May 16, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

কন্যা সন্তানরা কেন স্বপ্ন দেখতে শেখে না?

সালমা জাকিয়া বৃষ্টি।। জুঁই তার জীবনের প্রতিটি প্রতিযোগিতায় প্রতিবারই সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছিল। শুরুটা পুরোপুরি মনে না থাকলেও হঠাৎ কিছু মুহুর্ত তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিজের জীবনের চাওয়া পাওয়ার ভাবনাকে মাটি-চাপা দিয়ে ৭ বছর বয়সেই জুঁই বুঝে গিয়েছিল তার পৃথিবীতে পা রাখার উদ্দেশ্য।

অন্য কেউ না, মায়ের কাছেই তার এই শিক্ষার হাতেখড়ি। তার পিঠাপিঠি বড় ভাইটি যখন স্কুল থেকে ফেরার পর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে জামা-কাপড় ও বই-খাতা রাখতো, মা তখন নিঃশব্দে সেসব গুছিয়ে রাখলেও জুঁইয়ের বেলায় তা ছিল পুরোই বিপরীত। কারণ একটাই, ‘মেয়েদের আগোছালো হলে চলে না। সে সময় থেকেই অল্প অল্প করে জুঁই বুঝতে শেখে মেয়েরা  কী কী চাইতে পারবে আর কী কী চাওয়া যাবে না। তাছাড়া তার মায়ের সাথে বাবার চাওয়া পাওয়ার পার্থক্যের ধরন থেকেও অনেকটা ধারনা পেয়ে যায় মেয়ে আর ছেলের চাহিদা কী হওয়া উচিত। এর সাথে বিভিন্ন রকম ভালো মেয়ের উদাহরণ তো ছিলোই। তাই  জুঁই নিজের ইচ্ছেতেই কাঙ্ক্ষিত ভালো মেয়ে হওয়ার চেষ্টায় উঠেপড়ে লেগে যায়। দুনিয়ার আর কোন বিষয়ই যেন তার কাছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়না। কারণ একটাই, ভালো মেয়েদের সাথে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে হবে।

জুঁই জানতে শুরু করে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা, যেটি সমাজের তৈরি; সেই সংজ্ঞার সাথে বাবা-মায়ের প্রত্যাশাও সংযোজিত। মায়ের সাথে বাবা অথবা পরিবারের অন্যান্য মুরব্বীদের ভুমিকা থাকলেও মাকে বেশি কাছে পাওয়ার কারণে মায়ের পরামর্শই জুঁইয়ের কাছে প্রাধান্য পায়। তাছাড়া তথাকথিত ভালো মেয়ে তৈরিতে ব্যর্থ হলে মাও যে সমাজের কাছে হেরে যায়। কারণ আমাদের সমাজে সন্তানের যে কোন ব্যর্থতার জন্য মাকেই দায়ী করা হয়। তাই মায়ের চেষ্টা থাকে তার নিজের সুনাম রক্ষার জন্য। বড় হওয়ার সাথে সাথে মা ও তার নিজের যৌথ প্রচেষ্টায় রান্না আর ঘরের কাজের প্রশিক্ষণ নিলেও একই সাথে স্কুলের পরীক্ষায়ও তার ভালো ফলাফল চাই। কারণ একটাই ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’।

এরকম অসংখ্য পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ জুঁইকে প্রস্তুতি নিতে হয় সংসার জীবনে প্রবেরশর আরেক পরীক্ষার। প্রমাণ করতে হয় কতটুকু গুণ আছে তার, কারণ একটাই- ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে।’

সংসারে জুঁই পুরোপুরি পারদর্শী হয়ে উঠে সবাইকে সুখি করার মাঝেই নিজের সুখ খুঁজে পেতে। স্বামী সন্তানদের নিয়ে নিজের গাড়ি বাড়িসহ জীবনটা ভালোই কেটে যাচ্ছে। পরিচিত সবার মুখে মুখে একই কথা, ‘জুঁই অনেক ভাগ্যবতী।’

আসলেই জুঁই তার সংসার নিয়ে অনেক ভালো আছে। কোন কিছুরই অভাব নেই তাদের সংসারে। কাজে কর্মে আর সংসার পরিচালনায় তার মতো দক্ষতা খুব কম মানুষেরই আছে। আর সংসারে অশান্তি হতে পারে সেরকম কোন কাজ না করার প্রশিক্ষণ তো তার আছেই। তারপরেও জুঁই বুঝতে পারে শ্বশুরবাড়ি থেকে ভালো বউয়ের সনদপত্র পাওয়া এতটা সহজ নয় যতটা সহজ ছিলো ভালো মেয়ে হওয়া। মাঝে মাঝে জুঁইয়ের ইচ্ছে হয় অন্য রকম সুখের, ইচ্ছে হয় কেউ যেন তাকেও সুখি করার চেষ্টা করে। কিন্তু নিজের কথা আর মনের চাওয়াগুলো বুকের মাঝেই লুকিয়ে রাখে। জুঁইয়ের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। আর কাকেই বা বলবে এসব কথা? এসব কথা শুনলে সমাজ কী বলবে? কারণ আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তো বলবে, ‘সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়’।

………………………………………………………………

এটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোন চিত্র নয় । বর্তমান যুগে এরকম অসংখ্য পরিবার রয়েছে যাদের কন্যা সন্তানটি সঠিকভাবে স্বপ্ন দেখতে শেখেনি অথচ অন্যের স্বপ্নপূরনে সারাটা জীবনই পার করে দিচ্ছে। তাদের কখনো মনে হয়নি যে যারা এই ভালো মেয়ে বা বউয়ের সার্টিফিকেট দেয় তাদের সে যোগ্যতাটুকু আছে কিনা বা তাদের কথাকে এতটা মূল্য দেওয়ার কী আছে? কেন তাদের কথা ভেবে নিজের জীবনের মূল্যবান সময়গুলোকে বিসর্জন দিতে হবে? বর্তমানে এর ব্যতিক্রম কিছু পরিবার দেখা গেলেও তা সংখ্যায় খুবই কম। সমাজ পরিবর্তন হবে, তবে পরিবারকে সচেতন হতে হবে তারও আগে । তা নাহলে পারিবারিক ভুলের চাপে হারিয়ে যাবে মূল্যবান কিছু জীবনের চাওয়া পাওয়া।

সালমা জাকিয়া বৃষ্টি: চিত্রশিল্পী