনতা রাখে। দিনে-রাতে যে কোন সময় একা বা সঙ্গী সহ বাইরে বের হওয়ার অধিকার রাখেন। কোনভাবেই কেউ তাদের পোশাক বা বাইরে বের হওয়াকে ধর্ষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে না। বরং ধর্ষণের জন্য একমাত্র অভিযুক্ত পুরুষকেই দায়ী করা উচিত। পুরুষের আক্রমণের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্যবস্তু হলো নারী। নারীকে পুরুষরা মনে করে অবলা, অসূর্যস্পর্শা, পাপী। দুনিয়ার সমস্ত পাপের মূলে নারী রয়েছে বলে একটি ধারণা সমাজে দেখা যায়। যা অতি সাধারণকীকরণ ও নারীর প্রতি অন্যায়।
মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায়ও একই ধারা দৃশ্যমান। অথচ আমরা কি ভেবেছি ১৮/১৯ বছর বয়সী একটি মেয়ের মনস্তত্ব কেমন হতে পারে? এই বয়সে মানুষ আবেগে ভেসে বেড়ায়। তার চারপাশে আবিষ্কার করে নানা বিষয়। ফলে ভুলের সম্ভাবনাও বেশি থাকে। হ্যাঁ, মুনিয়ার কেইসে তার অভিভাবকদের দেখভালের অভাব ছিল। টিনেজার একটি মেয়ে একাকী লাখ টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাটে কীভাবে থাকে কিংবা কতটা নৈতিক সেই অবস্থান তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। নিশ্চিতভাবেই তার অভিভাবকদের ভুল ছিল এখানে। টিনেজার মুনিয়া যে সম্পর্কে ছিল সেখানেও তার বোঝাপড়ার অভাব ছিল। এই সম্পর্কে পুরুষটি ছিল শুধুই ভোক্তা। মুনিয়া ছিল ভিক্টিম। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে মুনিয়ার চরিত্র নিয়ে একপাক্ষিকভাবে প্রশ্ন তোলা শুরু হয়েছে তা ভীষণ আপত্তিকর ও অন্যায়।
আমরা ভিক্টিম ও অভিযুক্ত আসামির মধ্যকার অডিও ক্লিপ শুনেছি। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে অডিও ক্লিপটি আসল। সেখানে পুরুষটির মুখে প্রকাশ অযোগ্য নোংরা ভাষার ব্যবহার শুনেছি। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং সমাজের একটা বড় শ্রেণির পুরুষরা নারী সম্পর্কে এই ধরণের মন্তব্য করে থাকে, ধারণা পোশণ করে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ঘরেই যে নারী সম্পর্কে পুরুষদের মুখে আপত্তিকর এই ধরণের শব্দ শোনা যায় তা বলাই বাহুল্য। আমাদের শিল্প-সাহিত্য, নাটক-সিনেমায় তা বারবার ফুটে ওঠে।
নারীকে বেশ্যা প্রমাণে আমাদের সমাজের একটা শ্রেণির পুরুষ যে এনার্জি খরচ করে তা কোন উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করলে দেশ ও জাতি বরং উপকৃত হতো। তাই সমাজের সকলের প্রতি আহ্বান নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় ভিক্টিম ব্লেমিং না করে বরং অভিযুক্ত আসামির শাস্তি তরান্বিত করতে ভূমিকা রাখুন। তাতে আমরা একটি মানবিক ও অপরাধমুক্ত পৃথিবী পাবো। নারীর প্রতি সহিংসতামুক্ত একটি মানবিক পৃথিবীই আমাদের সকলের কাম্য।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]