November 21, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ৩

দোজখের তালাশ

মাসকাওয়াথ আহসান।। ঈদের আগের দিন সাঁঝে টুকটাক বাজার করতে বের হতে হয়। মহামারীকালে যে ওয়াইফ ওয়াইফাই হয়ে ফেসবুকে বড় বড় লেকচার দিচ্ছে গরীব মানুষের গাদাগাদি করে ঘরে ফেরার অসচেতনতা নিয়ে; হোয়াটস অ্যাপ ফ্যামিলি গ্রুপে বলছে, এতো মৃত্যু এতো হাহাকারের মধ্যে গ্রামে ফিরেই ঈদ করতে হবে কেন! এ শহর কি তোমাদের কামড়াচ্ছে! সেই নাগরিক বুদবুদের লিভিং রুম ওয়ারিয়র অ্যাকটিভিস্ট; যে প্রেসক্লাবের সামনে ‘আওরাত মার্চ’ ফ্যাশান প্যারেডে অংশ নেয় চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলে; ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে ‘আমরা বনাম ওরা’-র চক্করে পড়ে; সামাজিক পুলিশি করতে এলে ধর্মীয় ছাত্র জোটের দিকে বেসবল ব্যাট নিয়ে তেড়ে গেছে; সেই বিপ্লবী রণক্লান্ত যখন বলে, একটু টেইলর মাস্টারের কাছে যেতে হবে, ঈদের দিন পরার কাপড় নেই; বিস্ময়ের ঘোর যেন আর কাটে না।

– এইতো একটু আগে ঈদ করতে নিষেধ করলে অসচেতনজনদের; তুমি এতো সচেতনজন আবার ঈদের জন্য নতুন কাপড় বানাতে দিয়েছো!
প্রসঙ্গ দ্রুত পাল্টাতে সে বলে, পেট্রোল পাম্প থেকে কিছু টাকা ভাংতি করতে হবে। ঈদি দিতে হবে কাল বাচ্চাদের।

আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি আমাদের লিভিং রুম ওয়ারিয়র অ্যাকটিভিজমের এই বুদবুদ কন্যা; ঈদ শুধু সেলিব্রেটই করবে না; সেলিব্রেশনের আইটিনারিও বানিয়ে ফেলেছে ফোনের ডিজিটাল ‘হোয়াট টু ডু’-তে।

রাস্তার উলটো দিকে নিয়ন বাতির কনে দেখা আলোয় স্বয়ম্বর সভা করছে একটি স্নিগ্ধ চেহারার মেয়ে; গাড়ি থেকে মুখ বার করে বাইক থামিয়ে দর-দস্তুর করছে সিয়াম সাধনার বোতল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া দৈত্যেরা। করোনাকালে পাঁচ তারকা হোটেলের পিউপাপিয়ার বুলবুলি আখড়াই বন্ধ হয়ে যাওয়ায়; এ যেন ধূলায় নামিলো শশী। যেভাবে সোভিয়েত পতনের পর পূর্ব ইউরোপের মেয়েরা জার্মানিতে পালিয়ে এসে বন-কোলন বাইপাস রোডের পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতো। ট্যাক্সিক্যাবের হেডলাইটে তাদের নীল চোখ; সোনালি চুল আগুন হয়ে জ্বলতো। এক বেলা খাবার জোগাড়ের জন্য স্ট্যালিনের এলিট ফোর্সের ট্রেনিং দেয়া রেড স্প্যারো যখন গাড়ির কাঁচের কাছে এসে বলতো, আমায় তুলে নাও; তুমি যা বলবে আমি তাই করবো; আমায় শুধু একটু ব্রোডশেন আর এক টুকরা সসেজ কিনে দাও। আমি তিনদিন খাইনি প্রিয়তম।

সেই থেকে সভ্যতার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। একটা ফর্সা ফর্সা বৌ; তার বড় বড় করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিসপ্লে করা সুখ; বাচ্চা নিয়ে আদিখ্যেতা; কিচ্ছু খেতে চায় না বাচ্চা তো তাকে ডিনার টাইমে চিপসের প্যাকেট খুলে দাও; নয়তো ম্যাগডোনাল্ডস থেকে ফ্রেঞ্চ ফ্র্যায়েজ নিয়ে এসো; আমাদের ডেভিডটা বড্ড জেদি হয়েছে; নিশ্চয়ই বাপের মতো হয়েছে। এই যে খেলনা জীবন-হাহাহিহি-র সোমত্ত এফলুয়েন্স প্রদর্শনীর লেবুগন্ধী স্বর্গের বাগান; এসব রোজকার নাটকের স্পটলাইটের অলক্ষ্যে একটু ব্রোডশেন আর এক টুকরা সসেজ-এর জন্য যে শতবর্ষের বেদনার উপাখ্যান; তা চাপা পড়ে যায়। লালসার লালামাখা লোলুপ পুরুষ; একটু ব্রোডশেন আর এক টুকরা সসেজ-এর বিনিময়ে চন্দ্রমুখীর শরীর নিয়ে জাদুকর জাগলারের মতো আগুন নিয়ে খেলে; সুগন্ধী লেবুবাগানের সবটুকু লুটপাট করে নিয়ে; তারপর হোয়াট ইজ ইন ইওর মাইন্ড অন ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি পোস্টে, “কৃতজ্ঞতা তোমার প্রতি প্রিয়তমা বধূ আমার; আমাকে দুই দশক ধরে সহ্য করে চলেছ।” ফেসবুকে সেই সুখি জায়া ও পতির ছবি দেখে মনে হয়; এরা সেই স্বামী-স্ত্রী রাষ্ট্র; যারা হ্যাপি ম্যারেড লাইফের সচিত্র প্রদর্শনী করে তাক লাগিয়ে দেয়; ফেসবুকের সুখের বুদবুদে ফুল খেলতে হায়; সিলেক্টিভ জাস্টিসের সহমত ও ভিন্নমত ভাইবোন হয়।

– ঐ মেয়েটিকে যদি ঈদি দিই; তুমি কী আমায় অস্বাভাবিক ভাববে!

– তোমাকে ‘অস্বাভাবিক’ জেনেই তো ভালোবাসি; ঈদি তুমি দিতেই পারো; কিন্তু এই এলাকাটায় করোনাকালে ছিনতাই বেড়েছে; প্রস্টিটিউশান বেড়েছে। একজনকে ঈদি দিলে আরো অনেকে দৌড়ে আসবে; আর ছিনতাইকারী রিভলভার ঠেকিয়ে তোমার ওয়ালেট নিয়ে যাবে। চয়েস ইজ ইওরস।

এরা হচ্ছে পূর্ব-সংস্কারের রাজকন্যা; এদের চলন্ত বাণী চিরন্তনী বাবা-মা জীবনের পদে পদে তাদের সাবধান করে বড় করেছে; ঐসব হিতোপদেশই তারা স্বামীর সামনে ধারাভাষ্যের মতো করে আওড়ায়। অথচ ওখানে ঐ সুরঞ্জনা ক্ষুধায় পথে নেমেছে; ল্যান্ড ক্রুজারে চড়ে ইক্ষুকল মালিক সমিতির প্রাকবৃদ্ধ রাজপুত্ররা ‘সুগার অ্যাসোসিয়েশান অফ ড্যাড’ (স্যাড) হয়ে ঘুরছে; চাঁনরাতে চন্দ্রমুখীর ললিতলোভনকান্তি মাংসের মৃগয়ার খোঁজে। পাকস্থলীতে যার ক্ষুধার হাহাকার; তার হৃদয় এখনো প্রেম থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে। অথচ তার দিকে ব্রোডশেন আর সসেজ ছুঁড়ে দিয়ে নতুন জমিদারেরা বলে, নাচ বাসন্তি নাচ।

ওয়াইফাই এবার তার এক্টিভিজমের ফুল মুডে চলে গিয়ে বলে, সভ্যতার বিনোদন এই পর্যায়ে নেমেছে যে একটা নারীর শরীরকে খেলনা বানিয়ে ইজরায়েলের মতো ‘ফিলিস্তিন-ফিলিস্তিন’ খেলতে হবে। আর কতোদিন নারীকে এরকম সভ্যতার যৌনদাসী হয়ে কাটাতে হবে!

– তুমিই তো ছিনতাইকারীর ভয় দেখালে; নইলে তো ও ঈদি নিয়ে ঘরে ফিরতে পারতো; ছোট ভাইয়ের জন্য চকোলেট; মায়ের ওষুধ আর বাবার জন্য টুপি কিনে; হয়তো পাড়ার শংকর মুদি’র দোকান থেকে ঈদের টুকটাক বাজার করে ফিরে; অন্তত আজ রাতের জন্য সুখি হতে পারতো সবাই মিলে। এটুকু তো আমাদের সাধ্যের মধ্যেই ছিল। তুমিই তো তাকে দাঁড় করিয়ে রাখলে অনিশ্চয়তায়।

– এইভাবে প্রতিদিন আমাকে গিলটি ফিলিং দেয়াটা তোমার নেশায় পরিণত হয়েছে; তুমি কি বোঝো এটা। এটা তোমার মনের রোগ; এই রোগটা খুব অবোধ্য। তুমি পাশের মানুষকে ছেড়ে দূরকে পাশে ডাকো। এ ছাড়া তোমার মন বসে না; বাঁচতে ইচ্ছা করে না। আমাকে ভিলেইন বানিয়ে তোমার কী লাভ বুঝিনা। আমি তো অতো শ্যালো না; আমি আমার সাধ্যমত আমার জগতে প্রতিদিন যারা আসে; যাদের সাহায্যে আমাদের জীবন চলে; তাদের প্রত্যেকের ঘরে বসে ঈদটুকু আনন্দে কাটানোর ব্যবস্থা করেছি আমি। আর তুমি আমাকে চান্স পেলেই কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো শোনাও।

– তুমি তো এইটুকুই দেখেছো; যতটুকু আলোয় ধরায় পড়ে; কিন্তু অন্ধকার আমাকে জানিনা কেন কীভাবে টেনে হাত ধরে নিয়ে গেছে অদেখাকে দেখতে। যে আমাকে বলে, পাশে এলেই তুমি আমাকে পাবে; ওভাবে বুদবুদে বসে সিনেমা-নাটক-উপন্যাসে আমাকে যতটা দেখো; ওতো কিছুই নয়। এ যেন গোলকধাঁধা; কোন রহস্যের বান্ধবি সে! খুঁজি তাকে খুঁজি।

– অ্যান্টি প্রস্টিটিউশানের দাবিটা প্রথমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে! তারপর নিয়ে যেতে হবে পার্লামেন্টে। অবশ্য তাতে তোমার প্রবলেম হবে না তো; গুড়িয়ার নাচ দেখতে গিয়েছিলে তুমি। এটা ফোর না সিক্স মারলাম; হোয়াট ডু ইউ থিংক?

– এটা ছক্কা; বল আকাশে ভেসে স্টেডিয়ামের বাইরে বেরিয়ে ট্রাকে চড়ে যাত্রা শুরু করেছে। আপনে জিতছেন আফা।

গুড়িয়ার নাচের রাতেই আবিষ্কার করলাম, গুড়িয়ার একটাই স্কিল; তা হচ্ছে নাচ; ফলে সে নিজেই এই প্রফেশন বেছে নিয়েছে। তাকে কেউ জোর করেনি। সে তার ঘোটকি গ্রামের জমিদার, নতুন রাজনৈতিক জমিদার, তাদের ফুটসোলজারদের তুফান থেকে বাঁচতে মহানগরে পালিয়ে এসেছে। তারপর থেকে এই মোহন ঘোটকি মেট্রোপলিটানের নতুন পয়সাওয়ালাদের লুট করে নিজের গাড়িতে করে গ্রামে ফিরে তার ‘বাবা-মা’-কে এতো বছরের দাস জীবন থেকে মুক্ত করেছে।

শহরের সিংহের মতো সুচিন্তক সেলিব্রেটি, দরবেশ ব্যবসায়ী, বীর পুরুষ পুলিশ, এলিটফোর্সের বাহুবলী, মিলনকন্ঠের সাংবাদিকপীর তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। জানো এক প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান আর্মি অফিসার; যে গুড়িয়া আসার আগে নিজেকে বাঘ বলে ঘোষণা দিয়ে এক বোতল খুশিজল সাবাড় করেছিল; সেই বাঘমামা গুড়িয়া এলে অবিশ্বাস্য চৌম্বক আকর্ষণে টলতে টলতে তার অর্ধেক বয়েসের গুড়িয়ার পায়ের কাছে বসে ছিল। এইভাবে কয়েকঘন্টায় বাঘ থেকে ইঁদুরের মেটামরফসিস দেখার পর মনে হয়েছে; গুড়িয়ার জীবন অত্যন্ত সক্ষম এক প্রতিশোধের গল্প।

– কিন্তু এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ পথ প্রতিশোধের। গুড়িয়া থেকে মুনিয়া হয়ে ফ্যানের ফাঁসে ঝুলতে এক মুহূর্তও সময় লাগে না। পুরুষ মানুষ প্রত্যাখ্যান নিতে পারে না। এটা হচ্ছে জেদি মেলশভিনিজম; সে ধরেই নিয়েছে, নারী তার কেনা সম্পত্তি। মোল্লাগুলোও তো মনে করে, জিহাদ জেতার পর নারী হচ্ছে গণিমতের মাল; ‘মানবিক বিয়ের’ অজুহাতে সে লাভ জিহাদের রাসপুটিন হয়ে জান্নাত রচনা করতে পারে সোনারগাঁ রিসোর্টে।

কাজ শেষে ফেরার পথে দোজখের পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে; কারো আদরের মেয়ে; যে ঈদের আগের দিন রাতে নতুন পুতুলের বায়না ধরে ঠোঁট ফোলাতো; সকালের জন্য রান্না করা সেমাই চেখে মাকে বলে দিতো চিনি হয়েছে কিনা পর্যাপ্ত; আজ সে সুগার ড্যাডিদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। আমায় তুলে নাও; তুমি যা বলবে আমি তাই করবো; আমায় শুধু একটু ব্রোডশেন আর এক টুকরা সসেজ কিনে দাও।