September 20, 2024
সাহিত্যকবিতাফিচার ৩

আমাদের মা

প্রিয়া দেব ।।

আমার গন্ধরাজ ফুল পছন্দ ছিল, আমার ভাইয়ের পলাশ, আর আমার বাবার গোলাপ। আমরা ভাইবোন প্রতি বসন্তে বাবাকে গোলাপ উপহার দিতাম। যদিও অযত্নে পড়ে পড়ে সে গোলাপ শুকিয়ে যেতো কারণ আমার বাবা প্র্যাকটিকাল মানুষ ছিলেন।

মা সেই শুকনো গোলাপ পুকুরে ভাসিয়ে দিতেন।

আমার মায়ের হাতের ইলিশ ভাপা পছন্দের ছিল, আমার ভাইয়ের পছন্দ ছিলো পায়েস। আমার বাবা সবসময় মায়ের হাতের রান্নায় খুঁত খুঁজে পেতেন। মা ভয়ে জড়সড় হয়ে বাবার ধমক শুনতেন।

আমরা বাবার এ রাগকে যুক্তিসঙ্গত মনে করতাম।

আমার পছন্দের রঙ ছিল সাদা, আমার ভাইয়ের ছিল হলুদ। আমার বাবার পছন্দ ছিলো লাল। প্রতিবেশী মহিলা যিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে পরিচর্যা করতেন, তিনি লাল শাড়ি পরলে আমার বাবা ভূয়সী প্রশংসা করতেন। যদিও আমাদের মা লাল পরলে বাবা বিরক্ত হতেন। কারণ ক্রমাগত রান্নাঘরের আঁচে পুড়তে থাকা মায়ের গায়ে লাল রঙ উদ্ভট লাগতো।

আমরা বাবার সাথে এ বিষয়ে একমত হতাম।

আমার প্রিয় জায়গা ছিলো বাড়ির ছাদ, আমার ভাইয়ের তার নিজের ঘর। আমার বাবার ছিল বৈঠকখানা, সেখানে বসে তিনি বন্ধুদের সাথে ক্রমাগত বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতেন। সেখানে বিদূষী নারীরাও থাকতেন, আমার বাবা তাদের সাথে ক্রমাগত আমার মায়ের তুলনা করে আফসোস করতেন।

আমরাও আফসোস করতাম।

বাবার সে বান্ধবীরা কতো সহজে বলে দিতেন নতুন কোন লেখক কিংবা কোন সিনেমা বেশি ক্লাসি। আমার মা তখন অতিথিদের জন্য রান্নাঘরে চা জলখাবার বানাতেন।

আমরা ভাবতাম মায়ের প্রিয় জায়গা রান্নাঘর।

আমার প্রিয় বই ছিল “এ টেল অব টু সিটিজ”, আমার ভাইয়ের “গর্ভধারিনী”। আমার বাবার প্রিয় ছিল তারাশঙ্করের “কবি”। আমরা আমাদের বাবার পছন্দ দেখে গর্বিত হতাম। আমরা নিশ্চিত ছিলাম আমাদের মা কখনো বই-টই পড়েন নি।

বাবার মতে তার কাছে “কবি” উপন্যাস আর “লোকনাথা ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা” একই মূল্য রাখে।

আমরা বাবার প্রবল রসবোধে হাসতাম, হয়তো বাবাও হাসতেন।

আমার প্রিয় সিনেমা ছিলো “শশাঙ্ক রিডাম্পশন” আমার ভাইয়ের “ফাইট ক্লাব”, আমার বাবার প্রিয় ছিল “গডফাদার”। আমার মা বাবার অনুপস্থিতিতে ভারতীয় সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে থাকতেন। আমরা তার রুচি নিয়ে বন্ধুমহলে বিব্রত হতাম। বাবার গুরুত্বপূর্ণ নিউজ দেখার জন্য আমাদের মা টিভি দেখার খুব অল্প সুযোগই পেতেন, এ ভেবে আমরা স্বস্তি পেতাম।

আমাদের মা যখন মারা যান তখন আমরা একটু সমস্যায় পড়েছিলাম।

কারণ যখন চিতায় তোলার আগে তার পছন্দের রঙের শাড়ি পরাতে বলা হলো,তখন আমি আবিষ্কার করলাম আমি জানিনা মায়ের প্রিয় রঙ কী ছিলো, মায়ের অন্তিম যাত্রায় মায়ের পছন্দের ফুলের তোড়া দিতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম মায়ের পছন্দের ফুল কী তা আমি জানিনা। মায়ের শ্রাদ্ধে মৃত ব্যক্তির প্রিয় খাদ্য কী ছিল ঠাকুরমশাই তা জানতে চাইলে আমরা নিরুত্তর থাকি, আমরা সেটাও জানতাম না।

আমাদের চুপচাপ ভীতু মা জীবনে প্রথম আমাদের একটু বিপদে ফেলেছিলেন।

যা হোক আমরা সেই বিপদ সামলে উঠেছিলাম।

কিন্তু মায়ের আগলে রাখা আলমারির ছোট্ট কোনা যেটাতে মায়ের গুপ্তধন আছে বলে আমরা হাসাহাসি করতাম, সেখানটায় আমরা সত্যজিৎ রায়ের “পথের পাঁচালী” সিনেমার পোস্টার এবং “প্রথম প্রতিশ্রুতি” বইটার জরাজীর্ণ একটা কপি খুঁজে পাই, আমাদের চিরচেনা মা সেবার আমাদের কাছে অচেনা হয়ে গিয়েছিলেন। এতোদিন বাবার দেখিয়ে দেওয়া মায়ের নানারকম খুঁতের জন্য আমরা বিব্রত হতাম,

কিন্তু আমাদের মা শেষবার আমাদেরকে সত্যি সত্যি বাবার অবদান ছাড়াই বিব্রত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আমরা সেবার প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের মাও সক্ষম একজন মানুষ ছিলেন।

ভাগ্যিস মা মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যু ছাড়া তার এই সক্ষমতার দেখা আমরা নিশ্চয়ই পেতাম না।