May 15, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

ভিনদেশি এক রেহানা ও তার যুদ্ধের গল্প

সেঁজুতি জাহান জিনাত।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হলে থাকাকালীন এক কাশ্মীরি নারী ডাক্তার আমাদের প্রতিবেশী  হয়ে এসেছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল হলে অনেক বিদেশি ছাত্র থাকে। ওই নারী ডাক্তারের স্বামীও ডাক্তার। ফলে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে পড়াশোনার জন্য ওখানে থাকতেন। এদের মধ্যে স্ত্রী পিজিতে এমডি করতেন। দুইজনই বরিশাল মেডিকেল থেকে পাশ করে এখানে এসেছিলেন।

দুই শিশু কন্যাকে কাশ্মীরে রেখে এখানে পড়াশোনা করার জন্য এসেছিলেন। স্বামী তাঁর থেকে দুই বছরের ছোটো। ভদ্রমহিলা পর্দা করতেন, হাত ও পা মোজাসমেত। নিনজা মুখোশ পরতেন আর দিন রাত শুধু পড়তেন আর পড়তেন। তাঁর বিষয় ছিল ‘রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং’। শত পড়াশোনা করেও বাংলাদেশের মতো জায়গায় মুখের ওপরও যে একটা মার্কিং হয় সেটা এই নারী জানতেন না। কোনো একটি কোর্সে তাকে নাকি তার এক সিনিয়র শিক্ষক পোশাক নিয়ে খুবই বাজে কথা বলেছিলেন, অনেকের মধ্যে অপমান করেছিলেন। রুমে ফিরে তিনি ভয়াবহ কেঁদেছিলেন। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করায় তার উত্তর ছিল- টিচার তো আমার খাতা দেখবেন, পারফরমেন্স দেখবেন তারপর মার্কিং করবেন। কেন তিনি আমাকে আমার পোশাক খুলতে বলবেন? কেন পোশাকের ওপর আমার ফলাফল নির্ভর করবে?  আমি  যদি এই গরমেও এই পোশাকে অভ্যস্ত হই তো উনার কী?

বলা বাহুল্য এই ভদ্রমহিলার যেসব জিন্স-টপস পরা বান্ধবী গ্রুপ স্টাডি করতে রুমে আসতেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ কিন্তু ওড়নাও পরতেন না। তাতে কিন্তু রেহানার (নারী চিকিৎসকের নাম) কোনো সমস্যা হতো না মিশতে। রেহানা তাঁর সাব্জেক্টে খুবই ভালো ছিলেন, অনেকেই অনেক কিছু বুঝতে তার রুমে আসতো।

রেহানা একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন, যেকোনো মূল্যে পড়ালেখা দিয়েই ভালো রেজাল্ট করবেন। তো দিন রাত তাকে শুধু পড়তে দেখতাম। স্বামীর কাছে এ পড়াশোনার তেমন কদর ছিল না। স্বামী যেমন বয়সেও ছোটো, পড়াশোনায়ও তেমন রেহানার থেকে পিছিয়ে ছিল। আমি তখন বিসিএসের জন্য পড়তাম। প্রথমবার বিসিএস দেয়ার সময় ক্ষিতি পেটে ছিল। তবু ওকে নিয়ে নিয়েই কোচিং করতাম। ক্ষিতির আল্ট্রাসনো করিয়েছিলেন রেহানা। দুইবার করেছেন, দুইবারই ক্ষিতি তার বিশেষ অঙ্গটিকে পায়ের ঢাকনা দিয়ে রেখেছিল। ফলে, রেহানা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন আমার মেয়ে হচ্ছে। রেহানা আমাকে পেটে ঘূর্ণমান রঙিন ক্ষিতিকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, পিজি থেকে। সে এক অনন্য অনুভূতি।

আমার চাকরির পড়াশোনার ব্যাপারে সাংঘাতিক অনুপ্রেরণা দিতেন রেহানা। আর নিজের জন্য ও তার জন্য আমার এই পোয়াতি দশায় বেশি বেশি করে দোয়া করতে বলতেন।

তো, স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই দেখতাম শুরুর দিকে। পরের দিকে শুধু স্ত্রীকেই দেখতাম। রেহানার পড়াশোনা-কেন্দ্রিক জীবন থেকে স্বামী দেবতাটি বিদায় নিয়ে নিতে যাচ্ছিল। রেহানা অনেক বুঝিয়েছেন তার স্বামীকে। এও বলেছেন, তুমি কি চাও আমি মেডিকেল ছেড়ে দিই? দিয়ে সংসারের হাল ধরি? তাহলে তাই দিই।

কিন্তু স্বামী মেডিকেল ছাড়তে বলে না, আবার এমডির ভালো রেজাল্টও তার সহ্য হয় না। রেহানার পড়াশোনার খরচ ও যাবতীয় মানসিক শক্তির উৎস তার বাবা। তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। অমায়িক শিক্ষিত ভদ্রলোক। রেহানা আমাকে তার বাড়ি এবং বাড়ির সদস্যদের ছবি দেখাতেন। শিশু দুটোর ছবি সামনে নিয়ে সমানে কাঁদতেন।

বাংলাদেশ ছাড়ার আগে রেহানা দুটো সংবাদ দিয়েছিলেন।

১. রেহানার স্বামীর মা-বাবা এতো উচ্চশিক্ষিত ব্যাটার বৌ চায় না বলে ছেলেকে তার স্ত্রীকে তালাক দেবার নির্দেশ দিয়েছিল। তার স্বামী এটা নিয়ে খুব জিদাজিদি শুরু করে। ডিগ্রি ফিগ্রি বাদ দিয়ে রেহানাকে কাশ্মীর গিয়ে হালকা পাতলা প্র্যাক্টিস করতে বলল, আর সংসার দেখার হুমকি দিয়েছিল। এটা না করলে তাকে তালাক দিয়ে দেবে। যদিও স্বামী হারুন অর রশীদের পরিপূর্ণ চেষ্টায় এই অসম বিয়েটি হয়েছিল। রেহানাকে প্রোপোজ করে তার স্বামীই। রেহানার শর্ত ছিল বিয়ের পর পড়ালেখার স্বাধীনতা দিতে হবে। হারুন দিয়েছিলও সেটা। কিন্তু স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর ভালো রেজাল্ট কী করে মানবে স্বামী?

রেহানার একটা ভাইও থাকতো ইন্টারন্যাশনাল হলে। সে এবং তার স্ত্রীও ডাক্তার। রেহানার রেজাল্ট ছিল সবার থেকে ভালো। তাই তিনি তার বাবা-মায়ের কাছে খুব কদরের সন্তান ছিলেন।

২. এমডিতে রেহানার খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছিল। আমার চাকরি আর রেহানার ভালো রেজাল্ট প্রায় কাছাকাছি সময়েই হয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেহানা বলতে লাগলেন- আপু, আপনারা খুব ভালো ছিলেন। আমার মেয়েরা আপনাদের নাম জানে। বাংলাদেশ ছাড়লে আপনাদের কথা সবসময় মনে পড়বে।

রেহানা যখন হল ছাড়ে তখন আমার পোস্টিং ফরিদপুরে। ফলে শেষ কথা বা যোগাযোগের কোনো সূত্র রেখে দিতে পারিনি।

পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের রেহানার সংগ্রামকে শ্রদ্ধা জানাই।