বলিভারিয়ান বিপ্লব পরাজিত হলে, হেরে যাবে ভেনেজুয়েলার নারীরাও
সুমাইয়া সেতু।। দীর্ঘ সময় স্প্যানিশ উপনিবেশের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ভেনেজুয়েলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তাই জনগন একটা সুন্দর সমাজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ক্ষমতায় আনে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিপ্লবী নেতা হুগো শ্যাভেজ’কে। ১৯৯৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরে শ্যাভেজ রাষ্ট্রের অনেক নিয়মনীতিতে আনেন পরিবর্তন। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে শ্যাভেজ চেয়েছিলেন একটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে।
শ্যাভেজ নিজেকে বরাবর নারীবাদী হিসেবে ঘোষণা করে আসছিলেন। তাই ভেনেজুয়েলার নারীদের অনেক ভরসা ছিল শ্যাভেজের প্রতি। শ্যাভেজের স্বপ্নের বলিভারিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে ভেনেজুয়েলার দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষ নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিল। সব চেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিল নারী সমাজ। নারীদের মুক্তির লক্ষ্যে গ্রহণ করা হয়েছিল নানা উদ্যোগ। সাংবিধানিকভাবে আনা হয় নানা পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের অংশ হিসেবে সেই সময়ে সিঙ্গেল মাদারদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্যাভেজ।
বলিভারিয়ান বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ছিল তা হলো নারীদের গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন করা। ভেনেজুয়েলায় সেই সময়ে নারীদের গৃহে কাজের সময়কে শ্রম ঘণ্টা হিসেবে ধরে নিয়ে তার মূল্য প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। যে আইনের জন্যে বিশ্বের প্রায় সব নারীবাদীরা দাবি তুলে আসছেন যুগের পর যুগ, শ্যাভেজের সমাজতান্ত্রিক সরকার সেই কাজটি করে গেছেন বহু আগেই। বলিভারিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে নারীদের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে, নারীর প্রতি যেকোনো বৈষম্যের শাস্তির বিধান লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল সংবিধানে। এই বিপ্লবের কর্মসূচির পর গোটা ভেনেজুয়েলায় সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, বিশেষত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে।
সেই সময়ের নারী ও লিঙ্গ সমতা মন্ত্রণালয়ের সহ-সভাপতির দায়িত্ব নেন একজন নারী। সকল ক্ষেত্রে রাজপথের আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ে। এমন কি শ্যাভেজের বিরুদ্ধে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার ডানপন্থী দল মিলে ষড়যন্ত্র করে, তাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর চেষ্টা করে, সেই সময়ে সব চেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে ভেনেজুয়েলার বিপ্লবী নারী সমাজ। কারণ ইতিমধ্যে শ্যাভেজের নারীমুক্তির প্রচেষ্টা নারী সমাজের মাঝে প্রশংসিত ছিল।
শ্যাভেজ তার বলিভারিয়ান বিপ্লবের অংশ হিসেবে সবার জন্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কিউবা থেকে ডাক্তার এনেছিলেন। সেই সময়ে ভেনেজুয়েলায় মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি ছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং জনগনকে উন্নত চিকিৎসা সেবা দিতে ডাক্তার আনা হলেও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের লোকজন সেই ডাক্তারদের জন্যে কোনো জায়গার ব্যবস্থা করছিল না। কিন্তু ভেনেজুয়েলার নারীরা ডাক্তারদের জন্যে ঘরের ব্যবস্থা করেছিল, যার ফলে সম্ভব হয়েছিল সেই সময়ের ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। সম্ভব হয়েছিল মাতৃ-মৃত্যুর হার কমানো।
শ্যাভেজের সরকার সেই সময়ে ভেনেজুয়েলার স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা নারীদের দিয়েছিল বিশেষ সন্মাননা। শ্যাভেজের মৃত্যুর পরে তারই উত্তরসূরী নিকোলাস মাদুরো ক্ষমতায় বসেন, কিন্তু নীতির কোন পরিবর্তন হয় নি দেশটির। বলিভারিয়ান বিপ্লবের কর্মসূচির অংশ হিসেব ভেনেজুয়েলায় কৃষাঙ্গ ও আদিবাসী নারীদের করা হয়েছিল সন্মানিত। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তিনজন কৃষাঙ্গ ও আদিবাসী নারীকে সন্মাননা জানানো হয়। এই নারীরা কোন সাধারণ মানুষ ছিলেন না, এরা ছিলেন ভেনেজুয়েলার সংগ্রামের এক একজন বিপ্লবী। এই সন্মান প্রদর্শন ছিল ইতিহাসের একটি সুন্দরতম দৃশ্য, যেখানে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো মানুষকে সন্মান প্রদর্শন করতে নারাজ, সেখানে শ্যাভেজের বলিভারিয়ান বিপ্লব ছিল মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অপর নাম।
ভেনেজুয়েলায় আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে সর্বত্র। নারী ও লিঙ্গ সমতা মন্ত্রণালয় নারী শিক্ষার জন্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে, এমন কি আদিবাসী ও কৃষাঙ্গ নারীরা সেই শিক্ষা যাতে নির্দিধায় গ্রহণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হয়। শিশু-সুরক্ষা কেন্দ্র, বয়স্ক সুরক্ষা কেন্দ্র ও প্রতিবন্ধীদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়। এইসব কেন্দ্রগুলোতে নারীরা কাজ করে নিজের সবটা দিয়ে। এছাড়াও নারীরা কাজ করে সরকারের খাদ্য প্রকল্পে। তারা তৃণমূলে মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে খাবার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেয়। সেই সুযোগে নারীরা জানতে পারে মানুষের প্রকৃত অবস্থা। ভেনেজুয়েলার বর্তমানে একটি বড় সমস্যা কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ। ক্লেপ প্রকল্পে কাজ করা নারীরা তাই খাদ্য সহায়তা পৌঁছানোর সময় সবকিছুর খোঁজখবর রাখে এবং পরবর্তীতে নারীদের জন্মবিরতিকরণ পিল সরবরাহ করে।
ভেনেজুয়েলা সরকারের পক্ষ থেকে নারীর প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংবিধানের ২১টি ধারায় বিচার কার্য সম্পাদন করা হয়। পুরুষের উপর নারীর আধিপত্য নয়, নারী-পুরুষ সমতার সমাজ নির্মানের লক্ষ্যেই সকল কাজ পরিচালিত হয়। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সরকারের এই সকল উদ্যোগ চোখে লেগে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তাই তাদের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বেড়ে যায় অনেক গুন। এই চক্রান্তের ফলে ভেনেজুয়েলায় চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। অভাব দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের। এই সময়ে ভেনেজুয়েলার নারীরা রয়েছে ঔষুধ সংকটে, আছে নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন সংকট। এছাড়াও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট তৈরি করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এই সাম্রাজ্যবাদী নিষেধাজ্ঞার ফল ভোগ করছে ভেনেজুয়েলার নারীরা। মার্কিনীরা আসলে চায় যে ভেনেজুয়েলার বলিভারিয়ান বিপ্লব ধুলায় মিশে যাক, সর্বক্ষেত্রে পুঁজিবাদের জয়জয়কার হোক। অথচ পুঁজিবাদ নারীকে করে তোলে পণ্য, পুরুষতন্ত্রকেই উৎসাহিত করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। দেশে দেশে আমরা সেই দৃশ্যই দেখতে পাই। সেই পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিপক্ষে শ্যাভেজের বলিভারিয়ান বিপ্লব ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বর্তমান সময়ে অনেক সংকটের মুখে দাঁড়িয়েও তাই ভেনেজুয়েলার সংগ্রামী নারীরা কাজ করে যাচ্ছে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে, লড়াই করে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিপক্ষে। কারণ তারা জানে, যদি বলিভারিয়ান বিপ্লব পরাজিত হয়, পরাজিত হবে তারাও। পরাজিত হবে শ্যাভেজের সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের নারীবাদ।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]