April 29, 2024
নারীবাদ আলোচনাফিচার ৩

পিংক কলার ফেমিনিজম কী?

সাদিয়া মেহজাবিন ।। নারীরা মহাবিশ্বে বিচরণ করছে, চাঁদ, মঙ্গল গ্রহে পা রাখছে। চাঁদে যাওয়া কি নারীর ঠিকাদারি পেশা – সর্বক্ষেত্রেই একবার শুনতে হয়েছে ‘এসব তো মেয়েমানুষের কাজ না, মেয়েদের উচিত তাদের নিজের কাজ করা’। তবে মেয়ে মানুষের নিজের কাজটাই বা কী? কেবল নারী বলে কি নির্ধারণ করে দেওয়া যায় তার পেশা কী হবে?

১৯৭০ দশকে আমেরিকায় সর্বপ্রথম ‘পিংক কলার’ টার্মটি ব্যবহার করা হয়। ‘পিংক কলার’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছিল লেখক ও সমালোচক লুইস কাপ্প হোয়ের মাধ্যমে। ‘পিংক কলার জব’ বলতে প্রথমে নারীর কাজের কথা উঠে আসলেও ধীরে ধীরে এটিকে নিচু কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। যেমন নার্সিং, রেস্টুরেন্টের কর্মী, গৃহকর্মী ইত্যাদি। হ্যাঁ, কেবল নারী বলেই তার পেশা নির্ধারণ করা হতো ১৯৭০ দশক থেকে। বর্তমানে তার প্রয়াস ও প্রভাব কোনোটিই কমেনি।

মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নারীদেরকে জোর করে পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্ধারিত শ্রমে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তখনই পিংক কলার কাজগুলোর ধারণা তৈরি হয়। গতানুগতিক ধারায়, পিংক কলার কাজ হলো পুরুষদের দ্বারা নির্ধারিত ও শাসিত কম বেতনের কাজ। ‘পিংক কলার’ এর নেপথ্যে ছিল বৈষম্য, অত্যাচার, শ্রমিক শোষণসহ নারীর অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার চেষ্টা। ‘পিংক কলার’ কাজের প্রভাবে তখন যেমন নারীদের পেশাগত উন্নতি হচ্ছিল না, তেমনি তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নামছিল। পিংক কলার কর্মী নারীকে রাখা হয় শ্রমশক্তির মূলধারার বাইরে, সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদনশীলতার মূলস্রোত থেকে দূরে। তার মজুরি ও বেতন সবই হয় কম। কারণ সে হয় পুরুষের সহকারী, সাহায্যকারী ইত্যাদি। আসল কাজ করবে পুরুষ, আর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করবে নারী। নারীর কোনো পদোন্নতি হবে না। ভালো কাজে নারীর প্রবেশাধিকার থাকবে না। তার মজুরিও বাড়বে না। সে শ্রমের ভেতরে থাকবে, কিন্তু থাকবে একটি নির্দিষ্ট সীমায়, পুরুষের অঙ্গুলি হেলনেই তার পেশা ও কাজ চলবে।

‘পিংক কলার নারীবাদীরা’ তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ তুললেন। লেখক ক্যারিন স্ট্যালার্ড, বারবারা এহরেনরেইচ এবং হলি সক্লারসহ অনেকে ‘পিংক কলার ফেমিনিজম’র নিয়ে বলতে শুরু করেন। তারা পিংক কলার কাজের পরিণতির দিকে নজর দেন। নারীদের দরিদ্রতা, মজুরী বৈষম্য, পেশাগত বৈষম্যসহ অন্যান্য দিক নিয়ে লেখা শুরু করেন। তারা এও দেখান এ সবগুলো সূচকই কিভাবে নারীর সুস্থ-সুন্দর জীবনের অন্তরায়। ‘পিংক কলার ফেমিনিজম’ আরো তুলে ধরে ‘পিংক কলার গ্যাটো’ শব্দটি যেখানে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করতে পারে কম মজুরী পাওয়া, অধিক শ্রম করানো এবং ক্যারিয়ারে উন্নতির সুযোগ না দেওয়াকে।

পিংক কলার ফেমিনিজমের সাথে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উত্থাপিত হয়েছিল, তা হলো ‘ফেমিনিজাইশন অব পোভার্টি’। পিংক কলার কাজে নারীর প্রতি এ বৈষম্য চরম দরিদ্রতায় ফেলে। নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা খর্ব হয় এবং পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ায়। ফলে নারীর অভিভাবক হিসেবে পুরুষ স্বামী বা পিতা রূপে শোষণের সুযোগ বেড়ে যায়। তাছাড়া যেসব  নারী সম্পর্কে বিচ্ছেদ চাইছে তাদের জন্যে বিষয়টা আরো জটিল করে তোলে এবং ভারসাম্যহীনতায় ভোগায়। পিংক কলার কাজের অন্যতম বিশাল প্রভাব পড়েছে সমকামীদের উপর। কেননা একত নিষিদ্ধ সমপ্রেমে উভয়ে যদি নারী হন এবং তাদের পিংক কলার বৈষম্যের শিকার হতে হয় তবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

পিংক কলার বৈষম্য আরো বয়ে আনে বর্ণ বৈষম্য। একক ও শ্যামবর্ণের পরিবারের জন্যে এ সময় ছিল কালরাত্রির মত। পিংক কলার বৈষম্যের ফলে নারীর উপর যৌন সহিংসতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সহিংসতার শিকার বেশিরভাগ নারীই বিচার প্রক্রিয়া দিয়ে যেতে পারতেন না, যদি কেউ বিচার চাইত তবে তাকে উলটো দোষী ও চরিত্রহীনতার খেতাব দেওয়া হতো।

পিংক কলারের একমাত্র ভালো দিক হয়তো পিংক কলার ফেমিনিজম। কেননা নারীবাদীরা তখন সক্রিয় হয়ে তাদের প্রতিবাদী অবস্থান জানান দেন। ফলে সরকারসহ অনেকে এ বিষয়টিতে নজর দেয়। বৈষম্যের শিকার হওয়া ব্যক্তি যদি নাই জানে সে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তবে সেখানে প্রতিকারের উপায় থাকে না, অন্যায়কে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। পিংক কলার নারীবাদীরা তাদের প্রতিবাদ ও উত্থাপিত বিষয়ের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছে বৈষম্যকে এবং সকলের অবস্থান তৈরি করেছেন। ফলে অনেক সাধারণ নারী উজ্জীবিত হয়ে, নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হতে পেরেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *