প্রসঙ্গ: কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি
সৈয়দা ফেরদৌস আহমেদ।। কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির সংবাদ আমরা সারাবছর জুড়েই পাই। কখনো প্রকাশ্য আলোচনায় আসে তো কখনো বিভিন্ন এনজিও র গবেষণার মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছায়।কর্মক্ষেত্রে নারীর ওপর সহিংসতা ও হয়রানির নানা কারণ বারবার সনাক্ত করা হলেও অবস্থার দ্রুত কোন উন্নতি এখনো আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নাই। যদিও এই জন্য আইএলও কনভেনশন (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা সনদ) এর ১৯০ অনুস্বাক্ষর হওয়া অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ এবং এটার জন্য যে জোর দাবি, তা কেবলমাত্র নারীর প্রতি সহিংসতা অতীব মাত্রায় ছড়িয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে আসার পর বা নারী অধিকার দিবসগুলোতেই আলোচনায় ফোকাস করি, কিন্তু ব্যপারটিকে এর বাইরে এনেও জোর দাবি জানাতে হবে এবং পুনঃ পুনঃ আলোচনায় এনে সরকারকে তা জানাতে হবে সমাজের সব মহল থেকে।
আইএলও কনভেনশনের ১৯০ কে অনুস্বাক্ষর করার পাশাপাশি নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের সকল দিক নির্দেশনা মেনে চলার বাস্তব প্রতিফল ঘটাতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার বিষয়গুলো যদিও বেশির ভাগ সময়ই আমরা দেখতে পাই পোশাক শিল্পে নিয়োজিত কর্মী বা বিভিন্ন কলকারখানার কর্মীদের ওপর হয়, তবে এর বহু বাস্তব ভিন্ন চিত্র আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বড় বড় কর্পোরেট সেক্টরেও।
নারী পুরুষের সম্মিলিত শ্রম ও মেধায় মানবসভ্যতা গড়ে ওঠলেও শ্রম অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা অর্জনের জন্য নারীকে এখনো তাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হয় সর্বক্ষেত্রে। আর এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী শ্রমিককে নানাভাবে শোষণ, বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এসব কারণেই নারীরা পিছিয়ে পরে অনেক বেশি যা পরবর্তীতে তাকে আর্থসামাজিক সূচকের নিম্নস্তরে পৌঁছে দেয়। অথচ দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে অর্থনীতিকে বেগবান করতে।
কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি অশালীন আচরণ বন্ধ করাসহ এর পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করতে গেলে শ্রম আইন-২০০৬ এর সংশোধন করে সুনির্দিষ্ট ধারা সংযুক্ত করার পাশাপাশি আইএলও সনদ ১৯০টি অতিদ্রুত স্বাক্ষর করতে হবে। একই সাথে নারী শ্রমিকদেরকে আইন সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা এবং সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হলে কোথায় কীভাবে অভিযোগ দায়ের করবে সে সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হবে। এই পর্যায়ে আমাদের কাছে আসা বেশ কিছু কেস স্টাডিজের ছোট একটা সামারি যদি এখানে তুলে আনি যা আমরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ কাজ করার সময় পেয়েছি (বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ ও ক্ষেত্র বিশেষে সহায়তা, প্রজেক্ট সেতু) তার ৭০-৭৫% পোশাক কারখানা থেকে আসলেও ২০-২৫% পেতাম কর্পোরেট জগতের নারীদের কাছ থেকেও। এই ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে যারা পোশাক কারখানায় কাজ করেন তারা নিজের নাম, পেশা, পরিচয় কখনো লুকাতেন না, বা এটা লুকিয়ে রাখা হোক তাও কখনো চান নাই। বরং তারা যা চাইত তা হলো ন্যায্য বিচার।
অপরদিকে করপোরেট সেক্টর থেকে যেসব সহিংসতা ও নির্যাতনের কেস-কল পেতাম তার সবই ছিল তাদের পরিচয় দেয়া যাবে না, কিন্তু তাদের বিচার করে দিতে হবে! এই দিকটাতে তারা যে জিনিসটাকে ভয় পেত তা হলো সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া এবং পরিবার জানলে পরিবার থেকে চাকরি বাকরি বন্ধ করে দেয়ার চাপ, আবার অন্য দিকে চাকরি বন্ধ করলে পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি হিসেবে যে অসহায় জীবনের হাতছানি সেটারও ভয়। তবে সব ছাপিয়ে যা আমরা পেতাম তা ছিল তারা কেউই, হোক সে পোশাক শিল্পের নারী কর্মী বা কোনো আলিশান কর্পোরেট দুনিয়ার নারী, উভয়েই তারা আইনের সঠিক বিচার কোথায় পেতে হয় বা কোন জায়গায় অভিযোগ জানাতে হয় তা জানতো না। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই নারীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত চাকরিটা ছেড়ে দেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকেন যা আবার বাসায় থেকে পরিবার কতৃক নিগ্রহের শিকার হয়ে পুনরায় এর থেকে পরিত্রাণ চেয়েও কল আসত আমাদের কাছে।
শ্রমিক, শ্রমিকনেতা এবং মালিকদের যদি শ্রম আইনের বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে তাহলে এই হয়রানি, নিগ্রহ, সহিংসতা কিছুটা হলেও কমে আসবে। যদি এর সঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা প্রতিনিয়ত মনিটর করা হয়। কারণ কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে কোন রোডম্যাপ না থাকলে এই আচরণগুলো সবসময়ই চলতে থাকবে। কিন্তু যদি একজন শ্রমিক, শ্রমিক নেতা তাদের মানবিকবোধ, অধিকার ও মর্যাদার ব্যাপারে সচেতন থাকে তাহলে মালিক পক্ষও একটা সময় তাদের ব্যাপারে সচেতন হবে।
শিল্প কারখানাগুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যদি না করা হয় তাহলে শ্রম আইনের ধারা ৩৩২, যা জেন্ডার সংবেদনশীল নয় তা, কর্মক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া নানা ধরনের হয়রানী ও সহিংসতাকে আরো বাড়িয়ে দেবে। কারণ এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির পরিমাণও খুবই সামান্য যা মাত্র ২৫হাজার টাকা রাখা হয়েছে। অথচ যে নারীটি তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা বাদ দিয়ে তার ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সামনে আসে সে এই দিকগুলো বিবেচনা করে আসে যে সে সমাজের চোখ রাঙানোকে রুখতে পারবে। কিন্তু যখন দেখা যায় দোষী ব্যক্তির শাস্তির পরিমাণ অতীব নগন্য তখন একজন দিনমজুর, একজন শ্রমিক কী পায় আদতে? না থাকে সমাজ এবং পরিবারের কাছে তার সম্মান, না সে পায় তার সঠিক বিচার। এই জন্য আমাদের দেশে শ্রম আইনের পাশাপাশি উপযুক্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণের জন্য টর্ট ল-এর ব্যবহার আনতে হবে ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ ভিক্টিমকে যেকোনো একটা দিক দিয়ে অন্তত ন্যায় বিচার দিতে হবে। যেহেতু শ্রম আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ রয়েছে মাত্র ২৫ হাজার টাকা, তাই যাদের এই মনোভাবই থাকে যে নারীর ওপর সহিংসতা এবং হয়রানি (শারীরিক ও মানসিকভাবে) করবে তারা এই শাস্তিটাকে এবং ক্ষতিপূরণটাকে তুচ্ছতাচ্ছিলই করবে।
করোনার সময় নারীর ওপর তাদের নিজ গৃহ এবং কর্মক্ষেত্র উভয় জায়গাতেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও হয়রানির পরিমান বেড়েছে, এই ভয়াবহতা থেকে কাটিয়ে উঠতে আমাদের আইনের সংশোধন যেমনটা জরুরি তেমনি আইএলও এর সনদ ১৯০ এর অনুস্বাক্ষরও। তবে যেসব সংস্থা এবং এনজিও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে তাদের সকলের কাছ থেকে খসড়া প্রস্তাবনাগুলো নিয়ে যাচাই বাছাই করা ও সহিংসতার ঘটনাগুলো কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা মালিক সমিতি এবং শ্রমিক প্রত্যকের কাছ থেকেই শুনে নিয়ে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় নারী শ্রমিক তাদের মনে ভয়ভীতি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে কতটুকু কাজ করতে পারবে বা দিতে পারবে সেখানে প্রশ্ন থেকেই যায় অবধারিতভাবে।
যদিও কিছু কিছু পোশাক কারখানায় নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোকে শূন্য সহিষ্ণুতার দৃষ্টিতে দেখে অনেক সময় যৌন হয়রানিবিরোধী কমিটিও গঠন করে, তবে তা প্রতিটি সেক্টরে কার্যকর করতে হবে। যেখানেই নারী শ্রমিক রয়েছে সেখানেই এই সেলটি গঠন করতে হবে, তাকে/তাদেরকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে হবে ও দেয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। তাহলেই দেশের উন্নয় এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোর উন্নয়নে নারীরা আরো বেশি ভূমিকা রেখে কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রমোটিং ওয়ার্কার ওয়েল বিইং প্রজেক্টের একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিকের ভিতর ২ কোটি নারী শ্রমিক, অর্থাৎ যা মোট সংখ্যার ৩২%। আর এটা দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক বড় একটা অংশ, যার মান ধরে রাখতে আমাদের নারী শ্রমিকদের ওপর আমাদের নজর দিতে হবে। সেটা পোশাকসহ অন্য সব কলকারখানায় নিয়োজিত শ্রমিক হোক কিংবা উচ্চপদে থাকা কোনো নারীর জন্যই হোক। কারণ নারীর প্রতি যতদিন আমাদের সম্মান না বাড়বে ততদিন পর্যন্ত এই সহিংসতা, হয়রানি, নির্যাতন, নিগ্রহ চলতেই থাকবে, যা আমাদের সকলের জন্য লজ্জার ও অপমানের।
কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের নিজেদের নৈতিক মানবতাবোধের উন্নয়নের দিকেও নজর রাখতে হবে, যেন ছোটবেলায় পরিবার নামের যে প্রতিষ্ঠানে আমরা বড় হই সেখান থেকেই আমরা নারীকে সম্মান দিতে শিখি। তাহলেই আইনের প্রয়োগও সঠিক ও সুন্দভাবে বাস্তবায়ন করাটা সহজ হবে, এবং সুসভ্য নাগরিকরাই এর জন্য সোচ্চার হবেন।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]