November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

নারীর জন্য নীতিবাক্য

সাদিয়া মেহজাবিন।। “বোরাত” নামে একটি ইংরেজি মুভি দেখছিলাম। সিনেমা নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা বা আলোচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। তবে এই দুর্দিনে কেন এই সিনেমা নিয়ে আলাপ, তা পরে বলবো। আগে সিনেমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিই।

বোরাত একজন ব্যক্তি, তিনি এত দিন জেলে ছিলেন, পরবর্তীতে তাকে জেল থেকে বের করে একটি মিশনে পাঠানো হয়। কাজাখ নামের ছোট একটি দেশ থেকে এসেছে বোরাত। সেখানে তারা প্রযুক্তির খুব বাইরে, পুরুষেরা কেবল কাজ করেন, নারীদের পশু পাখির সাথে তুলনা করা হয়, কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়, মেয়ে শিশু জন্মের পর তাদেরকে একটা গল্পের বই ধরিয়ে দেওয়া হয়।

কালক্রমে মিশন পূরণ করতে এবং দেশের জন্যে সুফল বয়ে আনতে বোরাত ইউএসএ’র প্রধানমন্ত্রীকে তার একমাত্র মেয়ে যার বয়স পনেরো, তাকে উপহার হিসেবে  দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মেয়েকে সে পশুপাখির মত হাতে পায়ে  দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখে। তাকে নানাভাবে শেখায় কীভাবে প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে তাকে তার রূপ-সাজ-ব্যবহার পরিবর্তন করতে হবে। মেয়েও তার বাবার সকল কথাকেই সত্য ভেবে মেনে চলে। মেয়েও খুশি সাজ-রূপ নিয়ে কেননা ছোটবেলা থেকে সিন্ড্রেলা দেখে বড় হয়েছে। সে সেখানে দেখে মানিয়া নামের মেয়েটি খাঁচায় বন্দী থাকে এবং একজন রাজপুত্র তাকে বাঁচাতে আসে। তাই সে এসব বিষয়ে অনেক আগ্রহী।

বোরাত প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে তার মেয়ের স্তনকে আরো আকর্ষণীয় করতে ব্রেস্ট সিলিকন ইমপ্লান্ট সেন্টারে নিয়ে যায়। অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন যা তাদের কাছে ছিল না। তাই বোরাত ভাবলো সে কোনো চাকরি করবে এবং মেয়েকে কারো বাসায় রাখবে। বোরাতের মেয়ে টুটুয়া যে মহিলার বাসায় ছিল সেখানে সে দেখে মহিলারা গাড়ি চালাতে পারে, তারা সাংবাদিক হতে পারে অর্থাৎ পুরুষদের মত মহিলারাও এখানে সকল কাজ করছে। টুটুয়া এসব দেখে ভয় পেয়ে যায় এবং মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করে এসব সম্ভব কিনা। তখন সেই মহিলা তাকে বোঝায়, হ্যাঁ নারীরাও সব করতে পারে। টুটুয়াকে রাতে গল্প শোনাতে গিয়ে মহিলাটি খেয়াল করেন যে সে কেবল তার বাবার দেওয়া গল্পের বইটি পড়ে। যেখানে লেখা থাকে কোনো নারীর শারীরিক চাহিদা থাকতে পারে না, যোনীতে হাত দিলে মৃত্যু হবে, নারীরা একলা চলতে পারে না, পুরুষদের সমতুল্য ভাবা পাপ। এইরকম হাজার ভুলে ভরা ছিল সেই গল্পের বইটি। এসব দেখে টুটুয়াকে মহিলাটি বোঝায় তার বাবা তাকে মিথ্যা বলছে। এখন নারীরা সব পারে। নারীদেরও সমান অধিকার আছে। এবং টুটুয়া যদি তার ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করতে না চায় তাহলে এই কম বয়সে তার এই সার্জারির ভিতর দিয়ে যাওয়া উচিত নয়। এবং সে যেমন আছে সেভাবেই সুন্দর। টুটুয়া সব শুনে তার বাবাকে ছেড়ে চলে যায়। অনেক দিন পর তার বাবা তার ভুল বুঝতে পারে এবং পরে তাদের গ্রামটি একটি নারীবাদী গ্রামে পরিণত হয়।

এই সিনেমা দেখার পর সবচেয়ে প্রথমে যে ভাবনাটি মাথায় আসে সেটি হলো, এই সিনেমার সাথে আমাদের সমাজের সত্য কত মিল। ধরুন প্রগতির চর্চায় এখন নারীরাও সমান অধিকারের কথা বলছে কিন্তু তা কতখানি সত্য কিংবা মিথ্যা এই সিনেমা থেকে? আমাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় না কোনো বই ঠিকই, কিন্তু অদৃশ্য এক পুঁথির নীতিবাক্য এখনো প্রচলিত এই সমাজে। নারী কী করতে পারবে কিংবা পারবে না অথবা কী কী করা দরকার সব আমাদেরকে শিখিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু এই নীতি বাক্যগুলো তৈরি করছে কারা? মূলত সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা যারা কেবল নিজেদের সুবিধা বোঝে, তারাই এসবের কারিগর। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই নীতিবাক্যগুলো যে ভুল তা পুরুষেরাও জানে কিন্তু সুবিধার লোভে তারাও এই রীতি মেনে আসছে। যেমন ধরুন এই বসুন্ধরা গ্রুপের ছেলে আনভীর। যার বাবাও হয়তোবা মানুষের রক্ত চুষে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। তার ছেলেও তার সেই নীতি বইয়ের বাক্য মেনে চলছে এবং সেও তার জীবনে নারীকে রক্ষিতা, খানকি, বেশ্যা উপাধি দিচ্ছে। তার পরবর্তী উত্তরাধিকারও তাই করবে। এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকবে এই নীতিবাক্যের দাপট এবং পিষে মরবে মুনিয়া, তনু, নুসরাতের মত মেয়েরা।

নীতি বাক্যগুলো ভুল, এটা বুঝে যারা এর প্রতিবাদ করছে তারা মূলত ‘নারীবাদী বেশ্যা’ গালি খাচ্ছে এবং প্রগতির চর্চা করা মুখোশধারী পুরুষেরা হাসি তামাশা করছে। সব কিছুর পর সিনেমাতে খেয়াল করে দেখলাম টুটুয়ার ভুল ভাবনা শুধরাতে এগিয়ে আসছে নারীরাই। নারীবাদী নারীরাই টুটুয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছে সত্য তা না যা তোমাকে দেখানো হচ্ছে। আমিও আমার বাস্তব জীবনে খেয়াল করে দেখলাম আসলেই তো অজান্তে অনেক ভুল শেখানো হচ্ছে আমাদের। কিন্তু মজার একট বিষয় কি জানেন? অনেক পুরুষও নারীবাদী সাজে, কিন্তু যখনই মনে হচ্ছে ক্ষমতা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না তখন তারা তাদের মুখোশের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে হিপোক্রেসি দেখায় এবং আবার নারীর উপর ক্ষমতার চর্চা করতে চায়।

মুনিয়া সংক্রান্ত ব্যাপারেও এমন। সাংবাদিক থেকে অনেক প্রগতিশীল মঞ্চই তাদের আসল রূপ দেখাল। আমরাও দেখলাম আদতে নিজে বাঁচলে বাপের নাম বলে এবার নিজেদের অধিকার নিয়ে লড়াই এবং অধিকার বুঝে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কম বয়সী নারী যাদের টার্গেট, তাদেরকে চিহ্নিত করা এবং সর্বস্তরে নারীদের সুরক্ষার জন্যে তৃণমূলেও নারীবাদ পৌঁছে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আপনাদের খারাপ লাগা স্বাভাবিক, এই করোনার মহামারীতেও এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে হচ্ছে! কিন্তু দেখুন, দেশের লজ্জা চাইলেও যে আর ঢাকা যাচ্ছে না। তাই কখন রাজপুত্র এসে বাঁচাবে সে আশা না করে নিজেদের মুক্তির পথ নিজেদেরই বের করতে হবে। প্রযুক্তির হাত ধরে এই আন্দোলন চালানো এখন সময়ের দাবি।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]