December 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

এ সমাজে বাঁচতে হলে কেন পুরুষের অধীন হতে হয়?

প্রিয়া দেব।। আমাদের চারপাশটা আজকে উত্তপ্ত একজন তরুনীর আত্মহত্যার ঘটনায়। আমাদের ‘প্রগতিশীল সমাজ’ কোনো সাধারণ কারণে মেয়েটি আত্মহত্যা করলে তেমন মাথা ঘামাতো না, এখন মাথা ঘামাচ্ছে কারণ এখানে মেয়েটির চরিত্র নিয়ে নিজেদের মতো গল্প বানিয়ে নেওয়া যাবে, আর এ সমাজে একটি মেয়ে আর একটি পুরুষ জড়িত যেকোনো অপরাধ কিংবা ইস্যুতে সকলে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে মেয়েকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়ার সংস্কৃতি পুরনো না। এই সমাজ সুন্দর করে বলবে “মেয়েটির সাবধান হওয়া উচিত ছিল, পুরুষ মানুষ তো এমনই হয়!”

আপনি কনটেক্সট খেয়াল করুন, এখানে সবাই ধরেই নিয়েছে পুরুষের যত অপকর্ম, যত নোংরামো, যত ভুল- সেসব নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। কথা বলতে হবে নারী কেন সচেতন হলো না তা নিয়ে, যাবতীয় দোষ নারীকে দিয়ে আমরা “পুরুষ মানুষতো এমন হয়ই” বলে দায় সারবো। এসব দায় সারাতে আমার কোনো সমস্যা নেই, এসব মানুষকে আমি কখনো বদলাতে দেখিনি, চার বছরের বাচ্চা ধর্ষিত হলেও এরা বলেছে “বাচ্চাটি একা একা বাইরে কি করছিল?” এইসব দোষারোপ করতে বিশেষজ্ঞ মানুষের মধ্যে নারীদের সংখ্যাটাও নেহাত কম নেই। তারা খুব সিরিয়াস মুডে বলেন “আমরা নারীরা ঠিক হলে তো পুরুষেরা এসব করার সুযোগ পায় না”, আমি তাদের এসব সিরিয়াস চিন্তা দেখে জোরে জোরে হাসি। এরা কখনো সিস্টেমের গলদটা বুঝতেই পারেনি, এই তথাকথিত শিক্ষিতদের এরকম ধারনা দেখলে আজীবন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভুক্তভোগী যেকোনো মানুষই হাসবে।

আমি ছোটবেলা থেকেই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আর পাঁচটা মেয়ের মতোই বহু নোংরামির শিকার হয়েছি, এখনো হচ্ছি। এ সমাজের যেকোনো পুরুষ আমাকে প্রেম প্রস্তাব দেবে, নিয়মিত ফোন দিয়ে বিরক্ত করবে, ছবি ভাইরাল করার হুমকি দেবে; কিন্তু যখন দেখবে আমি তার প্রেম প্রস্তাবে রাজি হচ্ছি না তখন “মেয়েমানুষের এতো বাড়াবাড়ি ভালো না” “মেয়েমানুষকে শেষপর্যন্ত সংসারে হাড়িই  ঠেলতে হবে” মন্তব্যগুলো ছুড়ে দেবে।

আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, আমার ইচ্ছে হয় এসব মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেই। ছোটবেলা থেকে এই জিনিসগুলো শুনতে শুনতে আমার নিজের জন্য কষ্ট হয়। আমি একটা মানুষ, কিন্তু আমি কী করবো না করবো, আমি আজীবন কী করে কাটাবো সব এ সমাজ সেট করে দিয়েছে, এ সমাজের সব নোংরা মানুষ আমার সোজা মেরুদণ্ড ভাঙতে আসবে শুধুমাত্র আমি মেয়ে সে কারণে। এ সমাজ মনে করে মেয়েদের সোজা মেরুদণ্ড থাকা উচিত না।

এই উতক্ত্যকারীরা কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত থামে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো পুরুষ এখানে এসে নাক গলায়। যতক্ষণ আমি একজন মেয়ে হিসেবে প্রতিবাদ করছি, ততক্ষণ ওই নোংরা মানুষগুলো আমাকে খাটো করে দেখছে, কিন্তু যখনি কোনো পুরুষ তাদেরকে তাদের ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে তখন তাদের হয়তো টনক নড়ছে। কারণ এ সমাজে পুরুষই সব। আমার বড় ভাই, বাবা কিংবা অন্য কোনো পুরুষের সাহায্য ছাড়া আমি উতক্ত্যকারীদের থেকে মুক্তি পাই না। আমার তাদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এ সমাজের “নারীরা দুর্বল” এ বদ্ধমূল ধারণা থেকে আমি মুক্তি চাই। আমি ওই উতক্ত্যকারীদের থেকে মুক্তি চাই। কিন্তু সে পথটা সত্যি কঠিন।

আমি একজন সাধারণ মেয়ে, মন শক্ত আছে, জীবনে বহু নারীকে আদর্শ হিসেবে পেয়েছি, তাদের জন্য নারী হিসেবে আমার নিজের অধিকার বোঝার চেষ্টা করি। এতো কিছুর পরও এই সমাজে শান্তিতে বাঁচার জন্য পুরুষকেই লাগবে, কারণ আমার সমাজ এখনো আমাকে মানুষের দাম দেয় না। এখন আমি সেখান থেকে ওই বাচ্চা মেয়েটা, যে কিনা মাত্র দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তো তার কথা চিন্তা করি। তার মা বাবা নেই, ভাই বোনের আলাদা সংসার আছে, ওই একা মেয়েটার জন্য এ পৃথিবীটা কতোটা কঠিন ছিল সেটা ভাবি।

আজকে যারা ওই মেয়েটাকে দোষারোপ করছে, আমি ভাবি আজকে যদি ওই মেয়ে একা বাঁচার সিদ্ধান্ত নিতো তবে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আপনারা তাকে বাঁচতে দিতেন তো? অবিভাবকবিহীন এ মেয়েটাকে আপনারা নিজের জীবনে খুশি থাকতে দিতেন তো? আপনাদের তো একটা সেট করা মানদণ্ড আছে, যে মানদণ্ডে নারীকে পুরুষের উপরেই নির্ভর থাকতে হয়। একটা বাচ্চা মেয়ে এই সমাজে নিজের মেরুদণ্ড শক্ত করে বেঁচে থাকতে শিখে যেত এমনটা আমি ভাবি না। একজন প্রতাপশালী পুরুষ তার দিকে হাত বাড়ালে, সে নিজেকে রক্ষা করে থাকতে পারতো এমন মনোবল কিংবা পারিবারিক সাপোর্ট তার ছিল, তা আমি বিশ্বাস করিনা। আমি নিজে একটা মেয়ে হয়ে একা বাঁচার জন্য যখন ছোটখাটো সমস্যাতেই পড়ি এবং তার জন্য যখন দেখি এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গ্যাড়াকল আমাকে পুরুষের সাহায্যে ছাড়া বাঁচার সুযোগ দিচ্ছে না, তখন আমি বুঝতে পারি আজকের মৃত মেয়েটির বেঁচে থাকাটা কতোটা কঠিন ছিল।

আমাকে উতক্ত্যকারীদের কিন্তু কখনো কেউ দোষ দেয়নি, দোষ আমাকেই দেওয়া হয়েছে, আমাকে মাথা নামাতে বলা হয়েছে, আমাকে আওয়াজ থামাতে বলা হয়েছে। কারণ দোষ নাকি আমার।

এই দোষারোপের সংস্কৃতি বদলাবে কিনা আমি জানিনা, আমার আজকাল এসব নিয়ে ভাবতে কষ্ট হয়। কতো লাশের নীরব দাফন হবে, কিন্তু আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গণমাধ্যমে চিৎকার করে চরিত্রের সার্টিফিকেট দেবার সংস্কৃতি চালিয়ে যাবো। আমি খুব করে চাই আমাকে একটা পৃথিবী দেওয়া হোক, যেখানে আমাকে আমার সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো পুরুষের দ্বারস্থ না হলেও চলবে। সমাজের বাঁধাধরা সিস্টেমে একটা মেয়েকে বেঁচে থাকতে হলে “পুরুষের সাহায্য নিতেই হবে” এই জায়গাটিতে আমার আপত্তি আছে। পুরুষরা আমার জেদের জন্য উতক্ত করবে, পুরুষরা আমাকে মাথা নোয়ানোর জন্য থ্রেট দেবে আবার এ সমাজে আমাকে শান্তিতে বাঁচতে হলে তাদেরই সাহায্য নিতে হবে, কারণ এই সিস্টেম তারাই বানিয়েছে।

আমি শান্তিতে বেঁচে থাকার জন্য পাশে কোনো পুরুষকে চাই না, আমি আমার পাশে মানুষকে চাই। সে মানুষ নারী, পুরুষ কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের কোনো মানুষ হতে পারে। আজকে যে মেয়েটা মরলো, আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি তার মৃত্যুর পেছনে এই সমাজটাই দায়ী, যারা প্রতিটা পদক্ষেপে এটাই শিখিয়েছে যে জীবনে বাঁচতে হলে পুরুষের অধীন হয়েই বাঁচতে হবে। আজকে যে যে নারী পুরুষেরা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আদর্শ শিক্ষার্থী হয়ে এই মেয়েটার চরিত্র নিয়ে নোংরামো করে চরম সুখ পাচ্ছেন, সেই পাপেটরা একদিন নিজেরাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শিকার হবেন, আমি জানিনা তখনো তারা তাদের ভুলটা বুঝতে পারবেন কিনা, কিন্তু তাদের জন্য ভবিষ্যতেও আরো বহু মেয়ে মরবে, কারণ তারা পুরুষের ভুল ধরবেন না, কারণ তারা মনে করেন পুরুষরা তো এরকম করেই থাকে।

পুরুষরা এরকম করেই যাবে এবং আমাদের সমাজে আরো বহু প্রাণোচ্ছল তরুণী লাশ হয়ে যাবে। আমি জানিনা তারা কোনো দিন পুরুষকে ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারবেন কিনা, কিন্তু আমি মনেপ্রাণে চাই তারা বের হোক। পৃথিবীতে প্রতিটা নারী ভালো থাকুক, আর একটা নারীও যেনো ভিকটিম ব্লেমিংয়ের মতো নোংরা  ঘটনার শিকার না হয়।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]