November 21, 2024
কলামফিচার ৩

নিজ নিজ স্কুলে পরীক্ষা নিয়ে মেয়েগুলোকে বাঁচান!

লীনা দিলরুবা শারমিন।। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি বাস্তব ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। মেয়েটির নাম আমেনা। বয়স ১৭ বছর। আমেনার পরিবার তার বাবার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাবা করিম মিয়া বছরের অর্ধেক সময় মাছ ধরেন আর বাকি অর্ধেক সময় অন্যের ক্ষেতে কাজ করেন। প্রতি মাসে তার উপার্জন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এই টাকার ওপর করিম মিয়ার দুই মেয়ে, এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার নির্ভর করে।

২০২০ সালের লক ডাউনে করিমের কিছুটা অসুবিধা হয়েছে। মানুষ আগের মতো বেশি দামে মাছ কিনছে না। মেয়েগুলো স্কুলে কিছু টাকা পেতো নিজেদের পড়ালেখার জন্য। এখন আর সেটি পাচ্ছে না। বউ মাছের শুঁটকি বা বাড়ির মাচার লাউ বিক্রি করতে পারতো। সেটিও পারছে না।

করিম মিয়া ভাইরাস বোঝে না। ভাইরাসে মানুষ মারা যেতে পারে শুনে তার হাসি পায়। যতসব বড়লোকের অসুখ ভাবতে ভাবতে মাটিতে কোপ দেয় সে। রাগ হয়। নিজের অসহায়ত্বের জন্য কান্না পায়। বড় মেয়েটার পরীক্ষা ছিল গেল বছর। এক বছর ধরে নানাজন নানাভাবে কথা বলছে। বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে।

করিম মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটাকে তার পড়ালেখা করানোর বড় শখ ছিল। নিজের মতো মূর্খ বানাতে চান নি। কিন্তু মেয়ে কবে স্কুলে ফিরবে করিমের জানা নেই। কেউ-ই নাকি জানে না। দুবাই ফেরত পাত্রদের সাথে বিয়ের প্রস্তাব আসছে। এক পাত্রের সাথে সামনের শুক্রবার বাদ জুম্মা আমেনার বিয়ে ঠিক করেছেন করিম মিয়া।

আমেনা বিয়েতে রাজি হয়নি। তার বিশ্বাস কিছুদিন পরই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমেনার মা ক্রমাগত তাকে বোঝাচ্ছে। এমন তো না যে তারা পড়ালেখা করা অবস্থায় বিয়ে দিচ্ছে। লেখা নাই, পড়া নাই, স্কুল নাই, বসে বসে খাওয়ার খরচ বাড়াচ্ছে শুধু আমেনা। কথাবার্তার এক পর্যায়ে মা তাকে কষে একটা চড় দিয়েছে। আমেনা বিয়েতে রাজি।

বাংলাদেশে গত এক বছরে হাজার হাজার আমেনার গল্প অনেকটা এরকম।

মহিলা পরিষদ বলছে, ২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুন মাসে বাল্যবিবাহ হয়েছিল ৩৮টি। ২০২০ সালের প্রথম চার মাসে তা বেড়েছে ছয় গুন। ব্র্যাকের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বাল্য বিয়ে বেড়েছে ২.১৯ গুণ।  প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের বিল্ডিং বেটার ফিউচার ফর গার্লস প্রকল্পের তথ্য অনুসারে,  জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত শুধু কুড়িগ্রাম জেলায় ২৯১টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশে এক দিনে কতজনের বাল্যবিয়ে হয়েছে সেটি আমরা এখনও নির্ভুলভাবে জানি না। সবাই নিজেদের কাজের গণ্ডি থেকে তথ্য পেয়েছে। সে তথ্য যে নির্ভুল এই দাবিও কেউ করছে না। আমাদের টেকনোলজি উন্নত নয়। আমাদের দেশের ৭৫% মানুষ এখনও মাটির ঘরে বাস করেন। কোভিডে আমাদের পক্ষে সন্তানের পড়ালেখা চালানো প্রায় অসম্ভব।

মেয়ে সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়ার পেছনে যে প্রচলিত যুক্তি- অভাব, এটিও আমার চোখে শুভঙ্করের ফাঁকির মতো লাগে। আপনার সন্তানকে ধার করে যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেয়া সম্ভব, পড়ালেখা করানো সম্ভব না? আপনি ছেলের বিদেশে যাওয়ার টাকা ধার করতে পারেন, শোধ করতে পারেন, মেয়ের পড়ালেখাটাকে বাজে খরচ কেন মনে হয়?

এ দেশে বাল্যবিয়ে অভাবের দোহাই দিয়ে হলেও অধিকাংশ সময় অভাবের জন্য হয় না। মেয়েকে অল্পবয়সে বিয়ে দেয়া আমাদের অভ্যাস এবং ঐতিহ্য। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা ধারাবাহিকভাবে বাল্য বিয়েকে সমর্থন করেছে। আমাদের অতি শিক্ষিত আত্মীয় প্রবাসী পাত্রের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মা বাবাকে অস্থির করে ফেলেছে। আমরা তো সেই পুরনো জাতি। বদলাইনি, একটুও।

এক বছর স্কুল বন্ধ হয়ে মা বাবা, পাড়াপ্রতিবেশির চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো মেয়েটি ক্রমাগত ছোট হচ্ছে নিজের কাছে। লেখাপড়া শেষ করে একদিন বাবা মায়ের পাশে দাঁড়াবার স্বপ্নটা সচেতনভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। শহরে বাবার চাকরি হারানো, বাসা ভাড়া দিতে না পারা, প্রাইভেট টিউটরের বেতন দিতে না পারা মেয়েটিকে শহর ছাড়তে হয়েছে। গ্রামে গিয়ে এই মেয়েটি কেমন আছে?

আবার শহরের বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করা মেয়েটি পড়ালেখার বাইরে যাকে মায়ের সাথে ধান শুকানো, আমের আচার, রান্নার কাজ, বয়স্কদের সেবা, ছোট ভাই বোনকে মানুষ করার দায়িত্ব পালন করতে হয়, সে কেমন আছে? স্কুল নেই তাই সবাই বলে তার আর পড়ালেখা নেই। কবে পরীক্ষা হবে তার নিশ্চয়তা নেই। বাবার আর্থিক অবস্থার অবনতির সাথে সাথে মেয়েদের পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ কমেছে সবার। একদিন যে বাবা বড় গলায় বলেছে, মাইয়ারে মাস্টর বানামু, এখন সে কী বলে? মেয়ে কবে কলেজে পড়বে? কবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে?

এলিট বাবলে থাকা অনেকের হয়তো জানা নেই এই যে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার আশায় বসে থাকা মেয়েগুলো কিন্তু বিদেশ ফেরত, শহর ফেরত ছেলেদের জন্য পটেনশিয়াল পাত্রী। মেয়ে চিঠি লিখতে পারে, ইমোতে কল করতে পারে, হিসেব করতে পারে, বিকাশে টাকা তুলতে পারে- স্কুল বন্ধ এক বছর ধরে, কবে খুলবে কেউ জানে না… আপনি কী ভাবছেন? একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের একার পক্ষে বিয়ে আটকানো সম্ভব?

সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে বোর্ড ফাইনালের আশায় লাখ লাখ ছেলেমেয়ের কি আসলেই বসে থাকা দরকার?  জাতীয়ভাবে সিলেবাস দিয়ে সময়মত প্রশ্ন যার যার নিজস্ব স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েই কিন্তু পরীক্ষা নেয়া সম্ভব।

স্কুলের শিক্ষকেরাই তাদের শিক্ষার্থীদের বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষা নেবেন। তারাই খাতা দেখবেন। যে দেশে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাওয়ার “গুজব” রটেছে বছরের পর বছর, সেখানে এক বছরে শিক্ষার্থীরা বেশি সিজিপিএ নিয়ে পাশ করলে খুব ক্ষতি হওয়ার কিছু দেখি না।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]