November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

এলজিবিটিকিউআইএ: ধারণাগুলো পরিস্কার হোক

নাহিদা নিশি।। সেক্স শব্দটা শুনলেই আমাদের কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে। বাবা-মা সামনে থাকলে টিভি দেখতে অস্বস্তি হয়। না জানি কখন কোন চ্যানেলে কেউ এসে ‘সেক্স’ রিলেটেড কোনো শব্দ উচ্চারণ করে! আর সেটা শোনার সাথে সাথেই আমাদের কান গরম হয়ে যায়। ‘সেক্সুয়ালিটি’ নিয়ে কথাবার্তা শোনার আগেই তো কত কিছু কল্পনা করে ফেলি আমরা! অথচ এটা আমাদের কাছে আর সবকিছুর মতোই সহজ স্বাভাবিক জিনিস হতে পারতো! আমরা চাইলে সহজেই এসব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারতাম!

সেক্সুয়ালিটি’কে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়- ১. সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি, এর মানে বায়োলজিক্যাল আইডেন্টিটি মনে হলেও আসলে তা নয়,  সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি বলতে মূলত বোঝায়, আপনি নিজেকে কোন সেক্সের মানুষ হিসেবে আইডেন্টিফাই করছেন!

২. সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন,  এর মাধ্যমে বোঝায়, আপনি কোন সেক্সের মানুষের প্রেমে পড়ছেন কিংবা কার প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করছেন! এটা হতে পারে নারীর প্রতি, পুরুষের প্রতি কিংবা নারী-পুরুষের উভয়ের প্রতি, কিংবা কারো প্রতি না।

এলজিবিটিকিউ (LGBTQ) কমিউনিটি হলো আমাদের সমাজে সবচেয়ে নিগৃহীত সম্প্রদায়। আমরা জেন্ডার ইনইকুয়ালিটি নিয়ে এতো এতো কথা বলি, কিন্তু সেগুলো নারী-পুরুষ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। জেন্ডার ইকুয়ালিটি অর্জনের লক্ষ্যে যারা কাজ করে, তারাও সমকামীদের অধিকার বিষয়ে চুপ থাকে।

আশির দশকে ‘গে কমিউনিটি’ নাম পরিবর্তন করে ‘এলজিবি’তে রূপান্তরিত হয়,

যেখানে এল (L) বলতে লেসবিয়ানদের (lesbian) বোঝায়, লেসবিয়ান নারীদের প্রেম, ভালোবাসা এবং যৌন আকর্ষণ সবটাই থাকে অন্য আরেকটি নারীর উপর। তারা নারী হয়ে নারীর সাথেই দাম্পত্যজীবন কাটাতে চায়।

জি (G) বলতে বোঝায় গে (gay), গে হলো সেইসব পুরুষ যারা পুরুষের প্রতিই আকর্ষণ বোধ করে, পুরুষের প্রেমে পড়ে, যাদের নারীর প্রতি কোনোরকম প্রেম কিংবা যৌন আকর্ষণ থাকে না।

বি (B) তে বাইসেক্সুয়াল, নারী-পুরুষ উভয়ই বাইসেক্সুয়াল হতে পারে। কোনো নারী কিংবা পুরুষ যদি নারী এবং পুরুষ উভয়ের প্রতিই আকর্ষণ বোধ করে, তাহলে তাদের বাইসেক্সুয়াল বলা হয়। উভয়লিঙ্গের প্রতিই তাদের সমান দুর্বলতা কাজ করে।

নব্বই এর দশকে এলজিবি এর সাথে T লেটারটি যুক্ত করা হয়। টি (T) বলতে  ট্রান্সজেন্ডারদের বোঝায় যারা জন্মগত সেক্স অর্গানকে অস্বীকার করে এবং বিপরীত লিঙ্গকে ধারণ করে। নারী হয়ে জন্মালেও নিজেকে পুরুষ হিসেবে আইডেন্টিফাই করে আবার পুরুষ হিসেবে জন্মালেও নিজের ভিতর নারীসত্ত্বা খুঁজে পায় এবং পরবর্তীতে নিজেদের বায়োলজিক্যাল এবং স্যোশাল আইডেন্টিটি চেঞ্জ করে। এই ট্রাঞ্জিশনিং মূলত তিনটি উপায়ে হয়ে থাকে, সামাজিকভাবে, আইনসম্মত উপায়ে এবং চিকিৎসার মাধ্যমে। তারা তাদের নাম, পরিচয়, বেশভূষা এবং শরীর পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজের লৈঙ্গিক রূপান্তর ঘটায়। তারা নারী/পুরুষ যেকারো প্রেমে পড়তে পারে! সামাজিকভাবে ট্রান্সজেন্ডার মানুষই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হয়।

পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে এলজিবিটির সাথে Q, I এবং A যুক্ত হয়ে এলজিবিটিকিউআইএ হয়। কিউ (Q) তে ক্যুইয়ার কিংবা কোশ্চেনিং পিপলদের বোঝায়, যারা নিজেদের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়ে সন্দিহান,  অর্থাৎ তারা নিজেরাও ঠিকঠাক জানেন না, তাদের যৌন আকর্ষণ ঠিক কার প্রতি!

আই (I) বলতে ইন্টারসেক্স মানুষদের বোঝায় যাদের সেক্স অর্গান নারী পুরুষের সেক্স অর্গান অর্থাৎ ট্র্যাডিশনালি যেই অর্গানের মাধ্যমে আমরা নারী, পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ করি, তার থেকে আলাদা হয়, তারা বায়োলজিক্যালি নারী কিংবা পুরুষ কারোরই সেক্স অর্গান নিয়ে জন্মায় না কিংবা নারী, পুরুষ উভয়েরই সেক্স অর্গান নিয়ে জন্মায়।

বাকি থাকলো A! এ (A) তে এসেক্সুয়াল পিপল। এসেক্সুয়াল তাদের বলা হয়, যারা যেকোনো মানুষকেই ভালোবাসতে পারে, কিন্তু কারো প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে না। অর্থাৎ তারা সেক্সুয়াল রিলেশনশিপের প্রতি অনাগ্রহী হয়।

এলজিবিটিকিউআইএ ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন রয়েছে যার কারণে বর্তমানে এলজিবিটিকিউআইএ এর সাথে প্লাস (+) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। যেমন, ডেমিসেক্সুয়াল, প্যানসেক্সুয়াল, স্যাপিওসেক্সুয়াল ইত্যাদি।

স্যাপিওসেক্সুয়াল: এরা চেহারা কিংবা শারীরিক সৌন্দর্য নয়, শুধু বুদ্ধিমত্তা দেখেই প্রেমে পড়ে। সোজা বাঙলায়, এস্থেটিক গ্রুপের মানুষজন আর কী!

প্যানসেক্সুয়াল: এই গ্রুপের মানুষেরা যেকোনো মানুষের প্রেমে পড়তে পারে। নারী, পুরুষ, ইন্টারসেক্স কিংবা যেকোনো মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করতে পারে। তাদের নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকে না।

ডেমিসেক্সুয়াল: যারা শারীরিক বা বুদ্ধিমত্তা কোনটার দ্বারাই আকর্ষিত হয় না। এরা বন্ধুত্বের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি করে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তার প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করে। অচেনা কিংবা অল্পচেনা কোন মানুষের প্রতি এরা কোনোরকম যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না।

নিউইয়র্কের ‘স্টোনওয়াল ইন’ নামক একটি রেস্তোরাঁ সমকামীদের আড্ডা দেয়ার স্থান হিসেবে পরিচিত ছিলো, পুলিশ প্রায়ই সেখানে হামলা চালাতো, এবং সমকামীদের গণহারে এ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতো।

১৯৬৯ সালের ২৮শে জুন, পুলিশ অন্যান্য দিনের মতোই সেখানে হানা দেয়, কিন্তু সেদিন সমকামীরা অন্যান্যদিন এর মতো পিছু হটে না বরং পুলিশের উপর হামলা করে। পুলিশকে রেস্তোরাঁর ভিতরে আবদ্ধ করে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয়।

পরের দিন ২৯শে জুন সেখানে সমকামীদের সমর্থনে আরো বহু লোক এবং সংগঠন এগিয়ে আসে। প্রায় চারশ পুলিশের সাথে দুই হাজার সমকামী লড়াই করে সেদিন। তারপর থেকে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশে সমকামীদের সমর্থন জানিয়ে জুন মাসটি প্রাইড মান্থ হিসেবে উদযাপিত  হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশেই সমকামী বিয়ে বৈধতা পেলেও বাংলাদেশে এখনো সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে সমকামীরা আক্রমণের শিকার হয়। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। ২০১৬ সালের ২৫শে এপ্রিল জুলহাজ মান্নান এবং মাহবুব তনয় নামের দুজন’কে খুন করা হয়। জুলহাজ  সমকামী অধিকারকর্মী ছিলেন, তিনি ‘রূপবান’ নামক একটি সমকামবিষয়ক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন।

সমকামিতা সমর্থন করতে না পারলেও এর বিরোধীতা করা অনুচিত! সমকাম এমন কোনো অপরাধ নয় যার কারণে কাউকে খুন করা যায়। খুনাখুনির মাধ্যমে হয়তো কোনো গোষ্ঠীকে সাময়িকভাবে দাবিয়ে রাখা যায়, কিন্তু তার অস্তিত্ব’কে মুছে ফেলা যায় না।

প্রত্যেকটি মানুষের ভালোবাসবার এবং ভালোবাসা পাবার অধিকার আছে। পৃথিবীতে মোট  ৭ থেকে ১৩ শতাংশ সমকামী, উভকামী কিংবা কামহীন মানুষ আছে। আর এটা খুব স্বাভাবিক। এই বৈচিত্র্যতার কারণেই সম্ভবত পৃথিবীটা এতো সুন্দর!

প্রতিটি মানুষ নিজের মতো করে ভালোবাসার অধিকার পাক। ভালোবাসার অধিকার চেয়ে লড়াই করার দিন শেষ হোক। হ্যাপি প্রাইড মান্থ।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]