November 22, 2024
কলামফিচার ৩

ভুল করবেন না; নারীর শত্রু নারী নয়

ইমতিয়াজ মাহমুদ।। নারীকে নির্যাতন কেবল পুরুষরাই করে না, নারীরাও করে- সেকথা নিয়ে অনেককেই আলোচনা করতে দেখি। আমি তো এটাও দেখেছি যে লোকে ফেসবুকে বেশ বিজ্ঞের মত করে বাণী প্রদান করার স্টাইলে লেখে, নারীই নারীর প্রধান শত্রু। ভাবখানা যেন কী মহান একটা জ্ঞানগর্ভ বাণীই না মেরে দিলাম! আর কেবল যে পুরুষরাই এই রকম বাণী দেয় সেটাও না, নারীদেরকেও এইরকম কথা বলতে দেখেছি। এমনকি সিরিয়াস ধরনের আলোচনা সভাতেও- ঐ যে মন্ত্রী এমপি বা সেইরকম ভিআইপি ধরনের কিছু লোক আসে না সভায়, কাজের কথা কিছুই বলতে পারে না, ভাসা ভাসা দুই চারটা হাজারবার বলে চুষে ছিবড়ে করে দেওয়া হয়েছে এইরকম বাণী দেয় আর আমাদের সরকার মহান এইরকম কথা বলে- ওদেরকে আমি বলতে শুনেছি, নারীরাই নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু ইত্যাদি। এইসব কী জানেন? এইসব হচ্ছে বাজার অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে নারী অধিকার কর্মীদের দৃষ্টি সরিয়ে রাখা এবং তরুণদেরকে বিভ্রান্ত করার কায়দা।

শোনেন, প্রশ্নটা হচ্ছে নারীর অধিকারের- এইটা নারী বনাম পুরুষ ক্রিকেট ম্যাচ না বা নারী বনাম পুরুষ কবিগানের লড়াই না, বা নারী বনাম পুরুষ রশি টানাটানির খেলা না। এমনকি এটা সমাজের হালুয়া-রুটি নারী ও পুরুষের মধ্যে ভাগাভাগির দরবারও না। সমাজে যে লড়াইটা চলমান আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে সেটা হচ্ছে নারীর মানুষ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার লড়াই। নারী একবার পরাজিত হয়েছে সেই কবে যখন পিতৃতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল। সেই থেকে নারীকে সমাজে আর মানুষ বিবেচনা করা হয় না। পুরুষ হচ্ছে মানুষ আর নারী হচ্ছে মেয়েমানুষ। অন্য ভাষায় বললে, পুরুষ হচ্ছে সম্পূর্ণ মানুষ আর নারী হচ্ছে মানুষের মধ্যেই একটা প্রায়-মানুষ প্রাণী কিন্তু পুরোপুরি মানুষ না, মেয়েমানুষ বা ঊনমানুষ। এইটা আমি সংক্ষেপে এক দুই বাক্যে লিখে ফেললাম বটে, কিন্তু কথাটা সমাজবিজ্ঞানে নানাভাবে প্রমাণিত। ভাষার দিকে যদি দেখেন, তাইলেই আপনি দেখবেন আপনার নিজের প্রিয় যে বাঙলা ভাষা, সেই ভাষায় তো বটেই, পৃথিবীর প্রায় সব বিকশিত ভাষাতেই বাক্যের গঠনে, সর্বনাম, বিশেষণ আর ক্রিয়াপদের ব্যবহারে এই প্রত্যয়টা প্রতিস্ফলিত হয়- যে নারী সম্পূর্ণ মানুষ নয়- পুরুষ হচ্ছে মানুষ আর নারী হচ্ছে মেয়েমানুষ বা ঊনমানুষ।

পৃথিবীজুড়ে এখন যে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা- লিবারেল বাজার অর্থনীতি বা পুঁজিবাদ বা অন্য যে কোন নামেই আপনি ডাকেন, এই ব্যবস্থাটা টিকে আছে এই বিভাজনের উপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ এইটাই হচ্ছে সমাজের নীতি- এই কাঠামোর সমাজ ব্যবস্থাটাই পৃথিবীতে এখনো বেশিরভাগ মানুষ চায় এবং এই ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখতে চায়। অল্প কিছু মানুষ আছে যারা এই ব্যবস্থাটা ভেঙে ফেলতে চায়, ভেঙে নয়া সমাজ গড়বে বলে। বর্তমান যে সমাজ ব্যবস্থা সেটা যদি না ভাঙ্গেন- অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, এই সমাজের শ্রমবিভাগ, নারীর জন্যে যে কিছু ভূমিকা নির্ধারণ করা, এই সমাজের যে ধর্ম বিশ্বাসগুলি, যেগুলিতে নারীকে হীন প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করা হয় এই সবকিছু, সবকিছু ভেঙে ফেলতে হবে নয়া সমাজ গড়তে হলে।

তাইলে নারীর অধিকারের প্রশ্নটা আসে, তখন কিন্তু সেটা আর কেবল নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার জন্যে ঝগড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না- তখন প্রশ্নটা দাঁড়ায় যে আপনি এই বর্তমান সমাজকে টিকিয়ে রাখবেন নাকি এটা ভেঙে ফেলবেন? মানুষের মধ্যে তখন বিভক্তিটাও ঐভাবেই হয়- একদল নারী ও পুরুষ বলতে থাকে যে না, যে সমাজ আছে সেটাই ভাল, আলহামদুলিল্লাহ্‌, এইটাকেই টিকিয়ে রাখতে হবে। এদের মধ্যেই একটা দল বলে যে না, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা যেটা আছে সেটাই ঠিক আছে, একটু মেরামত ইত্যাদি করে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে, ভেঙে ফেলার দরকার নাই। এদেরই একটা দল আছে আবার যারা বলে কিনা যে না, বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা ভাঙার তো কোন দরকার নাই, বরং এটাকে আবার একটু পিছন দিকে টেনে নিয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এদেরকে আমরা রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়াশীল বা রিয়েকশনারি বলি। প্রতিক্রিয়াশীল দলটা বড়, অনেক বড়- এই দলে সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী দুই-ই অন্তর্ভুক্ত।

এই যে প্রতিক্রিয়াশীল দলটা বলছি, একজন যদি এই দলের অন্তর্ভুক্ত হয় তাইলে যে তো বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকেই আদর্শ মনে করে আর বিদ্যমান ব্যবস্থা তো নারীকে পূর্নাঙ্গ মানুষই মনে করে না, এই সমাজ পুরুষকে উপরের আসন দেয় আর নারীকে দেয় তার অধঃস্তনের মর্যাদা। সুতরাং যে নারী বিদ্যমান অবস্থা মেনে চলে সে তো আর নারী আর পুরুষের সাম্য চাইতে পারে না। সে তো পরুষের শ্রেষ্ঠত্বই বজায় রাখতে চাইবে, ফলত তার অবস্থান জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষের অনুকূলেই হবে।

এই প্রতিক্রিয়াশীল নারীদের মধ্যে আবার একদল আছে ওরা নিজেদেরকে ফেমিনিস্ট বলে। এমনিতে ফেমিনিস্ট বলে বটে, তাতে করে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে এই নারীরা বোধ হয় নারী অধিকারের পক্ষের মানুষ। কিন্তু ওদের কথা ঠিকঠাকমত শুনলে দেখবেন যে ওরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বজায় রেখেই এই কাঠামোর মধ্যেই নারীদের জন্যে একটু বাড়তি সুবিধা, একটু কল্যাণ, একটু দান খয়রাতের দাবি করছে মাত্র। লিবারেল ফেমিনিস্ট বলে আমরা যাদেরকে চিনি, ওদেরকে দেখবেন যে ওদের দাবিদাওয়া ঐটুকুতেই সীমাবদ্ধ, নারীকে যেন বোর্ডরুমে একটু জায়গা দেওয়া হয় বা পার্লামেন্টে যেন নারীদের উপস্থিতি আরেকটু বাড়ানো হয় বা নারীরা যেন চাকরি বাকরি একটু বেশি পায়, এইসব। নারী আর পুরুষ সমান মর্যাদার মানুষ বিবেচিত হবে সেরকম সমাজ গড়ার কোন ইচ্ছা ওদের নাই বা বর্তমান সমাজ ভাঙার কোন ইচ্ছা ওদের নাই। বাজারে তুমুল জনপ্রিয় একটা বই আছে, লিন ইন, শেরিল স্যান্ডবার্গ আর আরেকজন মিলে লিখেছেন- এইটা হচ্ছে এই লাইনের ফেমিনিস্টদের মতামত ধারণ সেরকম একটা বই।

নারী দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, এমপি স্পিকার বা পুলিশ প্রধান বা প্রধান বিচারপতিও যদি হন, তাইলেই কি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে? না। এমনকি সংসদে যদি নারী এমপিরা সংখ্যাগরিষ্ঠও হয় তবুও হবে না। কেননা যিনি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন বা মন্ত্রী এমপি বা প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন তিনি তো পুরুষতান্ত্রিক বাজার অর্থনীভিত্তিক সমাজ মেনেই সেইসব পদে বসছেন সুতরাং তার কাজই হচ্ছে এই সমাজকে ধরে রাখা, কেউ যেন এই সমাজকে ভেঙে না ফেলে সেটা নিশ্চিত করাই ওদের কাজ। নারীর জন্যে কিছু কল্যাণ, কিছু বাড়তি চাকরি, নানাপ্রকার কিছু চাকরি এইসব হয়তো ওরা করবেন, কিন্তু নারী ও পুরুষ সমান এইরকম কোন সমাজ গড়ার দিকে ওরা পাও ফেলবেন না। না, এইরকম কল্যাণ করা ধরণের কাজগুলিও মোটেই গুরুত্বহীন না। এই যে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার জন্যে একটা কনভেনশন হয়েছে (CEDAW নামে পরিচিত) সেটাও তো কম প্রাপ্তি নয়। কিন্তু আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই আমরা জানি যে প্রায় একনায়কসুলভ ক্ষমতা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায়ও যদি নারীরা আসীন হয় তবুও এমনকি ঐ CEDAW সনদের সব বিধানও বাস্তবায়ন করা যায়না।

আপনি সমাজের সকল স্তরে নারী নির্যাতনে নারীর যে ভূমিকা দেখেন, নারীর প্রতি নারীর সহিংসতা বা নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতায় নারীর সহযোগিতা, সেইগুলির ব্যাখ্যাও এইটাই। ‘পুরুষ তো প্রভু, পুরুষ হচ্ছে মালিক, পুরুষকে ঈশ্বর সৃষ্টিই করেছেন নারীর চেয়ে উত্তম রূপে’- এই ধারণা বা এই রাজনৈতিক মতামত বা এই বিশ্বাস যে নারীটি ধারণ করে সে কেন অধঃস্তন প্রাণীটিকে সম্মান করবে বা কেন প্রভুর বিরুদ্ধে লড়বে বা কেন প্রভুর আদেশ অমান্য করবে। নারীর পক্ষ নেওয়া বা নারীর অধিকারের পক্ষে কথা বলা সেটা তো প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিপক্ষে কথা বলা- এমনকি স্বয়ং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কথা বলা, একজন সুশীল সভ্য সমাজের অনুগত নারী কেন এটা করবে?

তারপর কথা যেটা আসে, তাইলে নারীর মুক্তির পথ কী? নারীর মুক্তির আর কোন বিকল্প পথ নাই, পথ একটাই- এই সমাজ ভেঙে একটা সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যেখানে নারী ও পুরুষ সকলেই মানুষ হিসাবে সমান অধিকার ভোগ করবে। একদম সমান- মানুষ। এইটার চেয়ে এক সেন্টিমিটার কম হলেও নারীর মুক্তি হবে না। ঐসব কল্যাণ ফল্যান সেগুলি ভাল বটে, কিন্তু ঐসবে মুক্তি নাই নারীর। আপনি যদি জেলখানায় থাকেন, জেলখানায় উত্তম কম্বল, উত্তম খাবার, এয়ারকন্ডিশনের ও টেলিভিশনের ব্যবস্থা করা- এইগুলি ভাল বটে, কিন্তু সেগুলি তো মুক্তির সমান না। মুক্তি মানে মুক্তিই। আর নারীর মুক্তি হচ্ছে সমাজ ভাঙার মধ্যে- কেননা পুরনো সমাজে আরাম বাড়তে পারে, আয়েশ বাড়তে পারে, কিন্তু মুক্তি হবে না। নারীর তাইলে শত্রু কে? এই মুক্তির পথে যারা বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওরাই শত্রু- প্রতিক্রিয়াশীলতা। আর প্রতিক্রিয়াশীল তো নারী ও পুরুষ দুইই।

শেষ বিচারে নারীর শত্রু নারী তো নয়ই, এমনকি পুরুষও নয়। নারীর শত্রু এবং পুরুষেরও শত্রু পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ তথা আপনারা যেটাকে বলেন বাজারের অদৃশ্য হাত, সেইটা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]