ভুল করা অপরাধ নয়, হত্যা করা অপরাধ
ইসমত শিল্পী।। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, অপরাধ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার অভাব। আবেগতাড়িত হয়ে বা তাৎক্ষণিক অনেক রকম কথা, উদাহরণসহ বিচ্ছন্ন কিছু ঘটনা উল্লেখ করে যে কোনো কথা মানুষ বলতেই পারে। একটা ঘটনা সম্পর্কে সবার মতামত যে একই হবে, এমন তো নয়। কিন্তু মতামত প্রকাশে স্বাভাবিক কিছু চিন্তাভাবনার প্রভাব থাকা উচিৎ। এটা তো ঠিক, সব ঘটনার প্রেক্ষিতে কিছু কারণ থাকে। এবং কোন অবস্থায় সেই পরিস্থিতি ঘটলো এসব না ভেবেই কোনো উক্তি করা কি ঠিক?
বলতে চাইছি, মুনিয়া সংক্রান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে যা কিছু হচ্ছে সে বিষয়। কিন্তু এই লেখা শুধুমাত্র মুনিয়া কেন্দ্রিক-ই নয়; এ ধরনের সামগ্রিক ঘটনার প্রেক্ষিতে। অনেক চেষ্টা করলাম, কিছুই লিখবো না ভেবে। কারণ লিখেই বা কী হয়? কিছু কি হয়েছে অতীতে বা এতোদিনে? আমরা কয়টা ধর্ষণের প্রকৃষ্ট শাস্তি হতে দেখেছি? কয়টা প্রতারণার সাজা হয় এই সমাজে ও রাষ্ট্রে? কয়টা নারী এখনো তার সঠিক অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছে! সমঅধিকারের নামে যে মুলো ঝুলিয়ে রাখা তা বড় হাস্যকর। খোঁজ নিয়ে দেখি, অধিকাংশ মেয়ে কোনো না কোনোভাবে বঞ্চিত। কোনো না কোনোভাবে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে, সাজানো একটা চলনসই সামাজিকতার কাঠামোতে। মানাতে না পারলে সেই মেয়ে খারাপ। সে উশৃঙ্খল। সে বাজে চরিত্রের। সে চরিত্রহীন। এসব আমাদের মুখস্থ সংলাপ। হাতে গোণা যে কয়জন নারী দক্ষতা নিয়ে এগিয়ে, তাদের ছাড়তে হয় অনেক। ত্যাগ করে সরে আসতে হয় মানেই একটা বঞ্চনা বুকে গেঁথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে চালিকা শক্তি নেই বললেই চলে। বরং পিছনে নিন্দা করার অনেক লোক থাকে।
মুনিয়া আত্মহত্যা করুক বা তাকে হত্যা করা হোক, দুইই অপরাধ। হ্যাঁ, যদি আত্মহত্যা করে থাকে তাহলে কী কারণে করলো? স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনো মানুষ কি আত্মহত্যা করে? এটা অতি সাধারণ একটা প্রশ্ন? নিশ্চয় তাকে আত্মহত্যার মতো পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সেটা নিছক হত্যার থেকে কম অপরাধ নয়। আর যদি সাধারণ প্রতারণা হয়, তবু সেটা অপরাধ। আমি আইনের কথাতেই বলতে চাই- “কোন ব্যক্তি প্রতারণা করবার অভিপ্রায়ে কিছু করলে উক্ত ব্যক্তি উক্ত কাজ প্রতারণামূলকভাবে করে বলে গন্য হবে” [দণ্ডবিধি ২৫ ধারা]; কাকেও ঠকাবার উদ্দেশ্যে এবং তৎপ্রেক্ষিতে স্বীয় মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে কোন কিছু করা হলে তাকে প্রতারণা বলা যায়। মুনিয়ার ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝাই যায়, ঘটনার প্রেক্ষিতে কারণগুলো কী? এবং এই ধরনের হত্যা বা আত্মহত্যাগুলো প্রায় একই রকম পরিস্থিতে থেকেই তৈরি।
প্রতারকের পক্ষের লোকজন এখন বলতেই পারেন, মুনিয়া নিজেই প্রতারণার ফাঁদে ফেলেছিল ওই ক্ষমতাসম্পন্ন বাবার ক্ষমতাধর পুত্রকে। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে একবার ভাবুন তো! এও কি সম্ভব? যুগ যুগ ধরে প্রতারনার ফাঁদে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল যে, তাকে। আর নারী পুরুষের বেলায় নারীকেই সারাজীবন দুর্বল হিসেবে ভেবে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার সমাজ। পুরুষ মানে কোনো একক ব্যক্তি নয়। পুরুষতন্ত্রও কোনো বিশেষ ব্যক্তি নয়। এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। যে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তথাকথিত সমাজে পুরুষকে শক্তিশালী এবং নারীকে দুর্বল ও পরনির্ভরশীল হিসেবে ভাবা হয়। এই ভাবনায় পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা স্বস্তি পায়। এর অন্যথা হলেই নারীকে শুনতে হয় হাজার রকম কটুক্তি, নিন্দা। নারীকে কখনোই মাথা তুলতে দিতে রাজি না পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। আর যে কোনো জটিল ঘটনায় ইনিয়ে বিনিয়ে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত কারার ফন্দি করা হয়। এবং শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় নারীর সততা। নারীর বিশ্বাস। নারীর আবেগ ও মমতাকে হেনস্থা করেও শান্তি পায় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের চাওয়া নারী পুরুষের উপর নির্ভর করে বেঁচে বর্তে থাকবে। পুরুষের ইচ্ছায় এবং দয়ায় চলবে। পুরুষকে সকল বিষয়ে বিশ্বাস করতে হবে। আত্মনির্ভরশীল নারী পুরুষতন্ত্রের শত্রু। এবার বুঝতে পারছেন নারীর অবস্থান? নারী বিশ্বস্ত এক প্রাণী । এছাড়া আর কি !
যে কোনো সম্পর্কেই একটা নির্ভরশীলতা থাকে। অপরকে বিশ্বাস করে বা ভালোবেসে অথবা তার উপরে নির্ভর করার মাঝে এক ধরনের তৃপ্তি আছে। সেটা যতক্ষণ ভালোবাসা থাকে ততক্ষণ। নির্ভরতা শুধুমাত্র অর্থ বা বৈষয়িক নয়, নির্ভরশীলতা আবেগীয় হয়, বন্ধুত্বের হয়, প্রেমের হয়। সম্পর্কের তেমনি বিভিন্ন প্রকার আছে। মুনিয়াকে কখনোই উগ্র বা উশৃঙ্খল মনোভাবের দেখা যায় না। বরং তার লেখা ডায়েরি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মুনিয়া আনভীরকে ভালোবাসতো। নির্ভর করতো। অপেক্ষা করতো। এটা তো ভুল নয়, কোনো ব্যক্তি কোনো কিছু বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ থাকে বলেই আরেকজনকে বিশ্বাস করে। আর এই সমস্ত কারণ ওই অপরাধীই তৈরি করে। কিন্তু আনভীর মুনিয়ার সাথে প্রতারণা করে এবং ওই সম্পর্ককে ভিত্তিহীন বলে প্রচার করে। একপাক্ষিক বলে চালাতে চায়। আর সকল দোষ গিয়ে পড়ে ভুক্তভোগীর উপর। ভুক্তভোগী অপরাধী না হলেও সব দোষ তখন তার। এটা সাধারণ মানুষের হাজারো মন্তব্যে প্রকাশিত। এমনকি সাংবাদিকরা এই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন রকম সংবাদে।
এই যে এখন, মুনিয়াকে নিয়ে আজেবাজে সংবাদ ছাপা হচ্ছে। এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও মুনিয়ার অনেক দোষ ক্রটি উল্লেখ করছে জনে জনে। আবার অনেকে দেখলাম, এমনও লিখছে, মুনিয়া ভালো হলে কি এমন হতে পারে? মানে দাঁড়াচ্ছে, মুনিয়া মেয়েটিরই দোষ। তা-ও আবার অনেক রকম। নিজের জীবনের একটা উদাহরণ দিলে অবিশ্বাস করবেন না মনে হয়। আমার সংসার ভেঙ্গেছে, ২০০২ সালে। দশ বছরের সংসার জীবন টিকিয়ে রাখতে বহু চেষ্টা করেও পলাফল শূণ্য। শুধু শূণ্যই নয় মাইনাস জিরো বলা যায়। আমার ছেলের বাবা কলেজ শিক্ষক। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া এক মেয়ের প্রেমে পড়ে এবং গোপনে বিয়ে করে। ৯ দিন পরে ওই মেয়েটি এ বাড়িতে এসে উঠলো, তখন জানাজানি হলো। আমি কোনোও রকম বাদ প্রতিবাদ না করে ছেলে সুদীপ্তকে নিয়ে চলে এসেছি। তখন ছেলের বয়স পাঁচ, আমার বত্রিশ। তো, বত্রিশ বছর বয়সের পরে আমার কি আবেগ সব মরে যাবে? বা কারোর সাথে ভালোলাগার কোনো সম্পর্ক হতে পারবে না? বা ইচ্ছে হলে বিয়ে করতে পারবো না আর!
আমি একজনকে পছন্দ করলাম তখন শুনতে হলো পারিবারিক মর্যাদা থাকবে না। আচ্ছা, গেলো। এক পরিচিত বন্ধুর সাথে তিন দিন দেখা হয়েছে মাত্র। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি। সেটা রাষ্ট্র হয়ে গেল হাজার জনের কাছে। আমার আত্মীয় পরিজনের কেউ কেউ আমার মায়ের কাছে আপমানসূচক কথা বলে দিলো আমাকে নিয়ে। এক বিসিএস ক্যাডার ফুপাতো ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললো, কি রে শিল্পী এসব কী শুনছি? আমি তো অবাক, কী এমন হয়েছে যে, এভাবে কথা বলছেন উনি! সেই ভাইয়ের কথার ভাষা হলো, তুই সংসারটাও ঠিকভাবে করতে পারলি না? আবার এসব কথাবার্তা কানে আসে; কি যে করিস। আমি কী বলবো ভেবে পেলাম না। এ কী শুনছি? মানে সংসার করতে না পারার দোষ পুরুষ লোকটির নয়, আমার? আমাকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার মতো বেআইনি, অমানবিক, আপমানজনক কাজের জন্যে পুরুষ লোকটির কোনো দোষ নেই- সব দোষ আমার? মানে, আমিই সংসার করতে পারনি- এই হলো মূল বক্তব্য! বুঝুন তাহলে, নারীর সম্মানের অর্থ আমাদের সমাজে কী? পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবেও। না হলে এতো এতো মেয়েকে সম্ভ্রম লুকিয়ে কাঁদতে হতো না। এভাবে মরতে হতো না মুনিয়াদের। আর মরে গিয়েও এতো কলঙ্কিত হতে হতোনা! যে কিনা বিশ্বাস করে পাপ করেছে, ভালোবেসে ভুল করেছে।
এরকম হাজারো ঘটনা আছে, যেখানে উল্টো নারীর উপরেই দোষ চাপানো হয়। এটা একটা সামাজিক ব্যাধি বলা যায়; কুৎসিত দৃষ্টিভঙ্গি। আর অর্থ দিয়ে হাজার হাজার অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার উদাহরন কে না জানি? বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সাজাপ্রাপ্ত হবে এটা এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সম্ভব না, যেখানে টাকার দরে আইন চলে। আইনের শাসন থাকলে এসব ঘটনা অনেক কমে যেতো, তা কি জানি না আমরা?
এসব জেনেও এই বুদ্ধিমান পুরুষ গোষ্ঠী নারীর উপরে দায় চাপিয়ে দিতে ওস্তাদ। কিন্তু একবারও ভাবে না, এমন ভাবে চাপতে চাপতে যখন নিজের ঘরে এসে উঠবে, তখন? কেন সোচ্চার হচ্ছে না এখনও সাধারণ মানুষ? সাধারণ মানুষের বিপদে মানুষকেই এগোতে হবে। টাকার পাহাড়ে যাদের সব দোষ ঢাকা পড়ে তাদের কাছে মাথা বেঁচে কি লাভ শুনি? এতোকিছুর পরেও আমাদের বিবেক জাগ্রত হয় না কেন? আমরা তো বসুন্ধরার স্বার্থভোগী নয়, তাহলে? কীসের ভয়? নাকি মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে গেছে মানুষ? উদাহরণ, যুক্তি, আইন সবকিছু মিলে যাওয়ার পরেও মুনিয়ার দোষক্রটি তুলে ধরা তো পুরুষতন্ত্রেরই চিত্র। নারী স্বাধীনতা ও অধিকার বাদ দিলে মানুষ হিসেবে যে অধিকার নারীর আছে, তারই বা কতটুকু পাচ্ছে নারী!
একথা ভুলে গেলে গেলে চলবে না, পুরুষতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে নারীরাও কম দায়ী নয়। এই সিস্টেমকে জাগিয়ে দিতে নারী পুরুষ উভয়ই ভূমিকা রাখছে। তাই নারী মানুষ হিসেবে অধিকার হারায় এবং অজস্র দোষে অলংকৃত হয়। যেখানে নারীর চাওয়া পাওয়ার হিসেব খুবই নগন্য, সেখানেও দিতে হচ্ছে প্রাণ। হারাতে হচ্ছে সম্ভ্রম।
ভূত ছাড়াবার জন্য ওঝা কর্তৃক আছরগ্রস্ত (রোগগ্রস্ত) নারীকে ঝাড়ু মারা বা ঝাড়ু দিয়ে পিটানো অপরাধ। [দণ্ডবিধি ৪০ ধারা]
মূল কথায় আসি। অপরাধ কী?
অভিপ্রায় হলো অপরাধ সংঘটনের মৌলিক উপাদান। তাই কোন ব্যক্তির অপরাধ সংঘটনের মধ্যে যদি কোন অভিপ্রায় থেকে থাকে তাহলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, প্রতারণা, অবহেলা ইত্যাদি বিদ্যমান থাকলে তা অবশ্যই আইনগতভাবে অপরাধ। সার্বিক চিত্র অনুধাবন করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, আসল দোষী কে? অপরাধী কে? আর হ্যাঁ, ভুল, অন্যায় এবং অপরাধ এগুলোর পার্থক্য আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে। মুনিয়া এই সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল করেছে। ভুল করা অপরাধ নয়। হত্যা করা অপরাধ। আইনগতভাবে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করাও অপরাধ। এটা শুধু অন্যায় নয়, তাই কথা বলাবলি করে অপরাধ ঢাকবার চক্রান্ত না করে অপরাধীর কঠোর শাস্তি প্রদানই একমাত্র সঠিক বিচার।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]