পুরুষ কেন মনে করে নারীবাদীরা খারাপ!
আঞ্জুমান রোজী।। নারীবাদ বিষয়টি কি শুধু নারীর জন্য? না, নারীবাদ নারী-পুরুষ সকলের জন্য। কেন এই নারীবাদ? এই বিষয়ে এ যাবৎকাল অনেক কথা বলা এবং লেখা হয়েছে। আমার বিশ্বাস অধিকাংশ পুরুষ নারীবাদ বিষয়টা জানেন এবং বোঝেন। তারপরও তারা নারীবাদী নারীদের কটাক্ষ করে দেখেন। যদি পুরুষরা নারীবাদ বিষয়টা না জানেন তাহলে একটু পড়াশুনা করেন। কারণ লক্ষ্য করেছি, নারী তার সমস্যা নিয়ে লিখলে বা বললে, সেটা হয়ে যায় ‘নারীবাদী দোষ’। নারীবাদকে ভুল তকমা দিয়ে সেই নারীকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা বা হেয় প্রতিপন্ন করা পুরুষের একধরণের হীন মানসিকতাই দেখি।
অবাক করার বিষয় হলো, শিক্ষিত পুরুষ সমাজ অবশ্যই নারীবাদ বিষয়টি বোঝে কিন্তু মুখে বলতে চায় না। স্বাধীনতাভোগী পুরুষ ঠিকই বোঝে নারী স্বাধীনতা এবং নারী অধিকার কী! পুরুষ পৃথিবীর এতো তত্ত্বের দিকে নজর দেয়, জ্ঞান আহরণ করে, আর নারীবাদ বোঝে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য? এরা ধর্ম বোঝে, রাজনীতি বোঝে, অর্থনীতি বোঝে, পুঁজিবাদ বোঝে, সমাজতন্ত্র বোঝে, অথচ নারীবাদ বোঝে না, এটা ভাবা যায়! যখনই নারী অধিকার নিয়ে কথা ওঠে তখনই পুরুষ ভদ্রমহোদয়েরা হাসি তামাশায় তা উড়িয়ে দেয়। কিংবা যে সমস্ত নারী নারীবাদ নিয়ে কাজ করে তাদেরকে নিয়েও পুরুষরা বিতর্ক তোলে, চরিত্রের দোষ দেয়, মিথ্যা রটনা রটায়। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই যন্ত্রণার শিকার। কেন এমন করে? তা ভাবলে সোজা হিসাবে বোঝা যায়, পুরুষ পুরুষতন্ত্র জিইয়ে রাখতে চায়, বজায় রাখতে চায় তাদের আধিপত্য। নাহলে জ্ঞানবিজ্ঞানে পুরুষ যেভাবে এগিয়েছে ঠিক সেভাবে কি নারী এগিয়েছে?
খেয়াল করলে দেখা যায়, পুরুষের আধিপত্যের জোরে নারী ভীতসন্ত্রস্ত থাকে অথবা অশান্তির ভয়ে নত হয়ে থাকে। যার কারণে নারী স্বাধীনতার আন্দোলনে মুষ্টিমেয় নারীদের অংশগ্রহণ দেখা যায় না। যুগযুগ ধরে পুরুষতন্ত্র এমনই ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, নারী সেখানে তার নিজস্বতা হারিয়ে বসে আছে। নারী স্বাধীনতার কথা বললে পুরুষের বিরুদ্ধে চলে যেতে হবে এই ভয়ে অনেক নারী নিস্পৃহ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমটা এমনই যে, নারীবাদী নারীদের অনেক নারীও বিদ্রুপ করে, সেটাও পুরুষকে খুশি করার জন্য। সে সমস্ত নারীর কাছে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব গুরুত্ব পায়। এরা পুরুষের গুণকীর্তন করে ভুলে যায় নিজের গুণের কথা। সমাজ ঠিক করে দিয়েছে স্বামী নারীর অলংকার এবং অহংকার; নারীও সেভাবে নিজেকে তৈরি করে ফেলেছে। যার ফলে দেখা যায়, নারীবাদ চর্চাটাও অনেক নারীর কাছে বিরক্তিকর। কারণ এতে ঘরের পুরুষের বিরুদ্ধেই প্রথমে যেতে হয়।
আরেকটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি, নারীবাদী হলে তাকে ধরে নেয়া হয় পুরুষবিদ্বেষী। শুধু পুরুষবিদ্বেষীই ভাবে না, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধরেই নিয়েছে নারীবাদী মানে হলো প্যান্ট-শার্ট পরা নারী, তারা সিগারেট ফুঁকে, বিয়েবিদ্বেষী হয়, সংসারবিদ্বেষী হয়। এই নেতিবাচক ভাবনাগুলো নারীবাদের প্রকৃত চর্চার অন্তরায় হয়ে আছে। নারীর ব্যক্তিগত বিষয়গুলো পর্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে। নারীবাদী হতে হলে শাড়ি বা প্যান্ট-শার্ট পরতে হয় না, নারীবাদী হওয়ার জন্য দরকার আত্মবিশ্বাস যেখানে মেধা ও মননকে শাণ দিয়ে মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী নারী বেগম রোকেয়া। নারীবাদীদের বিষয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক ধরণের “অচ্ছুৎ ভাব” আছে। মনে করা হয় যে, ওতো নারীবাদী – ও তো এরকম করবে, ওতো নারীবাদী – ও তো সেরকম করবে। অর্থাৎ নারীবাদী মানেই হলো খারাপ। নারীবাদ চর্চা করলেই তাকে এই সমাজ বিরূপ বিশেষণে বিশেষিত করে। যেমন- বেশ্যা, খারাপ মেয়ে, এমন আরো অনেক কিছু। নারীর চরিত্রে এই বিশেষণগুলো খুব সহজে লাগিয়ে দেয়া হয় যাতে নারী নারীবাদ চর্চা করতে ভয় পায়। এমনকি অনেক নারীবাদী নারী আদর্শিক জায়গা থেকে নীতিনৈতিকতার মধ্যে কর্মকাণ্ড চালালেও শুধুমাত্র নারীবাদী হওয়ার কারণে তাকে সমাজের কটাক্ষের মুখোমুখি হতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর জন্য নির্দিষ্ট গণ্ডী তৈরি করে দিয়েছে বলে সেই গণ্ডীর বাইরে এলেই নারী খারাপ হয়ে যাবে। এতে অন্য নারীর মানসম্মান হানি হবে বলে নারীবাদ চর্চায় আসতে চায়না, কারণ তারা জানে পুরুষ এসব পছন্দ করে না। আসলে নারীবাদ তত্ত্বে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভীত নয়, এই সমাজটা ভয় পায় নারীবাদের অ্যাকশনে।
পুরুষতন্ত্র হচ্ছে পুরুষ কর্তৃত্বের একটি নীতি, যে নীতি তার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে নারীকে নিপীড়ন করে। আজ নারীবাদী হিসেবে যারা বিশ্বে খ্যাতি বা অপবাদ কুড়াচ্ছেন, তারাও কম দুঃখে নারীবাদী হননি। নারীর ওপর নিপীড়ন এবং তা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্য ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত মতের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে নারীবাদের ধারণা। নারীবাদের বিরুদ্ধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দাঁড়ালেও দিনশেষে মানবতার কথা বললে বা বুঝতে হলে নারীবাদের পক্ষেই দাঁড়াতে হয়। নারীবাদ এমনই একটি বিষয় যা নারী পুরুষ উভয়কে মুক্তির স্বাদ এনে দেয়। উন্নয়নের চাকা ঘুরাতে গেলে নারীবাদ চর্চাও অনস্বীকার্য। অতএব নারীবাদ বিষয়টিকে হেয় করে দেখার দিন ফুরিয়ে এসেছে। সেইসাথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারীবাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর দিনও চলে এসেছে। এই প্রেক্ষিতে কণ্ঠ তুলে বলতে হয়, নারীবাদ চর্চায় যতই বাধা আসবে ততই নারী চারদিকে জেগে উঠবে। এখন দিন বদলের পালা। এটা বিশেষভাবে মনে রাখা উচিৎ, নারীবাদ চর্চা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, অবশ্যই পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। পুরুষ এটা যতদিন পর্যন্ত অনুধাবন না করবে, ততদিন পর্যন্ত মঙ্গল কোনো কিছুই ঘটবে না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]