মুনিয়ার বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল না
মেহেদী হাসান।।
এক.
হলিউডের মেয়েদের নিয়ে একটা ফিচার পড়েছিলাম অনেক আগে। কীভাবে নায়িকা হবার স্বপ্ন নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা মেয়েগুলো অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যায়। ওদের জায়গা হয় যৌনপল্লীতে। মারিও পুজোর ‘গড ফাদার’-এর শুরুও হচ্ছে এমনি একটা ঘটনা দিয়ে। নারী নিগ্রহের প্রতিকার পায় না দুর্বল মানুষ। বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত দুর্বৃত্তরা বেরিয়ে পড়ে মহানন্দে। বিকল্পে এ ঘটনার প্রতিকার চাইতে আসে এক গায়ক এক মাফিয়ার কাছে। পুলিশ, বিচারবিভাগ সব কিনে ফেলেছে ধনী পিতার কুলাঙ্গার সন্তানরা। তাই রাষ্ট্রীয় প্রতিকার নেই। প্রতিকারের আশায় সে এসেছে মাফিয়ার কাছে। এটা আসলে রাষ্ট্রের ব্যর্থতায় বিকল্প রাষ্ট্র গঠন যেন! আচ্ছা, সে কি ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা? আমি জানি না, কারো কাছে শুনেছিলাম হয়তো। হয়তো আসলেই ফ্রাঙ্কের আদলে গড়ে ওঠা এ চরিত্র দিয়ে আমেরিকার মাফিয়া জগতের ভেতরে প্রবেশ করেন পুজো। কিংবা হলিউডের উন্নত আর জৌলুশপূর্ণ জীবনের আশায় ছুটে আসা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে কাস্টিং কাউচের এর শিকার হয়ে বহন করে চলেছে বেদনার নীল। মা ভবিষ্যতের আশায় সঁপে দিচ্ছেন বাচ্চা মেয়েকে নীলের গভীরে। আমি যত সহজে লিখলাম মারিও পুজো তত সহজ করে বলেন নি। আদালতের বর্ণনায়, মেয়েটার ওপর বয়ে যাওয়া ঝড়ের পরের বিবরণে ছিন্নভিন্ন করে তোলেন টাকা আর ক্ষমতার কাছে অক্রিয় হয়ে পড়া একটা সমাজকে। এসব মেয়েদের বড় একটা অংশের জায়গা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত যৌনপল্লীতে। সিমন দ্য বুভোয়া এসব দেখে শুনে হয়তো ‘সেকেন্ড সেক্স বইতে বলছেন, বেশ্যাবৃত্তি পুরুষতন্ত্রের আশ্চর্য স্ববিরোধ। ঘরে এরা সতীসাধ্বী স্ত্রী রেখে বাইরে বেশ্যার সঙ্গে শোয়। স্ত্রীদের সতীত্বে এদের কড়া নজরদারি।
দুই.
মুনিয়ার যে জীবন সেটা একান্তই অনিশ্চিতের। সেটা বোঝার জন্য আমাদের গভীর গবেষণার প্রয়োজন হয় না। ত্রৈলোক্যনাথের ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসের কঙ্কাকে মশাদের রানি যখন জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? জবাবে সে বলে, মনুষ্য সমাজে মেয়েরা বিয়ের আগে পিতার সম্পত্তি। আর বিয়ের পর স্বামীর সম্পত্তি। এক্ষণে আমি বিবাহিত তাই আমি আমার স্বামী ক্ষেতুর সম্পত্তি।” মুনিয়ার পিতা নেই। তার বিয়েও হয় নি। সে তাহলে কার সম্পত্তি? আমরা জানি না। যতদূর খবর পেয়েছি সে বোনের আশ্রয়ে থাকে। সে বোন আবার কর্মজীবী নয়। বোনটা নিজেও তার স্বামীর সম্পত্তি। সেখানে আরেকটা বোনের আশ্রয় এটা বোঝা ছাড়া আর কিছু নয়। মুনিয়ার ভাই আছে বলে শুনেছি। সেখানে মুনিয়ার আশ্রয় নেই সে বোঝাই যাচ্ছে। এ অবস্থায় একটা মেয়ে কোথায় যায়? যে পৈতৃক সম্পত্তির সে মালিক সে সম্পত্তি তার পক্ষে পাওয়া কতটা সম্ভব আমাদের দেশের কম বেশি ক্ষমতাবান বোনেরাও জানেন। আমাদের আইনে পিতামাতার অবর্তমানে কন্যা সন্তান যে সম্পত্তির মালিক হয় ভাইয়েরা সহযোগিতা না করলে, মোটা কথায় দিতে না চাইলে সে সম্পত্তি বোনদের পক্ষে পাওয়া কতটা অসম্ভবের পায়ে শেকল পরানোর মতো কাজ ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। আমার এক ছাত্র লিখেছে, মুনিয়া তাকে একবার বলেছিল সে বড় কিছু হতে চায়। কী সেটা? সে অভিনয় জাতীয় কিছু করে বড় হতে চেয়েছিল হয়তো। মুনিয়া সুন্দরী। সে যা হতে চেয়েছিলো সেটা অনুকূল পরিবেশ থাকলে হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু ওর জন্যে সবকিছুই তো প্রতিকূল।
তিন.
যে যুবকের সে প্রেমে পড়েছিল, সে বাইরে থেকে দেখলে প্রেমে পড়ার মতোই। তার টাকা আছে, সে সুদর্শন। মুনিয়ার মতো আশ্রয়প্রার্থীর জন্য যথার্থ পুরুষ। ভেতর থেকে দেখার মতো বিচারবোধে পৌঁছানো এ বয়সের একটা মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। ভুলটা এখানেই হয়েছে। শ্রেণিব্যবধান এতো বেশি যে সেটা শোধরানোর আর সময় পাওয়া যায় নি।
কতগুলো প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। মুনিয়া লোভী, সে বিবাহিত ধনীর রক্ষিতা। তার বোন মুনিয়াকে দিয়ে ব্যবসা করিয়েছে। মুনিয়ার আরও অনেক সম্পর্ক ছিলো এসব এসব। এ ধরনের ঘটনা চাপা দেওয়া জন্য আমার কাছে মনে হয়েছে বাইবেলে বর্ণিত গলিয়াথের মতো শক্তির এমনতরো করে প্রচার করা স্বাভাবিক। এর বিপরীতে মুনিয়া নামের ডেভিড বেশি পরিমাণে দুর্বল। মুনিয়া এক লক্ষ টাকা দামের ফ্ল্যাটে ছিল। আমার মনে হয়েছে এটা তার পছন্দ নয়, আনভীরের পছন্দ। কারণ আমাদের সমাজের এই গলিয়াথের শরীর গুলশান ছাড়া অন্য কোথায় ঢুকতে পারবে বলে মনে হয় না। ধরা যাক, মুনিয়া বাসাবোতে ফ্ল্যাটে থাকতো। তাহলে গলিয়াথ কি সেখানে যেতে পারতো? তার শরীর ধারণ করতে পারে তেমন জায়গা কি মিরপুর বা বাসাবো?
চার.
মুনিয়ার এ মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের দেশের ডেভিড আর গলিয়াথের ব্যবধানটা সামনে নিয়ে এসেছে আবার। সাব্বিরের মৃত্যুর পর যেমন হয়েছিল, আমার ধারণা তার চেয়ে কম নড়াচড়া হবে এবার কারণ সাব্বির ছিল ছেলে, তার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো আরও স্ট্রং, তখন গলিয়াথরাও এতোটা শক্তিমান হয়ে ওঠে নি। মুনিয়া মেয়ে, তার পিতা নেই; সে এমন এক পুরুষতন্ত্রে বেঁচে ছিল যেখানে নারী পুরুষতন্ত্রের ছকের একটু বাইরে গেলেই ‘বেশ্যা’ জাতীয় বর্গীকরণের শিকারে পরিণত হয়।
বাঁদি যখন জমিদারের প্রেমে পড়ে তখন বাঁদিকে বলা হয়, তুই প্রেমে পড়িস নি, মরেছিস। এ কথা বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষে আমরা পাই। সময়ের ব্যবধানে এ উক্তির প্রাসঙ্গিকতা একটুও লুপ্ত হয় নি সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তাই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী থেকে ধার করে বলি, ইবসেনের নোরা রাতে বেরিয়ে পড়েছিল। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। নোরা তবুও সাহসটা করে। কারণ সেটা ইউরোপ। আমাদের এখানে হলে মুক্তি তো ওর মিলতো না, বরং শেয়াল কুকুরের মতো ওঁৎ পেতে থাকা পুরুষগুলো ছিঁড়ে কুড়ে খেতো। মুনিয়ার বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল না। যে জীবন সে বেছে নিয়েছিলো সেটা শেষতক মৃত্যুর।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]