November 2, 2024
কলামফিচার ৩

ভক্ষক পুরুষের গালি এবং ক্ষমতার বর্মে ঢাকা মুনিয়াদের লাশ

শাহাজাদী বেগম।। ঘটনাটা সংক্ষেপে এমন, শিল্পপতি সায়েম আনভীর সোবহান নিজের অর্ধেকের কম বয়সী  মুনিয়ার সাথে  দুই বছর আগে বিয়ের প্রলোভনে সম্পর্ক  তৈরি করে।  কয়েকমাস আগে  বনানীতে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে তারা বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সায়েমের মা জানতে পারলে মুনিয়াকে কুমিল্লায় বোনের বাসায় রেখে আসা হয়। সম্প্রতি সায়েম গুলশানে আরেকটি বাসা ভাড়া নেয় মুনিয়ার বোন-দুলাভাইয়ের নামে এবং সেখানে মুনিয়াকে রাখে। সায়েমের কড়া নির্দেশ- মুনিয়া এখানে আছে সেটা যেন কিছুতেই কেউ না জানে, তার মা জানতে পারলে মুনিয়াকে খুন করে ফেলবে। একদিন মুনিয়া বাড়িওয়ালীর বাসায় ইফতারের দাওয়াত খেতে গেছে। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত স্নেহে মুনিয়ার সাথে ছবি তুলেছে এবং ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে। সেই ছবি থেকে পিয়াসা নামে এক শুভাকাংখীর মাধ্যমে সায়েমের বাড়িতে জেনে যায় এবং তারই জের ধরে সায়েম মুনিয়ার সাথে রাগারাগি, গালাগালি অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে এবং মুনিয়া আত্মহত্যা করে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে আলামত জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়। এতবড় বিজনেস আইকনের বিরুদ্ধে মামলা হবে কিনা সেইসব নাটকের শেষে ‘আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার’ একটি মামলা করে মুনিয়ার বড় বোন।

মুনিয়া হত্যা বা প্ররোচিত আত্মহত্যার পরমুহুর্তেই গণমাধ্যমগুলো ধনমাধ্যমে পরিনত হয়ে গেল। এই বিত্তশালী ভাসুরের নাম গণমাধ্যম প্রকাশ করল না। অথচ তাদের রিপোর্টের বিপরীতে যে ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে সেখানে পুলিশ নিজে সায়েম আনভীর সোবহানের নাম বলছে। কিন্তু বেশিরভাগ চ্যানেল সেই নাম বলছে না এমনকি প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়াগুলোও না। অপরাধীর ছবি ব্লার করে ভিক্টিমের ছবি প্রাচার করলো। ধন সম্পদ, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার কাছে নিজেদের নীতি, দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে ধনমাধ্যমে রুপান্তরিত হল।

পরক্ষণেই তারা মুনিয়ার চরিত্র হননে উঠে পড়ে লাগলো। তার চৌদ্দ গুষ্টির ঠিকুজি বের করে ফেলল। মুনিয়া ‘রক্ষিতা’, বিবাহবহির্ভূত একজন পুরুষ তার শরীর ভোগ করার বিনিময়ে তার ভরন পোষন চালাত। রক্ষিতা শব্দটি ব্যবহার করার অধিকার তাদেরকে কে দিল?

সোজা উত্তর, পুরুষতন্ত্র।  এক সময়ের বাংলা সাহিত্যে শব্দটির অবাধ ব্যবহার ছিল। শব্দটি অতি পরিচিত। মেয়েটির বাবা  মুক্তিযোদ্ধা। অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই বিষয়টিকে সামনে এনে প্রমাণ করার চেষ্টা মুনিয়া কতটা খারাপ যে একজন মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে হয়েও…। ভিকটিমের বাড়ির ঠিকানা, বোনের বাড়ির ঠিকানা, কোন স্কুলে কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ত, কতটুকু বয়সে সে বাড়ি থেকে চলে গেছে, এই ধরণের  অসংখ্য খবর তারা দিনভর প্রকাশ করল। এগুলো সবই বহুদিনের লালিত গণমাধ্যমের  নীতি বিবির্জিত পুরুষতান্ত্রিক আচরন। আমরা চোখের সামনেই দেখলাম। কোনো নীতিমালাই কোন কাজে আসলো লা। কাজেই ভিক্টিম ব্লেমিং বাড়তে থাকলো এবং অপরাধীর অপরাধের বৈধতা দিতেই কাজে লাগানো হল।

সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় মুনিয়া আত্মহত্যার (কিংবা হত্যা) ঘটনায়। এরা আগেই সায়েমের নাম ছবি পরিচয় প্রকাশ করল। প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি জানালো এবং গণমাধ্যমের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করল। এতে দুই রকম ফল পাওয়া গেল। গণমাধ্যম একটু নড়েচড়ে বসল। সাধারন মানুষের একটা অংশ বিচার চেয়ে দাবি জানাল।  আরেকটি ফল হল ভিক্টিম ব্লেমিং বেড়ে গেল। মেয়েটা লোভী, উচ্চাভিলাষী, তার পরিবার আগেই মেয়েটাকে মেরে ফেলেছে, পরিবার জানতো তবুও কিছু করেনি ইত্যাদি। ভাবনার বিষয় হল একজন কামুক পুরুষ ও একজন উচ্চাভিলাষী তরুণীর  দুজনেই যদি দোষী হয় তাহলে শুধু মেয়েটিকে জীবন দিতে হল কেন?

নিম্ন আদালত আনভীর সোবহানের বিদেশ যাওয়াতে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। কিন্তু বিভিন্ন মাধ্যম বলছে সে কার্গো বিমানে দুবাইয়ে চলে গেছে। একটি টিভি রিপোর্ট করল যে বাংলা সিনেমার একজন নায়িকার সাথে সায়েম দুবাইতে একান্তে সময় কাটাচ্ছে। আবারো শুভাকাঙ্ক্ষী পিয়াসার দেওয়া তথ্য অনুসারে সায়েমের স্ত্রী সাবরিনা পরের দিনই দুবাই রওয়ানা হল। এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা জনৈক নায়িকা নিজে মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের লাশের উপর দিয়ে কীভাবে এই সময় এমন কাজ করতে পারল, সাবরিনাই বা কেমন ব্যক্তিত্বের মানুষ যে স্বামীর এইসব মেনে নিচ্ছে। সে নিজে নারী হয়ে মুনিয়ার পক্ষে দাঁড়িয়ে উদাহরণ তৈরি করতে পারে। পুরুষতন্ত্রের একটি অতি ব্যবহৃত ও ফলপ্রসু কৌশল হল নারীদের একজনের সাথে আরেকজনের দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখা, নারীদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে রাখা যেন নারীরা নিজেরাই নিজেদের চুল ছেঁড়াছেঁড়ি করে। এতে নারীরা একজোট হতে পারে না। তাতে পুরুষের নিজের ফায়দা লুটতে সুবিধা হয়।

সাম্প্রতিক মামুনুল হক ঘটনার জান্নাত আরার কথা মনে পড়ছে। জান্নাত এবং মুনিয়া দুজনেই বিবাহবহির্ভূত পুরুষের কাছ থেকে ভরন পোষন নেয়, দুজনেই বিবাহবহির্ভূত পুরুষের সাথে স্বামী-স্ত্রীর মত থাকে। একজনকে বলা হচ্ছে কথিত স্ত্রী আর আরেকজনকে বলা হচ্ছে রক্ষিতা। ভক্ষক মামুনুলের আছে ধর্মের বর্ম আর সায়েমের আছে টাকার বর্ম। পুরুষতন্ত্র এইসব বিবেচনায় নিজের সুবিধামত আচরন করে।

সাবরিনা, মুনিয়া, জনৈক নায়িকা, পিয়াসা, মুনিয়ার বড়বোন, সায়েমের মা- এরা প্রত্যেকেই নারী কিন্তু তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সাংঘর্ষিক। এসব দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে নারীরা নিজেরাই নিজেদের শত্রু। কিন্তু একবার ভাবুন তো এই নারীদেরকে এই অবস্থা্নে দাঁড় করিয়েছে কে? একজনই। সায়েম। এখানেও সেই পুরুষতন্ত্রেরই খেলা।

মুনিয়ার পরিবারের প্রসঙ্গে আসি। একটা অঘটন ঘটলেই আমরা সাথে সাথে পরিবারের উপর দোষ চাপাই, পারিবারিক মূল্যবোধ ও  শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। উচিত-অনুচিত বলে দেই সহজেই। কিন্তু ঐ পরিবারে ঘটে যাওয়া ঘটনা কিংবা প্রেক্ষিত আমাদের জানা নেই। পরিবার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কিন্তু সবকিছু নয়। পরিবারের ছাড়াও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের ভিতর দিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। দোষ চাপানোর আগে সেসব কেউ ভাবছে না। মুনিয়ার বখে যাওয়া কিংবা উচ্চাভীলাষী হবার পিছনে কি শুধু পরিবার দায়ী? অন্যভাবে ভাবলে মুনিয়ার পরিবার একটি সাধারণ পরিবার, তাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে আনভীর সোবহানের মতের বাইরে যাবে! ওর বোন যে মামলা করার সাহস করেছে এটাই অনেক বড় বিষয়।

মুনিয়ার ৬টি ডায়েরি পুলিশ জব্দ করেছে। পুলিশ বলছে সেগুলো ভর্তি মুনিয়ার হতাশা আর কষ্টের কথা। সায়েমের সাথে মুনিয়ার সর্বশেষ  টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়েছে। সেই কথোপকথনে সায়েমের গালাগালি আর মুনিয়ার কান্না জড়ানো অসহায়ত্ব শোনা গেছে। কথোপকথন অনুসারে সায়েম মুনিয়াকে চোর বলছে এবং মুনিয়া বারবারই বলছে টাকাটা সে নেয়নি। সায়েমের দুটো গালি এখানে উল্লেখ করতে চাই  ‘*..নকির বাচ্চা *..নকি’ আর “*..গীর বাচ্চা *..গী’।

মানুষ কেন আরেক জনকে গালি দেয়? একটাই উত্তর, প্রতিপক্ষকে  ছোট প্রমাণ করার জন্য সেটা যে কারণেই হোক। এই বিশেষ গালিগুলো কাকে দেয়? এবারও উত্তর একটাই- নারীকে। এগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই।

নারীকে কেন এইসব গালি দেয়? নারীকে আঘাত করতে চাইলে তার মন ভেঙ্গে দিতে হবে, তাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে হবে। আর সেটার জন্য মোক্ষম অস্ত্র হিসাবে নারীর চরিত্রে আঘাত করা, নারীকে চরিত্রহীন বলা।  পরুষতন্ত্রের আদি ও বহুল ব্যবহৃত আরেকটি কৌশল। নারীর চরিত্র নিয়ে গালি সবচেয়ে নিকৃষ্ট গালি। এগুলোর উৎপত্তির বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে ‘মাগী’ শব্দটির যে অর্থগুলো পাওয়া যায়-

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বঙ্গীয় শব্দকোষ:  অবজ্ঞাসূচক অর্থে নারী, সেবাদাসী
জ্ঞানেন্দ্র মোহন দাসের বাংলা ভাষার অভিধান: অসম্ভ্রমার্থে অধিক বয়স্কা স্ত্রীলোক
সুবল চন্দ্র মিতের সরল বাঙ্গালা অভিধান: অধিক বয়স্কা  স্ত্রী, নিন্দিতা স্ত্রী, বেশ্যা
কাজী আবদুল ওদুদ ব্যবহারিক শব্দকোষ: অধিক বয়স্কা স্ত্রী, বেশ্যা, উপপত্নী

উপরের সবখানেই ‘মাগী’কে নারীর অসম্মানসূচক অবস্থান হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিডিয়ার বলা  রক্ষিতা এবং সায়েমের বলা ‘খানকি ও মাগী’ সমার্থক শব্দ। একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। সবাই যা বোঝে তা হল- ‘এই নারীদের সাথে চাইলেই যেকোন পুরুষ বিয়ে ছাড়াই শুতে পারে।’ একটা বিষয়ে সকলে একমত হবে, সায়েম যখন মুনিয়াকে প্রথম প্রেমের প্রস্তাব দেয় তখন নিশ্চয় এই গালিগুলো ব্যবহার করেনি। তখন প্রেম, বিয়ের প্রলোভন, লাখ টাকার বাড়ি ভাড়া নেওয়া, ভরণপোষন চালানো এমন অনেক কিছুই করেছে সে। এটাই পুরুষতন্ত্র।

যতদিন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, আচরণ, সিস্টেমের পরিবর্তন না হবে ততদিন মুনিয়াদের শারীরিক মৃত্যুর আগেই  বারবার মরতে হবে। যতদিন মুনিয়ারা না বুঝবে যে, পুরুষ ‘*নকি’ বললেই তারা ‘*নকি’ হয়ে যায় না, ততদিন মুনিয়াদের মুক্তি নাই। আর এই মুনিয়ারা আমাদের বাইরের কেউ নয়, তারা এই সমাজেরই,  আমাদেরই মাঝে থাকা কেউ না কেউ।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]