May 19, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

নারীর জন্য সমাজটা খুব কুৎসিত, নারীর গল্পটা তার দৃষ্টিতেই দেখানো হোক

আজমেরী হক বাঁধন – বলা যায় বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে পরিচিত নাম। এই নামটি আমাদের জন্য গর্বের, জাতি হিসেবে আত্মবিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয়েরও। তরুণ পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের পরিচালনায় রেহেনা মরিয়ম নূর চলচ্চিত্রটির কান চলচ্চিত্র উৎসব যাত্রা, সেখানে গিয়ে প্রশংসা কুড়োনো, অভিনন্দিত হওয়া- এ সবকিছুর ভেতরেই বাঁধনের তুমুল উজ্জ্বল উপস্থিতি, ভূমিকা আমাদেরকে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে। বাঁধনের চমৎকার অভিনয়, সপ্রতিভ আচরণ, চৌকস কথাবার্তা, পোশাক চিন্তা, ঝকঝকে মুখশ্রী- সবকিছুই সকলের নজর কেড়েছে। বাঁধন প্রশংসিত হয়েছেন দেশি বিদেশি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের চোখে, তাকে নতুন করে আবিস্কার করেছে আমাদের চলচ্চিত্র মাধ্যমও। এসব কিছুর বাইরেও বাঁধনের সাহসী ব্যক্তিত্ব, নারীবাদী চিন্তা চেতনা ও তার প্রকাশ, প্রথা ভাঙার লড়াই চোখে পড়ার মতো। বাঁধন একজন ফেমিনিস্ট, একজন অধিকার সচেতন মানুষ। 
আজমেরী হক বাঁধন কান উৎসবকে ঘিরে দীর্ঘ ব্যস্ততার দিন পাড়ি দিলেন। এসব শেষ হলে তার সাথে অনলাইনে দীর্ঘ আড্ডা হয়েছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের সম্পাদক শারমিন শামস্- এর। গুনী এই তারকার একটি খোলামেলা সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য। নিচে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

শারমিন শামস্: আপনার প্রশংসা করতে গিয়ে সবাই বলছে, এ এক নতুন বাঁধন। এই কথাটা আপনি কীভাবে দেখেন? নতুনত্বটা কোথায়? আপনার ফিটনেস, লুক- এসবেই? নাকি আপনার চিন্তার জগতের গভীরতা, তার অকপট প্রকাশ, আপনার বক্তব্য, পড়ালেখা, সিনেমায় আগ্রহী হয়ে ওঠা- সব মিলিয়ে। নতুন লুক তৈরিতে কোনটাকে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?

আজমেরী হক বাঁধন: প্রথমে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই যে, আপনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন, এবং আমাকে নিয়ে কথা বলেছেন। আপনি অ্যাটলিস্ট আমি যে জায়গায় কাজ করেছি বা যে জায়গায় কাজ করার চেষ্টা করেছি, আপনি সে জায়গাটা ধরতে পেরেছেন – এটা হচ্ছে সবচাইতে বড় কথা। সেটার জন্য সবার আগে আপনাকে ধন্যবাদ। অবশ্যই আমাকে যখন কেউ বলে যে, এ এক নতুন বাঁধন, খুব কম মানুষই আমার বাহ্যিক দিকটাকে আসলে না দেখে আমার মানসিক যে পরিবর্তন আমি করেছি সেটা দেখতে পারে। সেটা এরকম না যে তাদের একার ব্যর্থতা, এটা আমাদের গোটা সমাজের ব্যর্থতা যে ঐ দিকটা দেখার মতো করে মানসিক গঠনই মানুষের হয়নি।

যেহেতু মানসিক গঠনটা আসলে মানুষের এরকম নয় যে বাহ্যিক দিক বাদ দিয়ে মানুষ আসলে মানুষের আরও অনেক কিছু দেখতে পারে, সেহেতু আসলে আমি সবসময় অন্যের উপর বিক্ষুব্ধ হই এরকম না, কিন্তু অবশ্যই আমার কষ্ট লাগে যে সবাই শুধু আমার শারীরিক গঠনের পরিবর্তনটা দেখেছে যে আমি আমার ওয়েট অনেক কমিয়েছি, আমি শরীরচর্চা করছি, আমি চেষ্টা করছি ফিট থাকতে, আমি আমার পোশাকে পরিবর্তন এনেছি, আমি আমার সাজে পরিবর্তন এনেছি। যেহেতু এটা বাহ্যিক দিক, এই দিকটাকেই সবাই দেখে। এবং নারীর ক্ষেত্রে যেটা হয়, এটাই সবার আগে আলোচিত বা সমালোচিত হয়।

কিন্তু অনেকেই আছে যারা আপনার মতো আসলে আমার যে পরিবর্তনটা আমি করতে চেয়েছি, এবং যে পরিবর্তনটা আসলে হয়েছে আমার ভেতরে, যে উপলব্ধি আমার হয়েছে সেটা বুঝতে পারে – এবং সেটা একান্তই আমার মানসিক পরিবর্তন। আমার মাথায় আমার ব্রেনে যে পুরষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার খাঁচাটা ছিল, যে শেকলটা ছিল আমি সেটাকে আসলে পুড়িয়ে দিয়েছি। আমার একটা স্ট্যাটাসে আমি এটা লিখেছিলাম যে আমার শরীরের বাড়তি মেদের মতো আমি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার এই খাঁচাটাকে আসলে পুড়িয়ে দিয়েছি। কারণ এটার ধারক বাহক আমি নিজেও ছিলাম। এটা এরকম না যে আমি আসলে নিজে নিজে এটা শিখে বড় হয়েছি। আমি এমন একটা সমাজে জন্মেছি যেখানে আসলে এটার ধারক বাহক হিসেবে নারীকেই বেছে নেওয়া হয়। সো সেটার ধারক বাহকই আমি ছিলাম।

ওই পরিবর্তনটা খুব কম মানুষই দেখতে পারে, যে আমি প্রথমত সেটাকে বার্ন করেছি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সেই শেকলটাকে, আমার মাথা থেকে। তারপর অবশ্যই আমি আমার উপর ফোকাস করেছি, সেটা আমার মানসিক চিন্তার পরিবর্তন, দর্শনের পরিবর্তন করেছি, আমি আমার পড়াশোনা বাড়িয়েছি, প্রত্যেকটা জায়গায় যে আমি কাজ করেছি, সেটা হয়ত আপনার মতো করে কেউ দেখেনি, বা খুব কম মানুষ, আমার মনে হয় খুবই কম মানুষ এই উপলব্ধিটা করতে পেরেছে। তবে আমি এটুকু বলতে পারি আপনাকে যে, আমার এই কারণে অনেকে আসলে অনুপ্রাণিত হয়েছে। সো অনুপ্রেরণার জায়গা থেকে শুধু যে আমার বাহ্যিক পরিবর্তনের দিক থেকে তারা অনুপ্রাণিত হয়েছে এ রকম না, আমি অনেককে দেখেছি, অনেকে সাহসী হয়েছে। আমার মেয়ের কেসটা নিয়ে যখন আমি কোর্টে গিয়েছি ওই ঘটনা থেকে, ওইটা মানুষের উপর অনেক প্রভাব বিস্তার করেছে।

প্রচুর ফোন পেয়েছি, যেখানে আসলে খুবই সাধারণ ঘরের মানুষ যারা আমাকে ফোন করেছে, আমি তাদের সবসময় হয়তো সব কল আমি রিসিভ করতে পারিনি কিন্তু আমার ওই পদক্ষেপটা বা ওই সাহসটা আমি দেখেছি অনেক নারীকে সাহস যুগিয়েছে। এবং নিজের প্রতি ভালোবাসাটা যে একটা অন্যায় না, এটা যে অপরাধ না, এ কথাটা তো মেয়েরা আসলে জোর গলায় বলতে পারে না। সো আমি যখন বলা শুরু করেছি, আমি আপনাকে একটা জিনিস শেয়ার করি, আমি যখন ওয়ার্কআউট করতে জিমে যেতাম, আমার ওখানে অনেক হাউজওয়াইফ, যারা ধরেন যাদের বাচ্চা এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে বা কলেজে পড়ছে, এরকম অনেক হাউজওয়াইফ ওখানে জয়েন করা শুরু করে, যারা আসলে অনেক ওবেসিটিতে ভুগছে। ওবেসিটি কিন্তু একটা ডিজিজ, আমাদের এখানে এটা নিয়ে কোনো কথা হয় না। এবং ওই বয়েসী একটা নারী কেন নিজের দিকে যত্ন নেবে, কেন আসলে নিজের সৌন্দর্য্যের কথা, নিজের শারীরিক এবং মানসিক ফিটনেসের কথা চিন্তা করবে – সো ওই জায়গাটাও কিন্তু আমাকে আসলে ভীষণভাবে ভালোলাগা দেয় যে, হয়ত মানুষকে কোনো না কোনোভাবে অনুপ্রাণিত করতে পেরেছি যে নিজেকে ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়। নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য যদি আমি শরীরচর্চা করি, যদি আমি নিজেকে ভালোবাসি, আমি যদি নিজেকে সময় দেই, আমি যদি আমার মানসিক পরিবর্তনের জন্য পড়াশোনা করি, আমি যদি বেড়াতে যাই, আমি যদি বই পড়ি, আমি যদি আসলে একটা সঙ্গীর খোঁজ করি, তাহলে এটা যে অপরাধ না, এই কথাগুলো আসলে আমাদের এখানে কেউ বলতে চায় না। আর একা হলে তো একেবারেই না। আমি দেখেছি অনেকে আসলেই এই জায়গাগুলোতেও অনুপ্রাণিত হয়েছে। এটা আমাকে আসলে এক ধরনের ভালোলাগা দেয়। তবে আপনার অবজার্ভেশনটা অনেক ঠিক যে, বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু শুধু আমার কাপড়, আমার বাহ্যিক পরিবর্তনটা খেয়াল করেছে।

আমার কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার মানসিক পরিবর্তন। আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমি এতদিন পরাধীন ছিলাম। আমি আমার নিজের স্বাধীনতা এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। আমি এটা বলব না যে, আমি আমার অধিকার স্বাধীনতা বুঝে পেয়েছি, কারণ আমার অধিকার তো আসলে আমার ধর্ম আমার, আমার সমাজ, আমার পরিবার, তারাই বঞ্চিত করছে আমাকে অনেক অধিকার থেকে। আবার স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও একই কথাই আমি বলব যে, আমাদের স্বাধীনতাও আসলে হনন করা হয় পরিবার থেকে সমাজ থেকে, এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমেও আমাদের অনেক স্বাধীনতা আসলে হনন করা হয়। সব মিলিয়ে আমি বলব না যে আমি বুঝে পেয়েছি, তবে আমি মনে করি যে, অ্যাটলিস্ট আমি এটা বুঝতে পেরেছি যে আমি একজন স্বাধীন মানুষ এবং আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে মানুষ হিসেবে অধিকার ও স্বাধীনতা পাওয়ার।

শারমিন শামস্: সারা বিশ্বে, বিশেষ করে পশ্চিমা সিনেমা, বিজ্ঞাপন, ড্রামা জগতে ফেমিনিজমের জয়জয়কার। নারীপ্রধান চরিত্রের সিনেমা ও সিরিজ তৈরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশ কি পিছিয়ে আছে? আপনি কী দেখছেন?

আজমেরী হক বাঁধন: শুধু পিছিয়ে নেই। আমি বলব যে, নারী প্রধান গল্পের ব্যাপারটাতে আমরা একেবারে শেষের দিকেই আছি। এটা আসলে যুগে যুগে হয়ে আসছে এবং এটার পরিবর্তন করারও খুব একটা কারো ইচ্ছে নেই। কারণ এই ইচ্ছাটা হলে অনেক কিছুর বিপরীতে যেতে হবে, অনেক কিছুর বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, এই রিস্কটা আসলে আমাদের সমাজ নিতে চায় না। এটা শুধু যে পুরুষ পরিচালকরা করছেন তা নয়, এখানে নারী পরিচালক যারা আছেন তারাও কিন্তু এই উদ্যোগটা নেন না। তারাও কিন্তু সমাজটাকে পুরুষের দৃষ্টি থেকেই দেখান। আমি অনেক নারী প্রধান গল্প দেখেছি যেটাতে আসলে গল্পটা সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা বা পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।

একটা নারীর দৃষ্টিতে সমাজকে দেখা কিন্তু খুবই ভয়ংকর, কারণ ওই সমাজ তো ভীষণ কুৎসিত। নারীর দৃষ্টিতে সমাজ তো ভীষণ কুৎসিত। সেই কুৎসিত সমাজকে দেখার সাহস করাটাও কিন্তু খুব বড় একটা ব্যাপার। এবং সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই অনেক পিছিয়ে আছি। এবং সেটা আমি যে অনেক বছর আগে থেকেই লক্ষ্য করেছি এরকম না, আমার গত তিন চার বছরে আসলে এই রিয়েলাইজেশনটা হয়েছে যে আসলেই তো কী হচ্ছে। আসলেই তো কোনো গল্প নাই, কোনো গল্পে নারী থাকলে সে আসলে সাপোর্টিং ক্যারেক্টার থাকছে। যদি নারী প্রধান গল্পও হয় সেখানেও নারীকে শেষ পর্যন্ত একটি আদর্শের মূর্তি বানানো হচ্ছে আর না হলে তাকে ডাইনি বানানো হচ্ছে। যে মেয়েটাই প্রতিবাদ করছে তাকে ডাইনি হিসেবে প্রমাণ করছে এবং একধরনের মাইন্ডসেট, যে স্টেরিওটাইপ মাইন্ডসেট যে মেয়েরা চাঁদে গেলেও বাসায় এসে রান্নাটা একেবারে পরিপক্কভাবে করতে হবে। রান্না করা কোনো অপরাধ না, বাট রান্নাটা যে ছেলে মেয়ে উভয়েরই কাজ সেই জায়গা থেকেই আমরা এখনও বের হতে পারিনি, আর আমি তো বাকি অন্য কথা বাদই দিলাম। আমার আগের বিজ্ঞাপনগুলো দেখে ভীষণ আমার যন্ত্রণা হয়, আমার মনে হয় যে, এটা কী ধরনের আসলে আমরা কোন ধরণের সমাজ ব্যবস্থায় থাকি। আল্টিমেটলি একটা মেয়েকে  কেন আদর্শ নারী হিসেবে দেখাতে হবে, এবং সেটা সমাজের ছকে বাধা আদর্শ নারী। কোথাও কিন্তু ভালোমানুষ নিয়ে কথা নাই। ভালোমানুষ নিয়ে চর্চা নাই। শুধু চর্চা হচ্ছে কীভাবে একটা মেয়ে ভালো মেয়ে হবে, আর একটা পুরুষ কীভাবে শোষক হবে। সো এই জায়গাটায় কাজ করার মতো আগ্রহও আমি মানুষের ভেতরে খুব কম দেখেছি। আমরা অবশ্যই অনেকটা পিছিয়ে আছি, এবং আমার ধারনা আমরা একেবারে শেষের দিকে আছি এইক্ষেত্রে যে নারী প্রধান গল্পগুলো নিয়ে সিনেমা সিরিজ তৈরি হয় না, ইভেন বিজ্ঞাপনও হয় না।

শারমিন শামস্: সিনেমা নাটক নারীকে এতদিন যে ইমেজে প্রেজেন্ট করে এসেছে, নারীর ত্যাগ, নারীর বঞ্চনা মেনে নেওয়া, মুখ বুজে থাকা, সাবমিসিভ থাকা- এসব ভাঙবার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে আপনি কি কোনো ভূমিকা পালন করতে চান? কারণ নির্মাতা ও প্রযোজকদের বেশিরভাগই কিন্তু এখনও ফেমিনিস্ট চিন্তা করতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করার সুযোগ আছে কি?

আজমেরী হক বাঁধন: অনুপ্রাণিত কি না আমি জানি না, প্রশ্নই ওঠে না হয়ত আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, প্রভাবিত করার প্রশ্ন ওঠে না মেয়েদের ক্ষেত্রে, এটা ছেলেরা খুব করতে পারেন। কারণ আমাদের এখানে তো আসলে মেয়েদের নিয়ে গল্প চিন্তাই করা হয় না। মেয়ে যদি প্রডিউসার হন তাহলে চিন্তা করে এবং যখন মেয়েটা প্রডিউসারও হন তখনও তিনি কিন্তু আসলে এমন গল্পই চিন্তা করার চেষ্টা করেন যেটা আসলে সমাজ দেখতে চায়, যেটাতে সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। আমি এটা খুব লক্ষ্য করেছি, আমি যে দু একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম, সেখানে দেখা গেছে যে বেশিরভাগ সময়ই আসলে যেহেতু এটা টাকার সাথে সম্পর্কিত সেহেতু তারা ওই রিস্কটা নিতে চান না যে আমি সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করব যে এই জায়গাগুলো কেন এরকম হচ্ছে। এই সাহসটা করাটা আসলে খুব কঠিন যেখানে টাকা সম্পৃক্ত থাকে।

আমি আমার জায়গায় নারী প্রধান কাজগুলো করতে চাই। এখন আমি এটা খুব বলি, আমি চেষ্টা করি এটা আমার ইন্টারভিউতে বলতে। আমার জায়গা থেকে আমি এটাকে স্টাবলিশ করার চেষ্টা করি যে এখানে নারী প্রধান গল্পগুলো হয় না। যেমন আমি এই ডায়লগটা দিতে চাই না, বা আমি এভাবে কাজটা করতে চাই না। কিন্তু সবসময় এটা করাটা খুব কঠিন, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার জায়গা থেকে আমি যখনই কোনো ইন্টারভিউ করি বা আমি যখন কারো সাথে কথা বলি, আমি কিন্ত এই জিনিসগুলোকে সামনে আনার চেষ্টা করি। আমি জানি এসব বলার জন্য অনেক কাজ আমার বাদ হয়ে যায়, আমাকে অনেকে অপছন্দ করে, কারণ এই কাজটা করি আমি আমার জন্য। আমি আমার সন্তানের জন্য করি। আমি চাই না আমার সন্তান এই সোসাইটিতে বিলং করুক, যা আমি সাফার করেছি তা আমার মেয়ে সাফার করুক।

আমি বলতে থাকি, এখন যেহেতু আমার একটা বলার মতো জায়গা তৈরি হয়েছে, এতদিনের চেষ্টায় এতদিন কষ্ট করার পর, আমি কিন্তু বলতে থাকি যে, ফিমেল প্রটাগনিস্টের কাজ হোক। সবচাইতে বড় কথা প্রটাগনিস্ট হলেই হবে না, আমি চাই যে নারীর গল্পটা নারীর দৃষ্টিতে দেখা হোক। এই কুৎসিত জিনিসগুলো মানুষকে দেখানোর সাহস মানুষের হোক। এই সাহস করাটা খুব কঠিন, কারণ আমি যখন বলতে থাকি যে আমার সাথে অবিচার আমার পরিবার থেকে শুরু হয়েছে, এই কথা বলার জন্য সে সাহস দরকার বা নিজেকে যে জায়গায় মানসিকভাবে নিয়ে যাওয়া দরকার সেটা আমাদের এখানে চর্চাটাই নাই। মেয়েরা আসলে মানসিকভাবে এতটুকু শক্তি নিয়ে বেড়েই উঠতে পারে না। আমি বলব না যে তাদের তা নাই, মেয়েরা কত শক্তিশালী সেটা আমি জানি, আমি কোথা থেকে আজকে এখানে এসেছি আমি জানি, মেয়েদের শক্তি নিয়ে আমার কোনো দ্বিধা নাই বা সন্দেহ নাই। আমার দ্বিধা বা সন্দেহ আছে যে জায়গাটায় সেটা হচ্ছে যে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা মেয়েটাকে এমনভাবেই শিখিয়ে পড়িয়ে বড় করে যে, সে আসলে কোনোভাবেই এই কথাগুলো বলবে না। একটা মেয়ে যতক্ষণ না পর্যন্ত তার স্বামীর দ্বারা মার খেতে খেতে ভর্তা হয়ে যাচ্ছে, এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, কিংবা মেরে ফেলছে তার আগে পর্যন্ত মেয়েটা কিন্তু একটা শব্দও করে না। কারণ সে মনে করে এটা নিয়ে কথা বলা মানেই হচ্ছে সে তার পরিবারকে ছোট করছ। সে নিজে ছোট হচ্ছে। এভাবেই কিন্তু দিনের পর দিন একটা মেয়ে তার উপরে হয়ে যাওয়া অত্যাচারগুলো সহ্য করছে।

আমাদের এখানে কেউ কিন্তু কখনও শরিয়া আইন নিয়ে কথা বলে না, আমি জানি যে এটা কেন বলে না। এটা নিয়ে কোনো আলোচনা নাই। কেন একটা মেয়ে একটা ছেলের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে, কেন এগুলো এখনও ঠিক হবে না।

কেন একটা মেয়ে ভাবতে পারবে না যে সে তার বাবার বাড়িটাও বিলং করে। আমি আমার মেয়ের কথা বলতে পারি যে, আমার মেয়ে কখনও বড় হবে না এটা ভেবে যে আমার বাসা বা আমার কিছু ও বিলং করে না। আমার কোনো ছেলে সন্তান নাই, তারপরেও যদি আমার ছেলে সন্তান থাকতো, আমি আমার মেয়েকে কখনও এটা ফিল করতে দিতাম না যে ও আমার ছেলে সন্তানের অর্ধেক, বা এ বাসাটা ওর না। আমাদের সমাজে কিন্তু বেশিরভাগ মেয়েরা, খুবই কম প্রগতিশীল বাবা মা আছেন যারা এইভাবে করে ছেলে মেয়েকে সমানভাবে বড় করেন। কিন্তু এই চিন্তাটা নিয়ে যখন একটা মেয়ে বড় হয়, এবং সে যত সাকসেসফুল হোক, তার মধ্যে কতো হীনমন্যতা তৈরি হয়, সে নিজেকে কতো অসহায় বোধ করে, তার যাওয়ার একটা জায়গা থাকে না, তার বলার একটা জায়গা থাকে না, এটা নিয়ে আমরা কেন কথা বলি না, এটা নিয়ে আমরা কেন ভাবি না, এটা আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়।

শারমিন শামস্: আপনার শাড়ি নিয়ে, লাল গালিচায় ছোট পোশাক নিয়ে তুমুল চর্চা চলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আজমেরী হক বাঁধন: এটা অবশ্যই এক ধরনের স্ট্রেস ছিল আমার জন্য যে রেড কার্পেটে আমি কী পরে হাঁটব। এবং কী করব। যেহেতু আমি বাংলাদেশের প্রথম অভিনেত্রী যে কানের রেড কার্পেটে অফিসিয়ালি হাঁটবে – তাই এটাও একটা বিষয় হবে যে আমি কী পরছি। কিন্তু অবশ্যই এটা নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হয়েছে। আমি যদি এটার পজিটিভ দিকটার কথা বলি, অবশ্যই এটা আমার ভালো লেগেছে যে দেশের বাইরের মিডিয়াগুলোতে আমাদের দেশের জামদানি নিয়ে এতো আলোচনা হয়েছে, যেটা আমাকে একটা ভালো লাগার অনুভূতি দিয়েছে। কারণ আমাদের সিনেমার সাথে সাথে আমি যে আসলে আমার দেশের একটা ফেব্রিক পরেছি ওখানে এবং আমার দেশের কালচারটাকেই ওখানে নিয়ে গেছি এটা নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, এটা আমার ভালো লেগেছে অবশ্যই।

আমি যখন ওখানে যাই, এরকম না যে আমি সবগুলো কাপড় খুবই এক্সক্লুসিভ পরেছি, খুবই এক্সপেনসিভ পরেছি, আমি কিন্তু অনেক সাধারণ কাপড়ও পরেছি, এরকম না যে আমার সবই ব্র্যান্ডের কাপড় ছিল। আমার ডিরেক্টর একটা কথা বলেছিলেন আমাকে, সেটা হচ্ছে যে, তুমি ওখানে যাচ্ছ তোমার কাজ নিয়ে, তোমার কাজ নিয়ে কথা হবে, তোমাকে চিনবে তোমার কাজের মাধ্যমে। তুমি তোমার দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে যাচ্ছ তোমার কাজ দিয়ে, তুমি কী কাপড় পরেছো এটা দিয়ে তুমি তোমার দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছো না। সো তোমার ব্র্যান্ড নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তুমি নিজেই ব্র্যান্ড। এই কথাটা আসলে আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। কারণ আসলে আমার অনেক স্ট্রেস হচ্ছিল যে ওখানে সবাই এত দামি দামি কাপড় পরবে, এত ব্র্যান্ডের, মানে ওখানে যেটা হয়, এগুলোতে ফোকাস হয়। আমি কিন্তু খুবই সিম্পল কাপড়ও পরেছি, খুবই সাধারণ। আমার এমনও কাপড় আছে যেটার দুই তিন হাজার টাকা দাম। এবং আমি সেটা ওখানে পরেছি। আমার কোনো কষ্ট হয়নি। আমার বরং ভালোই লেগেছে, আমার মনে হয়েছে অ্যাটলিস্ট বাংলাদেশের মানুষ কিছু জিনিস তো পজিটিভলি নেওয়া শিখেছে। আমাকে সারাজীবন এত বেশি নেগেটিভিটি এত বেশি ক্রিটিসিজম সারাজীবন শুনতে হয়েছে, এত বেশি মানুষের বাজে মন্তব্য শুনতে হয়েছে, তার মাঝে অবশ্যই এটা নিয়ে যখন ভালো কথা হচ্ছে, ভালো লেগেছে। কিন্তু আমি সবচাইতে বেশি আনন্দিত হয়েছি যে কানে আমাদের কাজটা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। কানে আমাদের সিনেমা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমার অভিনয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমার ডিরেক্টরের স্কিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ঐটা আমাকে অন্য রকমের একটি ভালোলাগা দিয়েছে। ঐটাই আসলে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

কাজের ব্যাপারটা আসলে শাড়ি কাপড় এসবে হারিয়ে যাক সেটা আমার পছন্দ না কখনোই। আমি সবসময় মনে করি যে, একটা মানুষের পরিচয় কখনও কোনো বস্তু দিয়ে হতে পারে না, এটা তার কর্ম দিয়ে হতে পারে। অবশ্যই তার কর্মের মাধ্যমে তার আইডেন্টিটি হবে। সে কী কাজ করছে, সে কেমন মানুষ, এটা তার আইডেন্টিটি হবে। সে কোন ব্র্যান্ডের কাপড় পরেছে বা কী কাপড় পরেছে এটা তার কখনও আইডেন্টিটি হতে পারে না। কিন্তু ডেফিনেটলি যদি কেউ নিজেকে অন্যভাবে প্রেজেন্ট করতে পারে এবং সেটা যদি কারো কাছে সমাদৃত হয়, সেটা ভালো লাগা দেবে। আবার সমাদৃত না হলে সেটা নিয়ে যে আমি খুব বেশি আপসেট হই সেরকমও না। কারণ আমাকে সবার ভালো লাগবে এটা আসলে যেমন অন্যের দায় না, সেরকম আমারও আসলে এটা দায়িত্ব না যে সবাইকে ভালো লাগাতে হবে। আমাকে যারা পছন্দ করে, করবে, যারা পছন্দ করে না, তারা করবে না, আমার আসলে এখানে কিছু করার নেই।

এই লড়াইটা আসলে আসলে তো আমার নিজের তাই আমি স্থির রাখতে পারি। এখানে একটা ব্যাপার আছে, এই লড়াইটা কিন্তু সবাই লড়তে চায়, এটা আমার রিয়েলাইজেশন। কিন্তু এই লড়াই যে তারা লড়তে চায়, এটাও মেয়েরা বলতে পারে না, কারণ আমরা এরকম একটা সমাজ বিলং করি – এটা আমার রিয়েলাইজেশন। আমাকে জিতে যেতে দেখলে আমি যখন মেয়েদের চোখে আসলে ওদের মুক্তিটা দেখতে পাই, তখন আমার কাছে মনে হয় যে এই মেয়েগুলো কতো অসহায় যে তারা এটা বলতেও পারে না যে আমরা এটা চাই না। আমরা আমাদের অধিকার চাই। আমরা আমাদের স্বাধীনতা চাই। সো এই জায়গাটা এত ক্রিটিক্যাল, এত কমপ্লেক্স যে, আমি জানি না যে এটা থেকে মুক্তি কীভাবে হবে। কিন্তু আমি আমি এতটুকু রিয়েলাইজ করতে পেরেছি যে এটা থেকে মুক্তি আমাকে পেতেই হবে।

শারমিন শামস্: মিডিয়া জগতের পুরুষতান্ত্রিক আচরণকে কীভাবে সামলান?

আজমেরী হক বাঁধন: এটা তো আসলে আমার পরিবার থেকে প্রথম শুরু। আমার পরিবার থেকেই আসলে এই সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন অসঙ্গতির শিকার। এবং সেই শুরুটার কোনো শেষ নাই, সেটা আমি সবসময় সাফার করেছি। এবং মিডিয়াতে তো ডেফিনেটলি করি। সবচাইতে বড় কথা যে সমস্যাটা হয়, যেহেতু এক ধরনের গ্লামারাস ইমেজ আমার আছে সেই ইমেজের সাথে আবার আমার কথা বা আমার চিন্তা চেতনার একটা সম্পূর্ণ বিপরীত, সাংঘর্ষিক একটা অবস্থানে আসলে আমার অবস্থান মিডিয়াতে। কারণ যেহেতু আমি খুবই গ্ল্যাম গার্ল, মানুষ মনে করছে যে ও আচ্ছা ও তো নায়িকা, নায়িকাসুলভ আচরণগুলো যেগুলো তথাকথিত নায়িকাসুলভ আচরণ, আমি এটা কাউকে ছোট করার জন্য বলছি না। বাট হয় না যে, মেয়েরা খুব কোমল হবে, নমনীয় হবে সব ব্যাপার মেনে নেবে। কাজ পাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা থাকবে, যে কোনো মানুষের যে কোনো আচরণ মেনে নেওয়ার জন্য তারা সব সময় প্রস্তুত থাকবে, আর আমার মতো একটা স্টেজে এসে তো ডেফিনেটলি আরও রেডি থাকবে। যখন থেকে আমি কাজ করা শুরু করেছি তখন থেকেই খুব সাফার করা শুরু করেছি, এখন তো আরও করছি, যেহেতু এখন আমি আর কোনো শেকলকে আর আমার পায়ে মাথায় রাখতে দেব না তাই এটা নিয়ে বিভিন্ন রকমের হেনস্থার শিকার আমাকে হতে হয়। এমনকি যখন আমি দেশের বাইরেও কাজ করতে গিয়েছি, ওখানেও অনেক কিছু আমাকে ফেস করতে হয়েছে, এটা আমাকে কিন্ত প্রতিমুহূর্তে ফেস করতে হয়। এটা শুধু আমার কাজের ক্ষেত্রে না এটা আমাকে প্রতি মুহূর্তে ফেস করতে হয়। এটা আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা মেয়ে আসলে সবসময় ফেস করতে থাকে।

সামলানোর ব্যাপারটা হচ্ছে— সামলাতে পারি না আল্টিমেটলি। আমার উপরে সবাই বিরক্তই থাকেন এবং ওই যে আপনাকে আমি আগেও বলেছি যে ওই কথাটা বলে, বাঁধন তুমি যতক্ষণ চুপ থাকো ততক্ষণ খুব ভালো লাগে, যখন তুমি কথা বলা শুরু করো তখন আসলে কিছু ভালো লাগে না। কারণ আমি যে কথাগুলো বলি সে কথাগুলো শুনতে আসলে মানুষের ভালো লাগে না। আমি যে বিষয়গুলো নিয়ে আপত্তি জানাই বা আমি যখন প্রতিবাদ করি তখন সেটা অবশ্যই সবার কাছে খুবই বিরক্তিকর মনে হয়। এবং মিডিয়াতে এরকম প্রচলিতও আছে যে, আমার মাথা খারাপ। বেশিরভাগ সময় প্রতিবাদ যখন করে মেয়েরা, হয় সে ডাইনি হয়ে যায় – আমি আগের গল্প বা ফিল্মগুলোতে দেখেছি যে তাদের ডাইনি বানানো হয় অথবা তাদের খারাপ মেয়ে বানানো হয় অথবা তাদের পাগল বানানো হয়। আমার ক্ষেত্রে এ সবগুলো শব্দই প্রচলিত আসলে।

যেমন এত বড় একটা সাকসেসের অংশ আমি, কিন্তু অনেকে আছে, তারা অনেক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা অনেক জানেন বুঝেন বলেই জানি, এই সাকসেসের ব্যাপারে কথা বলার সময়, বা ফেসবুকে পোস্টে এমনকি আমার নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করেন না। ব্যাপারটি এমনিতে মনে হবে আসলে সিনেমার অংশই তো এটা তেমন কিছু নয়। কিন্তু আমি যেটা দেখেছি সিনেমায় নারীর সাকসেসকে তারা উল্লেখ করতে চান না, তারা বুঝাতে চান এটা পুরুষের দ্বারাই অর্জিত হয়েছে। যদি কোনো সিনেমার সাকসেসের অংশ নারী হয় তাহলে তারা বুঝাতে চান— ‘না ঠিক আছে ভালো, কিন্তু এই নারীর সাকসেস এটা আসলে তাদের সাপোর্টেই হয়েছে।

আমি জানি না তারা কোন চিন্তা থেকে আমার নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করতে দ্বিধাবোধ করেন। এটি আসলে আমাকে হার্ট করে না, আমাকে বরং বিরক্ত করে।

শারমিন শামস্: পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা খুব কঠিন। এ লড়াইয়ে আপনি নিজেকে স্থির রাখেন কীভাবে?

আজমেরী হক বাঁধন: পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা তো কঠিন না শুধু, এটা প্রায় অসম্ভব একটা লড়াই। খুবই হাস্যকর একটা কথা আপনার সাথে আমি শেয়ার করি। সেটা হচ্ছে, আমি যখন বলতে থাকি যে আমি ফেমিনিস্ট, আমি আমার অধিকারটা বুঝে পেতে চাই, আমি আমার সন্তানের জন্য চাই, তখন অনেক মানুষ আমাকে বুদ্ধি দেওয়ার জন্য ফোন করে আমি যাতে এটা না বলি। আপনি চিন্তা করেন, আমার ৩৭ বছর বয়েস, আমি এডাল্ট, আমি নিজের জীবিকা নিজে নির্বাহ করি, আমি কারো উপরে ডিপেন্ডেন্ট না, আমি আমার সন্তানের ভরনপোষণ দেই, আমি আমার সন্তানের লালন পালন করি। আমি সবকিছু নিজে করতে পারি কিন্তু আমি আমি একজন ফেমিনিস্ট সেই কথাটা আমি বলতে পারব না, সেটাও আরেকজন আমাকে ফোন দিয়ে বলবে বা কথায় কথায় আমাকে বুঝাবে এটা বলা ঠিক না। এবং বুঝাবে যে  ফেমিনিজম খুবই খারাপ, এবং ফেমিনিস্ট হচ্ছে একটা গালি। আপনি খুব ভালো করে জানেন, অবশ্যই এটা আপনাকেও ফেস করতে হয়, কিন্তু আমি যেহেতু নায়িকা, আমার সাথে তো এটা একেবারেই যায় না। আমার কাজ চলে যাবে আমার দর্শক চলে যাবে এবং অবশ্যই আমার ভক্তরা চলে যায়।

আমি জানি না আপনি এটা দেখেছেন কি না, আমাদের মিডিয়া জগতে কাজ করেছেন অভিনয়ও করেছেন, তিনি খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, এবং সেই মন্তব্যের বিষয়ে আমি কথা বলেছি। যখন আমি বলেছি তখন আসলে অনেকে আমাকে গালিই দিয়েছে কিন্তু, কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছে যে শুধু শুধু সবকিছুর মধ্যে নাক গলাচ্ছি আমি। কিন্তু এটা যে সবকিছুর মধ্যে নাক গলানো না, এটা যে আমি আমার জন্যই বলছি, এটুকু বোঝার ক্ষমতাও আসলে আমাদের সমাজের মানুষের নেই।

এ লড়াইটা তো আসলে আমার নিজের জন্য। এবং সবচাইতে বড় কথা এ লড়াইটা আমার সন্তানের জন্য। আমি আমার সন্তানকে আমার জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। এই সমাজকে আমার সন্তানকে বিলং করতে দিতে চাই না। আমি অবশ্যই চাই না যে আমি যা যা সাফার করেছি, সেটা আমার সন্তান করবে। এ লড়াইটা খুব কঠিন। শুধু কঠিন না এটা হয়ত অসম্ভব লড়াই, কিন্তু সে লড়াইটা আমার করতেই হবে। কারণ আমি এটা বুঝেছি যে, লড়াই করা ছাড়া আমরা এখান থেকে মুক্ত হতে পারব না। সেই লড়াইটা প্রথম শুরু করতে হবে নিজের সাথে নিজের। নিজের সন্তানকে তৈরি করার লড়াইটা অবশ্যই তার পরের প্রায়োরিটি হবে। এবং তার পরে যদি সমাজে কিছু করা যায়। কারণ এভাবে চুপ করে বসে থাকলে কিছু হবে না। আমার মা যেটা আমার সাথে করেছে আমি সেটা আমার সন্তানের সাথে করব না। আমি আমার সন্তানকে কখনোই বলব না যে তুমি নারী তুমি সয়ে যাও। আমি এটা কোনোদিন করব না, অসম্ভব।

শারমিন শামস্: সন্তানের অভিভাবকত্ব আদায় করেছেন। অভিনীত সিনেমা নিয়ে কান এ পৌঁছুলেন। সবই আপনার দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। নিজের এই সব পেশাদার ও ব্যক্তিগত সাফল্যকে কীভাবে উদযাপন করেন?

আজমেরী হক বাঁধন: আমি যে খুব বেশি উদযাপন করতে পারছি এরকম না। এটা খুবই দুঃখজনক, আমি সিভিয়ার ডিপ্রেশনের পেশেন্ট। আমার ১৯ বছর বয়েস থেকে আমার ডিপ্রেশন এবং এটা ক্রনিক ডিপ্রেশন। আমি এটা থেকে বের হতে পারি না। আমাকে কন্সট্যান্ট এটার সাথে লড়াই করতে হয়। আমি গত এক মাস যাবত আবার নতুন করে ওষুধ খাওয়া শুরু করেছি। অনেক বছর পর আবার আমাকে খেতে হচ্ছে। খুব যে উদযাপন করতে পারি সেরকম না, তবে আমার অবশ্যই ভালো লাগে যখন আমি এটা অনুভব করি যে আমি যখন আমার সন্তানের জন্য এই লড়াইটা করেছি এবং আমি যখন জিতে এসেছি আমার তখন লড়াইটা ছিল শুধুমাত্র আমার সন্তানের কাছে আমি হেরে যেতে চাইনি। আমি সন্তানের চোখে হেরে যেতে চাইনি। আমি যদি ওইদিন হেরে যেতাম তাহলে আমি আমার সন্তানের কাছে সবার আগে হারতাম। আমার নিজের কাছে তো হারতামই। আমরা তো নিজেদের কাছে জন্ম থেকেই হারছি। কিন্তু আমি আমার সন্তানকে এটা দেখাতে চাইনি যে একজন নারী হিসেবে আমি হেরে যাচ্ছি, একজন মা হিসেবে আমি হেরে যাচ্ছি। কিন্তু আমার এই বিজয়টা বা অর্জনটা যে এত মানুষের অর্জন হয়ে যাবে, এত মানুষকে সাহস দেবে, সেটা অবশ্যই আমাকে আন্দোলিত করে। আমাকে অবশ্যই অনুপ্রাণিত করে। এই দৃঢ়তাটাকে আরও শানিত করে। আমি বৈশিষ্ঠগতভাবে খুবই দৃঢ়, আমি অনেক ডিটারমাইন্ড – যদি আপনি বলেন এটাকে আরও শার্প করে কী – সেটা হচ্ছে এগুলো আসলে আমার দৃঢ়তাটাকে আরও শার্প করে। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে যে এগুলো যদি মানুষকে এভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারে, তাহলে আমি কেন আমি আর দশটা মানুষের জন্য এভাবে ভাববো না। কেন আমি আমার কাজটা করব না। কারণ কাজ তো শুধু ওর জন্য করছি না, এটা আমার কাজ, আমার জন্য করছি। আমার জন্য করা কাজ যদি আরেকজনকে অনুপ্রাণিত করে, আমার সন্তানকে অনুপ্রাণিত করে তাহলে আমি কেন সে কাজটা করব না। আর কানে যে কাজটা করেছি, আমি অবশ্যই আপনাকে ইনভাইট করব, আপনি অবশ্যই দেখবেন, আমার সাথে বসে দেখবেন, এই কাজটা আসলে আমি করতে পেরেছি আমার জীবনে এত ট্রমা আছে বলে। আপনারা যখন কাজটা দেখবেন, খুব কম মানুষই আছে, যারা সমাজকে আসলে নারীর দৃষ্টি থেকে দেখতে পারে। আমাদের ডিরেক্টর আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ সেটা দেখতে পেরেছেন। সে তার বোনদের সাথে অনেক বেশি কানেক্টেড, মার সাথে অনেক বেশি কানেক্টেড। তাই সে তাদের কষ্টগুলো ফিল করেছে। তাদের কষ্টগুলো ফিল করাতেই কিন্তু সে তাদের দ্বন্দ্বগুলো ফিল করেছে। কষ্টের চাইতে দ্বন্দ্বগুলো এবং ওই কনফ্লিক্টগুলো, ওই কথাগুলো। এখানে আমার বাচ্চার সাথে একটা ডায়লগ আছে। আমার বাচ্চা আমাকে বলছে যে, মা ফুটবল তো ছেলেদের খেলা। তো আমি তখন ওকে বললাম, তোমাকে এটা কে বলেছে। তখন ও বলেছে যে, ওর স্কুল থেকে বলেছে। তো এই যে খুব সূক্ষ্ম জিনিস, এই যে ছোট থেকে একটা বাচ্চার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই জিনিসগুলো যে ও অবজার্ভ করেছে এবং এভাবে যে ওর নির্মাণশৈলী দিয়ে উপস্থাপন করেছে – ও শুধু আমার ট্রমাগুলো কাজে লাগাতে পেরেছে, আমি মেথড অ্যাক্টিংয়ের মাধ্যমে হয়ত ঐটা অনেক রিয়েলিস্টিক করতে পেরেছি। কিন্তু এই এই বিশ্বাসটাও একজন ডিরেক্টরকে আমার উপর করতে হয়েছে। এটা খুবই সৌভাগ্যের বিষয় যে আমাদের দেশে এরকম একটা কাজ হয়েছে। কারণ আমাদের দেশে সমাজকে নারীর দৃষ্টিতে দেখা খুবই ডিফিকাল্ট।

শারমিন শামস্: ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবেন? নারী অধিকার নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো কাজ করবার ইচ্ছে আছে কি?

আজমেরী হক বাঁধন: আমি সবসময় একটা কথা বলি যে, নারীর অধিকার আদায়ে আমার আলাদা কিছু করার প্রয়োজন হচ্ছে না এই জন্য যে আমি তো নিজেই নারী, আমার স্বাধীনতাই তো আমি পাইনি। আমি আমার সন্তানের স্বাধীনতাই তো নিশ্চিত করতে পারছি না। আমার ডেফিনেটলি এটা নিয়ে কাজ করতে হবে কারণ আমি আমার অধিকার চাই, আমার সন্তানের অধিকার চাই, সাথে আমি আমার সমাজকে এই অন্ধকার থেকে বের করতে চাই। কারণ আমি এটা চাই না যে আমি বলব, আচ্ছা আমি এটা এখানে পারছি না বলে আমি ছেড়ে দিয়ে চলে যাব। আমি কোথায় যাব? আমি যখন বৃহৎ পরিসরে দেখতে যাই, তখন আমি দেখি যে আসলে এই ইনজাস্টিস, আসলে সব জায়গায়। সেটা একেক জায়গায় একেকভাবে। কিন্তু এটা সব জায়গায় রয়েছে। এবং প্রত্যেকটা জায়গায় নারীকে শুধু লড়াইটা করেই যেতে হচ্ছে এবং লড়াই করেই তার অধিকারগুলো আদায় করে নিতে হচ্ছে। লড়াইয়ের কোনো বিকল্প আমি দেখি না। আমাকে তো এই লড়াইটা আমার জন্য, আমার সন্তানের জন্য করতেই হবে। সেটা শুধু অন্য নারীর জন্য না, এটা আসলে আমার জন্য আমার লড়াই, এটা কিন্তু অন্যের লড়াই আমি লড়ছি না, অন্যের হয়ে লড়ে দিচ্ছি না, এ লড়াই আমার, আমি আমার জন্য লড়ছি। অন্যের সাথে ওই সারিতেই আমি আছি। আমি কখনও বলি না যে আমি আলাদা কিছু, আমি কখনই বলি না যে আমি একটা প্রিভিলেজড মানুষ। আমি কিন্তু খুবই কনজারভেটিভ ফ্যামেলিতে বড় হওয়া একটা মেয়ে। আমি খুবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে যেখানে আমাকে পদে পদে বাধা দেওয়া হয়েছে। আজকে আমি এখানে পৌঁছানোর পর হয়ত অনেকে আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করছেন, আমাকে নিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন, আমার আত্মীয়স্বজনরা বলছেন। কিন্তু ব্যাপারটা এরকম ছিল না, সো ওই জায়গা থেকে আসা একটি মেয়ে আমি। এবং আমি আমার সঙ্গীর কাছ থেকে যে পরিমাণের নিগৃহীত হয়েছি, যে পরিমাণের ইনজাস্টিসের শিকার হয়েছি যে পরিমাণের টর্চারড হয়েছি – সেটা ফিজিক্যালি, মেন্টালি, সেক্সুয়ালি, আইনি, সামাজিক কোনো ধরনের অত্যাচার বাদ রাখেনি। আমার হ্যারাজমেন্টের কিন্তু কোনো সীমা পরিসীমা নাই। আমি কালকেও এক জায়গায় বলছিলাম যে, আমি ধ্বংসস্তুপ থেকে আসা একটা মানুষ। আমার পাওয়ার কিছু নাই, আমার হারানোর কিছু নাই। কিন্তু আমি আমার সন্তানকে এই রকম সোসাইটি বিলং করতে দিতে চাই না। সো লড়াইটা আমার জন্য, লড়াইটা আমার সন্তানের জন্য। আমি এ লড়াইটা লড়ে যেতেই চাই। এটা এরকম না যে আমি একটা সুবিধাজনক জায়গায় আছি বলে করছি।

যেটা আমাকে অনেকেই বলে যে বাঁধন তোমার এখন কীসের এত রাগ, এখন কীসের এত ক্ষোভ – আমার তখন আরও রাগ হয়।  রাগটা এ জন্য হয় – তার মানে কি, যখন আমি সুবিধায় আছি, আমি ভালো আছি, যখন আমাকে এখন আর কোনো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না, তখন আমি চুপ হয়ে যাব? তখন আমি আরও ১০টা মেয়ের সাথে হয়ে যাওয়া অত্যাচারটা দেখব না? আমি ইগ্নোর করব? এই সিস্টেম থেকে তো আমাদের বের হতে হবে। একা তো ভালো থাকা যায় না।

আমার এই কথাগুলো হয়ত আজকে আপনি বুঝবেন, আপনার পর্যন্ত আমি পৌঁছাতে পেরেছি বলে। এই কথাগুলো কিন্তু গত তিন চার বছর যাবৎ কনস্টেন্ট বলে যাচ্ছি যে একা ভালো থাকা যায় না। আমি ভালো আছি, আমি সেফ সিকিউরড আছি এত বছর পর এসে, তার মানে এটা না যে আমি সবসময় সিকিউরড থাকব। এই সমাজের একটা নারী যদি ইনসিকিউরড থাকে তাহলে আমিও ইনসিকিউরড। এটা আমি বিশ্বাস করি।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরকে ধন্যবাদ। আমি আপনার লেখা অনেক পড়েছি। আপনাদের অনেক লেখা ও ইন্টারভিউ আমি আমার ফেসবুক আইডিতে শেয়ার করেছি।

খুবই দুঃখজনক যে আমাদের এখানে সুবিধাবাদী কিছু নারীবাদী আছেন, যাদের কথা শুনলে অনেক সময় কষ্ট হয় আসলে, আমাকে পীড়া দেয়। কারণ আমরা যখন সুবিধাজনক জায়গায় চলে যাই, আমরা তখন সত্যি সত্যি যে সমস্যাগুলো আছে সমাজে সেগুলো নিয়ে কথা না বলি তাহলে সেটা খুবই দুঃখজনক। আমি অনেক মেয়েদের সাথে মিশি, ওদের আমার ফেসবুক আইডিতে এড করি, আমার খুব ভালো লাগে যে ওরা এত প্রাণশক্তি সম্পন্ন, ওরা যখন প্রতিবাদ করে তখন মনে হয় আমার সন্তান প্রতিবাদ করছে।

শারমিন শামস্: বাঁধন, অনেক ধন্যবাদ ও ভালবাসা আপনাকে।

আজমেরী হক বাঁধন: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। অনেক দোআ থাকলো আর ভালবাসা আপু।