April 29, 2024
সাহিত্যআরও ভাবনাফিচার ৩

‘নিজের সন্তানকে চড় মারতে শিখুন’- যেভাবে এমন বইয়ের জন্ম হয়

লিখন দত্ত ।। 

‘নিজের সন্তানকে চড় মারতে শিখুন’। বইয়ের নাম দেখেই সচেতন যেকোনো লোকের মাথায় রক্ত চড়ার কথা। কিন্তু নিচের ছোটো অক্ষরগুলো পড়লে রাগের পারদ আবার আগের অবস্থানে নেমে আসবে। বোঝা যায় বইয়ের নামটা একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। বইটা মূলত শিক্ষামূলক বই। বাচ্চাদের জন্য নয়, বাচ্চার বাবা মায়ের জন্য। কিভাবে বাচ্চাকে গড়ে তুলবেন তারই কিছু বিজ্ঞাননির্ভর উপদেশ দেওয়া আছে এতে।

এই বইয়ের ছবি আমি ফেসবুকে পেয়েছি, কোনো এক বাবা বই পড়ুয়াদের গ্রুপে বইটির ছবি পোস্ট করে জানতে চেয়েছেন এই বইটা কোথায় পাওয়া যাবে। তার উদ্দেশ্য হয়ত নিছক কৌতুহল মেটানো অথবা সন্তানপালনের বিজ্ঞাননির্ভর কিছু কায়দাকানুন শিখে নিয়ে নিজ সন্তানকে (উচিত) শিক্ষা দেয়া। কিন্তু ছবিটার সাথে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করে কিছুটা সন্দিহান অবস্থায় পড়েছি, আমার বিবেচনাগুলো তাই পাঠকের সামনে পেশ করলাম, এর কতটা চিন্তার খোরাক যোগাবে পাঠক নিজেই তার একটা বিহিত করবেন আশা রাখি।

প্রথমত বইয়ের নামেই একটা মজার ব্যাপার লুকিয়ে আছে। সন্তানকে চড় মারতে শিখুন। হাত দিয়ে লোকে চড় কষে, আবার এই হাত দিয়েই সে গড়ে সমস্ত কিছু। তাই চড় কষার সাথে গড়ার একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। বাবা-মা কি সময়ে অসময়ে প্রয়োজনমতো দু-চারটে চড় থাপ্পড় কষে সন্তানের জীবন গড়তে চায়? কিন্তু হাঁড়ি পাতিল থেকে শুরু করে নগর সড়ক দালানকোঠা যেমন মানুষ নিজ হাতে একটা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হুবহু গড়ে নিতে পারে, মানুষকে সেরকম ছাঁচে ঢেলে মানুষ করা যায় কি? নাকি তার সাথে জড়বস্তুর চেয়ে একটা বৃক্ষের তুলনা বেশি জুতসই যার ডালপালার বিন্যাস কি রকম হবে, কিভাবে বেড়ে উঠবে তা আগ থেকে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে বরং আলো হাওয়া জলের একটা উর্বর পরিবেশ দিলে সে নিজের আপন নিয়মেই বেড়ে কল্লোলিত রূপ নেবে। বৃক্ষের মতো মানবশিশুর প্রতিও নিজের খায়েশমত স্বেচ্ছাচারিতা করতে চাইলে বরং উল্টো ফল ভোগ করতে হতে পারে। প্রথমত সে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, আর যদি জোর করে গলা টিপে কাঠামোর কারাগারে আটকে দেওয়াও হয় তাহলে যখন সেই ছাঁচ থেকে তাকে বের করা হবে ততদিনে তার অঙ্গ সঞ্চালনের আর কোনো ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকবে না; বেঁচে থেকেও সে অসহায় ও বিকলাঙ্গ হয়ে রয়ে যাবে এক প্রকার। ছোট্ট শিশুদের নিয়ে তাদের বাবা মায়ের সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এই ছাঁচের স্বরূপ, তাদের ডানা কেটে পোষ্য বানানোর হাতিয়ার।

ইউটিউব ফেসবুক সোশাল মিডিয়ার এই যুগের অন্যতম প্রধান সামাজিক ব্যাধি হচ্ছে মোটিভেশন। প্রাক-অন্তর্জাল যুগে মোটিভেশন বেচাকেনা শুধু বইপুস্তক ও কর্পোরেট শাখার লোকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানে মোটিভেশন আত্মউন্নয়ন এসবের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমার একটা ব্যক্তিগত বিবেচনা হলো এই বস্তুটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা প্রধান চালিকাশক্তি তথা অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোটিভেশন কী? শব্দটা এসেছে motive থেকে যার আভিধানিক অর্থ অভিপ্রায়, কামনা, চাহিদা তথা এসবের দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তির অন্তর্নিহিত চালিকাশক্তি। এই প্রেরণা তখনই প্রয়োজন হয় যখন কামনা থাকে। পুঁজিবাদের বেলায় অর্থটা আরেকটু গভিরভাবে খাটে। গাধার পিঠে চড়ে বঁড়শি দিয়ে তার মুখের সামনে ঘাস ঝুলিয়ে তাকে সারা মাঠ দৌড়ে বেড়ানোর ফন্দিকেই পুঁজিবাদের আলোকে মোটিভেশন বলে। অর্থাৎ সামাজিক অর্থে ঘরভর্তি একগাদা লোকের সামনে একটা পুরষ্কার (reward) ঝুলিয়ে তাদের সবাইকে ইঁদুরদৌড়ে নামিয়ে দেওয়া। বর্তমান সমাজে যেখানে অর্থই সবকিছু পরিমাপের শেষ কথা, সেখানে এর চেয়ে কার্যকরী ডিভাইস আর হয় না। চোখের সামনে যখন টাকা কেরিয়ার সাফল্যের লোলুপ ঝোলাটা ঝুলিয়ে দেয়া হবে তখন চারপাশে তাকানোর আর সময় কোথায়!

সাধারণত সফলদেরই হাতেই মোটিভেশন ঝাড়ার দায়িত্বটা অর্পণ করা হয়। এবং প্রতিযোগীরা যেহেতু তাদের একটা সশ্রদ্ধ চোখে দেখে থাকে সেহেতু তাদের আকাশকুসুম বাণী গিলতেও কোনো অসুবিধা হয় না। এরপর ওখান থেকে যারা জীবনমরণ পণ করে একটা জায়গা দখল করে নিতে পারবে তারাই পরম্পরা বজায় রেখে তাদের অধঃস্তনদের ওপর একইরকম বুলি বর্ষণ করে যাবে।

বর্তমানে দুনিয়াব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রমের একটা প্রধান কৌশল হলো Reward & punishment। বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রক্রিয়ায় এটাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে অনেক বেশি। প্রদত্ত কাজ ভালোভাবে করতে পারলে পুরস্কার, করতে না পারলে শাস্তিবিধান। দুটোই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দ্বিতীয়টা যদিও আগে শারীরিক শাস্তি থেকে এখন মানসিক পর্যায়ে (সমালোচনা) নেমে আসছে, কারণ উন্নত দেশগুলোতে অন্তত কেউ আর এখন বাচ্চাদের গায়ে হাত তুলতে চায় না। কিন্তু শারীরিক শাস্তির চেয়ে পুরস্কারের পেছনে ছোটানো যে বেশি বৈ কম ক্ষতিকর নয় সেটা কেউ উপলব্ধি করতে চায় না। তাছাড়া মোটিভেশনের মাসতুতো ভাই আত্মউন্নয়নেরও এখন জোয়ার চলছে খুব। আত্মউন্নয়নমূলক কান্ডকারখানায় একটা বাক্য সর্বদা পাওয়া যায়; ছোট ছোট লক্ষ্য তৈরি করুন এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছালে নিজেকে পুরস্কৃত করুন। মোটিভেশন আত্মউন্নয়ন এসবের উপকারিতা অপকারিতা নিয়ে আজ আর বিশদে যাব না। এই লেখার সেটা উদ্দেশ্যও নয়। যে প্রশ্নটা তুলতে চাইছি সেটা হলো আমাদের নিজেদের সাথে নিজেদের ছলচাতুরীর এত প্রয়োজনটা পড়েছে কিসে? কি হবে নিজের এত ঝকঝকে তকতকে ইমেজ তৈরি করে? এতটা মোটিভেটেড হয়েই আমরা কি করব আর কি এমন মুনাফা জুটবে যার জন্য শৈশব থেকেই একের পর এক প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হবে? উত্তরটা সহজ – নিজেকে বিক্রি করার জন্য! অর্থই যে সমাজের মূল ভিত্তি সেখানে শিক্ষা হলো নিজেকে বিক্রি করার ক্রমপ্রস্তুতি।

এইসব পুঁজিবাদী টেকনিক আসলে বৃহৎ সংখ্যক জনসমষ্টিকে একসাথে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ কিনা যেখানে যোগাযোগের একটা ঘাটতি আছে, যেখানে অপরজনের কাছাকাছি পৌঁছানো যাচ্ছে না, সেই পরিস্থিতিতে সবার জন্য একটা গড় বিহিতের ব্যবস্থা করতে এসব ফাঁকি বেশ কার্যকর। পোষাপ্রাণীর ক্ষেত্রে যোগাযোগের বাঁধাটা অবশ্যম্ভাবী, তাই তাদের reward and punishment এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তোলা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে মুশকিল হলো তার একটা উন্নত মস্তিষ্ক আছে, হৃদয় আছে, যা সংবেদনশীল এবং এর ক্রমবিকাশের প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। মনন ও মস্তিষ্কের বিকাশে যদি পশুর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় তাহলে পরিশেষে সেই মনন কোন পর্যায়ে পৌঁছোয় সেই নিয়ে শঙ্কা রয়ে যায়। মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব একমাত্র যত্ন ও ভালোবাসার পরিমণ্ডলে। কিন্তু ছোটো বাচ্চাটার হাতে হাত রেখে, কানটা তার দিকে বাড়িয়ে তার মনের কথাগুলি শুনতে রাজি আছে তো তার নিকটজন?

দু’য়েকদিন আগে দুপুরবেলা রাস্তায় একটা দৃশ্য দেখে দুঃখ পেলাম; দুটো ছোটো ছোটো মেয়ে প্রাইমারি স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। তাদের একজনের হাতের রেজাল্ট কার্ডের দিকে মনোনিবেশ সহকারে তাকিয়ে দুজনের আলাপচারিতা চলছে। বোধকরি পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েছে। মুহূর্তেই মনে হলো দৃশ্যটা কি নিষ্ঠুর! ছোটো দুটো শিশু কোথায় তাদের চুলের বেণীতে ফুল গুঁজে, হাসি গল্পের ফোয়ারায় মাতিয়ে রেখে, হাতের দোলায় ওপরের দিকে ছুঁড়ে পরক্ষণেই দু’হাতে পাকড়াও করে বুকের ভেতর টেনে নেয়া হবে, তা না তাদের হাতে একটা প্রতিযোগিতার ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে তুমি মন্দ, অসম্পূর্ণ, অযোগ্য। প্রতিযোগিতায় ভালো না করলে এখানে তোমার স্থান নেই। এর পরেরদিন উঠে শুনলাম আমাদের বন্ধু প্রত্যয় বড়ুয়া এবারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তির সুযোগ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে। দুটো উদাহরণেই পরিষ্কার হয়ে যাবার কথা আদতে সামগ্রিক শিক্ষা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।

আসলে সব সমস্যার গোড়া হচ্ছে আমাদের একে অপরের প্রতি যত্ন, মনোযোগ ও ভালোবাসার অভাব। আগেই বলেছি পুরস্কার কিংবা শাস্তি দুটোই একপ্রকার escape। শাস্তির ভয় দেখিয়ে অথবা পুরস্কারের লালসায় শিশুকে ব্যস্ত করে দিয়ে সাময়িক কার্যসম্পাদন সহজ, কিন্তু এসব আমাদের খুব বেশি দূর নিয়ে যাবে না। আদতে আমরা এতটাই আত্মমগ্ন হয়ে আছি যে কোনমতে দায়িত্বটা সারতে পারলে যেন বাঁচি। একটা মানুষকে একদিনে বোঝা যায় না। তার প্রতি প্রতিদিন চোখ রাখতে হয়, প্রতিদিন নতুন করে বুঝে নিতে হয়। সম্পর্কের গোড়ায় প্রতিদিন নতুন করে জল ঢালতে হয়। কেননা মানুষ নিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু অত পরিশ্রম করতে তো আমরা আগ্রহী নই। আমরা আছি শিশুর কাঁধে বস্তা চাপিয়ে টিউশনে পাঠিয়ে পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর নিশ্চিত করার ফন্দি ফিকিরে।

পুঁজিবাদী সিস্টেমের মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষকে মেশিনে রূপান্তরিত করে উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। এইজন্যে ‘নিজের সন্তানকে ভালোবাসতে শিখুন’ এর বদলে ‘নিজের সন্তানকে চড় মারতে শিখুন’ বইয়ের জন্ম হয়েছে। বইয়ের কভার তথা খোলসে যে পুঁজিবাদী বিপণনের ফাঁকি আছে তার থেকে একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় ভেতরে যত জ্ঞানগর্ভ কথা থাকুক সেগুলো শেষ উদ্দেশ্য আদতে কি। শিশু তথা সন্তানের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য তৈরি করা ও সন্তানকে চড় (Selective Logical Award and Punishment) মেরে সঠিক রাস্তায় বসানো যাতে সে জীবনের প্রত্যেক ধাপে প্রতিযোগিতায় অপরকে হটিয়ে ঠিকই নিজের জায়গাটা বুঝে নিতে পারে। এসব মোটিভেশনের প্রয়োজন পড়ে তখনি যখন ক্ষমতা ও অর্থের প্রতি লিপ্সা এবং সমাজের উচ্চাসনে বসার তাগিদ প্রধান হয়ে ওঠে। কেননা অপরের হাতে হাত রাখতে কোনো মোটিভেশনের দরকার পড়ে না, অপরের হাত থেকে কিছু ছিনিয়ে নিতে গেলে পড়ে। এসবের সামগ্রিক ফলাফল হলো জীবন হয়ে ওঠে প্রতিযোগিতাপূর্ণ। কেউ আর অপরের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয় না। শৈশব থেকেই যাপন হয়ে পড়ে নিষ্ঠুর ও নিঃসঙ্গ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *