May 16, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

সভ্যতা নারীবাদীদের কাছে আজীবন ঋণী থাকবে

উসমান খাজা রুদ্র।। আমাদের দেশে এমন সব লোক রয়েছে, যারা ‘নারীবাদ’ শব্দটা দেখলেই আহত বোধ করে। কেননা ‘নারীবাদ’ মেনে নেয় না তাদের পুরুষতান্ত্রিক বিধাতার রীতিনীতি আর ভণ্ডামি। ‘নারীবাদ’ মেনে নেয় না পুরুষতান্ত্রিকদের লাঞ্ছনা বঞ্চনা এবং গঞ্জনার জীবন। ‘নারীবাদ’ বারবারই প্রলয়ঙ্করী হুঙ্কার দিয়ে শ্যাওলা-ধরা পুরুষতন্ত্রের দেয়াল ভাঙায় ব্রত। ‘নারীবাদ’ সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় লৈঙ্গিক বৈষম্যবিহীন নারীপুরুষের সমানাধিকারকে। ‘নারীবাদ’ সমাজে পিছিয়ে যাওয়া, অবহেলিত নির্যাতিত নিপীড়িত বঞ্চিত নারীদের অধিকার আদায়ে কথা বলে।

নারীর কোনো অবদানকে মানতে পারে না পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদীরা। হাজার বছর ধরে পুরুষতন্ত্র এটিই করে এসেছে। পুরুষতন্ত্র নারীকে বন্দি করতে চেয়েছে, নারীকে লুকোতে চেয়েছে আরও গভীরে। পুরুষতান্ত্রিকেরা নিজেদের স্বার্থের জন্য বানিয়েছে নানা রূপকথা ও উপকথার গল্প, যা নারী হাজার বছর ধরে বিশ্বাস করে এসেছে ঐশ্বরিক হিসেবে। পুরুষতান্ত্রিক আর পুঁজিবাদীদের মাঝে মিল লক্ষণীয়। তারা উভয়ই নারীকে দেখে থাকে একদলা মাংস আর ভোগ্যবস্তুরূপে। আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে। যে কারণে পুরুষতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদীদের আঁতে ঘা লাগার মতোই ‘নারীবাদ’ বিষয়টি।

আমরা জানি যে আমাদের দেশে প্রতিক্রিয়াশীলেরা ধূপকাঠির ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারপাশে। যারা ‘নারীবাদ’ বিষয়ক কোথাও ইতিবাচক আলোচনা অথবা সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। যারা সুযোগ পেলেই নারীবাদীদের উপর চড়াও হয়ে থাকে এবং তাদের নামে অপবাদ রটিয়ে বেড়ায়। যারা দমিয়ে দিতে চায় নারী অধিকার আন্দোলনকে। যারা চায় না নারীর মুক্তি ঘটুক। যারা চায় না যে নারী তার নিজের পছন্দসই সিদ্ধান্ত নিক। তারা যা চায়; তা হলো, নারীকে নিজেদের করতলে চেপে রাখতে এবং শক্তিমান স্বৈরশাসকদের মতো নারীদের উপরে আধিপত্য বিস্তার করতে। ফলে আজও তারা প্রকাশ্যে ধর্মীয় সভা-সমাবেশে নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে থাকে। তারা আজও মনে করে থাকে যে, নারী একটি সন্তান উৎপাদক যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। তারা ভাবে নারী পরিণত হলে যত তাড়াতাড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে মুক্ত হওয়া যায়। তারা নারীকে বিকশিত হতে দেয় না। অনেকাংশে তারা নারীকে মানুষই মনে করে না। নারীরও যে চাহিদা, ইচ্ছে, কাম, অভিলাষ; আকাঙ্ক্ষা, শক্তি, বুদ্ধি রয়েছে সেটি তারা কিছুতেই মানতে চায় না। কখনো কখনো নারীকে তারা ‘অসহায়’, ‘অবলা’ বলে সহানুভূতি প্রদর্শন করে থাকে। এদিকে বাচ্চা জন্মদান মোটেও সুখকর বিষয় নয়। এটি নারীর ব্যক্তিগত ইচ্ছে। কিন্তু এটিকে ‘নারীর জীবন সার্থক’ বলে তারা হাজার বছর ধরে চালিয়ে এসেছে।

যুগে যুগে শুধুই পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রনায়ক, কবি-সাহিত্যিক, অশ্লীল ধর্মগুরু; সমাজপতিরাই যে নারীবাদের ঘোরবিরোধী তা নয়। পুরুষতন্ত্রের মগজবাহী অনেক নারীও এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে নারীবাদ’কে ঘৃণা করে; নারী অধিকার এবং প্রথাভাঙার আন্দোলনকে কুৎসিত মনে করে থাকে। আর আমি একজন পুরুষ হয়ে সবচেয়ে বড় কষ্ট পাই তখনই, যখন দেখি একজন নারী তার পরম অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে জঘন্য বলে ঘৃণায় দূরে সরিয়ে দিচ্ছে এবং তার মর্মার্থ অনুধাবন করতে পারছে না বলে। হয়তো সে তার মাথায় পুরুষতান্ত্রিকদের চাপিয়ে দেয়া মগজ বহন করার ফলে সঠিকভাবে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে না।

মজার কথা হলো এদের বড় একটা অংশই আপাদমস্তক প্রগতিশীল। যারা কবিতা লেখে, ছবি আঁকে, গান গায়। যারা আবার বিশ্ববিদ্যালয় পাঠগ্রহণ শেষ করে স্বামীর ঘর অলংকৃত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আত্মনির্ভরশীল হওয়াকে ঘৃণা করে। যেন পড়াশুনোর কোনো দাম নেই। এরাই আবার সুযোগ পেলে নারীবাদীদের পিণ্ডি চটকাতে চায়। এদের বাইরে থেকে দেখলে বুঝতে পারবেন না যে এদের মগজও ধারকৃত। এদের ধারণা, পুরুষতান্ত্রিকদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীদের নাকি অধিকার আদায় করতে হবে। এই কথা ধরে বলা যায়, যদি সেটিই হত তাহলে দেশে দেশে আজও নারীরা করুণভাবে নির্যাতিত বঞ্চিত নিপীড়িত হতে হচ্ছে কেন? স্বভাবতই এসব নারীও উপরে বর্ণিত নারীদের মতোই পুরুষতান্ত্রিকদের ধমক, লাত্থি, চড়, থাপ্পড়কে মনে করে স্বর্গপ্রাপ্তির রসদ কিংবা বাচ্চা জন্মদান ‘জীবনের সার্থকতা’।

নারীবাদের পথিকৃৎ সিমোন দ্য বোভোয়ার বলেছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, নারী হয়ে ওঠে’। এই কথাটা একটু ভেঙেচুরে আমাদের পুরুষতন্ত্রের ওইসব মগজবাহীদের দিকে তাকিয়ে বললে, বলা যেতে পারে যে, ‘কোনো নারীই নারীবিদ্বেষী হয়ে জন্মায় না, ক্রমশই নারীবিদ্বেষী হয়ে ওঠে উপযুক্ত সুশিক্ষা ও আধুনিকতার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত থাকা এবং সর্বোপরি অন্যের ধারকৃত মগজে চলার কারণে’। পুরুষতন্ত্রের এই ধ্বজাধারিণীরাও ‘নারীবাদকে’ ‘কুৎসিত’ বলে, কারণ হলো ‘নারীবাদ’ বিষয়ে তারা কখনো একফোঁটাও পড়াশুনো করে নি, কিংবা করবার সেটুকু সুযোগ পায় নি। অথবা যারা অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছুক, তাদের পক্ষে ‘নারী অধিকার’ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনার সুযোগ, বা সময়, তার কোনোটিই হয়ে ওঠে না।

এসব মগজ ধোলাই নারীরা হয়তো জানে না যে, দুশো বছর আগেও আমাদের মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের প্রধান অন্তরায় ছিল পুরুষতন্ত্র। এরা জানে না যে, গত তিন থেকে চারশো বছর আগেও ইউরোপের রাস্তায় আইবুড়ো মেয়েদেরকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলা হত। তার পেছনে কলকাঠি নাড়ত ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিকেরা। এরা হয়তো দেখেও উপলব্ধি করতে পারে না যে, একটা রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা একজন মেয়ে কতভাবে কত আঙিনায় বঞ্চিত হয়। এরা জানে না যে, গত পাঁচশ বছর আগেও বিধবাকে স্বামীর সাথে জ্বলন্ত চিতায় তুলে দিত ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিকেরা। এরা জানে না যে, মধ্যযুগের প্যালেস্টাইন ও তার আশেপাশের অনুর্বর মরুভূমির অঞ্চলগুলোতে নারীকে দেখা হত ঘোড়া, গাধা এবং অভিশাপরূপে। (এবং, অনেক জায়গায় আজও তাইই দেখা হয়। অনেক বইতে তাই লেখা রয়েছে)। তৎকালে ‘ব্যভিচারিণী’র তকমা দিয়ে বহু নারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হত। এরা জানে না যে আধুনিক বাঙালি নারীবাদের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ারা মাথা না তুললে কোনো পুরুষতান্ত্রিক মোল্লা বা পুরোহিত কিংবা রাজনীতিবিদ বা অথর্ব প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী এসে নারীদের মুক্তি ও অধিকার নিয়ে কখনোই ভাবত না। আজকের দিনেও নারীকে তাদের বিষাক্ত নখর খপ্পরে বন্দি করে রাখার, নারীকে পিছিয়ে রাখার, নারীকে ছোট করে দেখার পাঁয়তারা পুরুষতান্ত্রিকেরা চালাচ্ছে। এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, পুরুষতান্ত্রিকদের এই বিষাক্ত নখর খপ্পর থেকে নারীদের মুক্তি ঘটছে কেবল নারীবাদ আন্দোলনরত একদল মানবিক মানুষের জন্যই। সভ্যতা নারীবাদীদের কাছে আজীবন ঋণী থাকবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]