April 29, 2024
সাহিত্যফিচার ৩প্রবন্ধ

রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন: এক দুঃসাহসী অভিযাত্রা

ড. নূর সালমা খাতুন ।। উনিশ শতকের শেষপ্রান্তে স্বাধীন চিন্তক রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)-র জন্ম হয়। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো রোকেয়া কখনো কখনো রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এই নাম ব্যবহার করতেন এই তাঁর চিঠিপত্রে। আমরা এই মহীয়সী নারীকে রোকেয়া নামেই সম্বোধন করতে চাই। তাতেই তিনি দীপ্যমান। তাঁর নামটি একটা নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে আমাদের চেতনায়। বাংলাদেশের কুসংস্কার আর অন্ধকারে আচ্ছন্ন সমাজে রোকেয়া নামের এই নক্ষত্র এমন এক আলোকবর্তিকা নিয়ে আর্ভিভূত হলেন তাতে দূরীভূত হলো বহুবছরের জমানো আঁধার। তিনি তাঁর কালের হিসেবে এক বিস্ময়। যে সমাজ আর পারিবারিক কাঠামোয় তাঁর বেড়ে ওঠা সেখানে এভাবে ভাবতে পারাটা রীতিমতো চমৎকৃত হওয়ার মতো ব্যাপার। প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে এটা সম্ভব হলো? রোকেয়া ছিলেন চেতনায় আধুনিক, চিন্তায় গাঠনিক, বোধে মানবতাবাদী, অনুভবে মমতাময়ী এক সংবেদনশীল মানুষ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান সমস্যার গভীরে চোখ রেখেছেন, অনুসন্ধান করে বের করেছেন কারণ আর নিজের স্বচ্ছ এবং যুক্তিবাদী মন নিয়ে এর সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। রোকেয়ার সমাজবীক্ষণ এবং ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ তাঁকে সেই সময়ের চেয়ে আধুনিক মানুষের তকমা এনে দিয়েছে। তিনি সময়কে পড়তে পারার এক অনায়াস সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। নিজেকে নির্মাণ করেছেন অতি যত্নে। এর প্রকাশ তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে প্রকট। হাওয়ায় কলম চালাননি বরং মগজের কারফিউ ভেঙে বের করে এনেছেন প্রথাগত চিন্তার অনুসারীদের। নতুন দিনের আলোয় তাদের জীবনের পথ চলতে অনুপ্রাণিত করেছেন। রোকেয়ার জন্য কাজটি খুব একটা সহজ ছিল না। এজন্য তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে অকাট্য যুক্তির পথ। নিজের বক্তব্যকে অনুভবের তীব্রতার সঙ্গে বোধ আর বোধির মিশেলে উপস্থাপন করতে হয়েছে। সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে নারীর উন্নয়নও নিশ্চিত করা প্রয়োজন – রোকেয়ার এই চিন্তায় সমাজ আস্থা রাখতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় নারীউন্নয়ন বেশ অগ্রাধিকার পায়। বাস্তবে কতটা হয়েছে সে অন্য আলাপ। কিন্তু রোকেয়া যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটার পথে সমাজ হাঁটছে।

রোকেয়ার নারীবিষয়ক ভাবনাটা কেবল নারীকেন্দ্রিক নয়। সামগ্রিক বিচারে তিনি আমাদের সমাজব্যবস্থাকে নিয়ে কথা বলেন। পুরুষের চিন্তার খণ্ডিত রূপ, নারীর নিজেকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত রাখার বহুবছরের অভ্যাস-এসবের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করেন তিনি। নারীর আত্মোন্নয়নকে গুরুত্ব দেন সবার আগে। নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশে সমাজ কীভাবে বিকশিত হবে এর অনেক আলাপ রোকেয়ার লেখায় ছড়িয়ে আছে। বস্তুত রোকেয়া বলতে চান সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে দরকার বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের। যোগ্যতমের জয়ের মতো ব্যাপার আরকি। আসলে পৃথিবীটা তো জয়ীদের গল্পেই বিভোর। এখানে পরাজিতদের কোনো জায়গা নেই। রোকেয়া নারীর আত্মনির্মাণে পুরুষ নয় নারীকেই এগিয়ে আসার কথা বলেন। জায়গা করে নিতে হবে নিজ যোগ্যতায় নারীকে। এজন্য একটা অনুঘটকের বিশেষ খাতির করেন তিনি। বলেন শিক্ষার কথা। তিনি জানেন শিক্ষা এমন এক আলো যা আমাদের সব অন্ধকার দূর করে দিতে পারে। ভাবতে অবাক লাগে রোকেয়া আপাদমস্তক অন্ধকারে আবৃত এক সমাজে জন্মেও এমন অনুভব ধারণ করেছিলেন। তবে রোকেয়া শিক্ষার আলোয় এসেই এই অনুভবে তাড়িত হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন এমনটা বলা যায়।

তাঁর অন্যান্য লেখার মতো সুলতানার স্বপ্নও এক শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ রচনা। ক্ষীণকায় এই লেখাটায় রয়েছে একজন স্বপ্নচারী মানুষের দুঃসাহসী চেতনার প্রকাশ। রোকেয়া যে সমাজে জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন সে সমাজবাস্তবতায় এভাবে ভাবতে পারাটা বেশ সাহসের কাজ। গল্পের আকারে মানে স্বপ্নলোকের মধ্যে রোকেয়া একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার চিত্ররূপ দিয়েছেন এখানে। দেশটার নাম দিয়েছেন ‘নারীস্থান’। উত্তম পুরুষে অর্থাৎ সুলতানার বয়ানে কল্পনেত্রে এমন এক সমাজের স্বপ্ন উপস্থাপিত হয়েছে যা কেবল কাল্পনিকতার আচ্ছাদনে ব্যাপৃত নয় বরং যৌক্তিক অনুভবে তাড়িত। অর্থাৎ প্রত্যেকটি বিষয়ের পেছনে যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয়েছে। ভগিনী সারা সুলতানাকে নারীস্থানে নিয়ে যায়। সেখানে পুরুষরা অন্দরমহলে কাজ করে আর নারীরা রাজ্য চালায়। নারীরা তাদের কর্মদক্ষতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এ যোগ্যতা অর্জন করেছে। কীভাবে করেছে সেই গল্প রোকেয়া আমাদের শোনান। পুরুষ শারীরিক শক্তিতে এগিয়ে থেকে ক্ষমতার শীর্ষে বসেছে এমন এক ধারণাকে বিশ্লেষণ করে সারা সুলতানাকে বলেন:

“কেবল শারীরিক বল বেশী হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করিনা। সিংহ কি বলে বিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলিয়া কি কেশরী মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করিবে? আপনাদের কর্তব্যের ত্রুটি হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনারা সমাজের উপর কর্তৃত্ব ছাড়িয়া একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অন্বিষ্ট দুই-ই করিয়াছেন। আপনাদের কল্যাণে সমাজ আরও উন্নত হইত-আপনাদের সাহায্যের অভাবে সমাজ অর্ধেক শক্তি হারাইয়া দুর্বল ও অবনত হইয়া পড়িয়াছে।”

রোকেয়ার চিন্তার স্বচ্ছতা, আধুনিকতা এখানেই। তিনি বুঝেছিলেন পেশীশক্তি আসলে সমাজের বিকাশে সে অর্থে ভূমিকা রাখে না। যোগ্যতার পরীক্ষায় টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের। পুরুষের ধৈর্যশক্তির অভাব, কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা, বাগাড়ম্বর, বদঅভ্যাস আর গাল-গল্প এগুলোর কারণে তাদের নারীস্থানের অন্দরে জায়গা নিতে হয়েছে। এসবই তাদের কর্মফল। একটা হিসেব দেওয়ার চেষ্টা আছে। যেমন: একজন পুরুষ দিনে ১২টি চুরুট ধ্বংস করতে ব্যয় করে ছয় ঘণ্টা সময়।

দেশের দুর্ভিক্ষ, মহামারি এসবের কারণ অনুসন্ধান করে পাওয়া গেছে যে দারিদ্র্যের পেছনের করণে। অন্নাভাবে এসব হয়। নারীস্থানে এখন এসবের বালাই নেই। বছর ত্রিশেক আগে বর্তমান মহারানি সিংহাসনে বসেন, তখন তার বয়স তেরো বছর। রাজ্য চালাতেন প্রধানমন্ত্রী। বিজ্ঞান-চর্চা করতে গিয়ে কিশোরী মহারানি আবিষ্কার করেন সৌরোত্তাপ। কেবল সেটাই নয়, মহারানি পল্লিগ্রামেও স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, বাল্যবিবাহ রোধের ব্যবস্থা করেন। একুশ বছর না হলে কোনো মেয়ের বিয়ে হতে পারবে না। মেয়েদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলো। বিজ্ঞানচর্চায় তারা এগিয়ে গেল। অভিনব বেলুন আবিষ্কার করে ঝড়বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলো। এরূপে জলধর বেলুন, সৌরোত্তাপ সংগ্রহ করা এবং সেটা শক্তিতে পরিণত করা-এসব দেখে পুরুষরা অবশ্য প্রথমে ব্যঙ্গ করে। এসময় রাজ্য পার্শ্ববর্তী রাজার দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই যুদ্ধে পুরুষরা দলে দলে অংশ নিয়ে মারা যেতে লাগলো। এবার সৌরকর আয়ত্তকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি প্রিন্সিপাল অদ্ভুত এক উপায় বের করলেন যুদ্ধে জেতার। তিনি পর্দার কারণে পুরুষদের অন্তঃপুরে যেতে বলেন। কেননা নারীরা যুদ্ধযাত্রা করবে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় মহারানির এই আদেশে পুরুষরা সম্মতি জানায়। এবং অনেকটা খুশি হয়েই তারা রাজি হয়। তাদের অস্ত্র গোলা-বারুদ নয়। তারা সার্চলাইটের মতো যন্ত্র দিয়ে সূর্যকিরণকে নিয়ে আলোকশক্তির মাধ্যমে শত্রুদের ঝলসে দেয়। শত্রুরা পরাজিত হয় আর তাদের সমুদয় অস্ত্র সূর্যকিরণে দগ্ধ হয়ে যায়।

নারীস্থানের মহারানি সিদ্ধান্ত নেয় পুরুষরা অন্দরমহলেই থাকবে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তাদের ডাকা হবে। ‘মর্দানা’ প্রথা বলা হচ্ছে এটাকে। সুলতানা যখন জানতে চান যে দেশের চুরি-ডাকাতির এবং হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে কে। এর উত্তরে ভগিনী সারা বলে মর্দানা প্রথা চালুর পর দেশের অপরাধ নেই বললেই চলে। কেননা যারা অপরাধ করত তারা সকলে শৃঙ্খলাবদ্ধ। এবং স্ত্রীলোকেরা বে-আইনী কাজ করলে তাদের সংশোধন করা বেশ সহজ। যারা বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ জয় করতে পারে তারা সবকিছুকে সুন্দরভাবে শেষ করতে পারে।

বিষয়টি অদ্ভুত। রোকেয়া দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণ অনুসন্ধান করে যেদিকে আলো ফেলেছেন তা অবিশ্বাস্য ভাবে সত্য। না, তাই বলে এটা বলা ঠিক হবে না যে সকল অপকর্ম পুরুষরাই করে। তবে বেশিরভাগই তারা করে এটা ঠিক। রোকেয়া ত্রিশ বছরের মধ্যে নারীস্থানের সামগ্রিক উন্নয়নের একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে একটা সাহসী পদক্ষেপের সূচনা করেছেন বলা যায়। ক্ষরা এবং অতিবৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ করে দেশের কৃষিকে বাঁচানো, আবহাওয়া অনুকূল রাখা, উৎপাদনশীল কাজে সকল শক্তি নিয়োগ করা, অলসতাকে পরিহার করে সকলকে কাজে সম্পৃক্ত করার মতো ব্যাপারগুলোতে আহামরি কিছু নেই। নতুনত্বও কিছু নেই। কিন্তু কিছু একটা তো আছে। একটা পরিকল্পনাকে সামনে রেখে সে অনুযায়ী কার্য করা এবং স্থির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া নারীস্থানের বিশেষত্ব এখানেই। সুলতানা ভেবে দেখেন ভারতবাসীর (তৎকালীন) বুদ্ধি জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যয় হয় না বরং সেগুলো সীমাবদ্ধ বক্তৃতা আর করতালিতে। ‘কোনো দেশ আপনা হইতে উন্নত হয় না, তাহাকে উন্নত করিতে হয়।’-রোকেয়ার এই চিন্তাটাকে মূল্যায়ন করেই বলা যায় তিনি সাধারণ বিষয়কে অভিনব রূপ দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।

নারীস্থানে মানুষ বায়ুযানে চলাচল করে আর করে পদব্রজে। বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে তারা দ্রুততম সময়ে ও স্বল্পখরচে এই ব্যবস্থার প্রচলন করেছে। তাদের অবাধ বাণিজ্যে আপত্তি নেই। কিন্তু পুরুষের সঙ্গে বাণিজ্যে তাদের আপত্তি। তাদের হীন মানসিকতার জন্য। পুরুষ নারীস্থানে কায়িক শ্রম দেয়। নারী মস্তিষ্ক পরিচালনা করে। সুচারুরূপে একটা কর্ম-পরিকল্পনা এবং কর্মবিভাজন করে নারীস্থান সকল স্তরে কল্যাণকে স্পর্শ করতে পেরেছে। রোকেয়া বলেন, ‘. . . নরনারী উভয়েই এই সমাজ-দেহের বিভিন্ন অঙ্গ,-পুরুষ শরীর। রমনী মন!’ খুব অসাধারণ এই চিন্তা। নারী আর পুরুষের মিলিত প্রবাহে জীবন সুন্দর, মনোরম, মনোহর হয়ে ওঠে। রোকেয়ার নারীস্থান সেটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। রোকেয়া নারীস্থানে যে স্বপ্ন দেখেছেন তার বাস্তবায়নের পথও বাৎলে দিয়েছেন। তাঁর চিন্তার বহুমুখিতা আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। সমালোচক সরিফা সালোয়া ডিনা বলেন :

মূলত রোকেয়ার আমৃত্যু ভাবনা ছিল অবরুদ্ধ নারীদের উন্নয়ন। এই উন্নয়নের জন্যই তিনি নারীদের পক্ষে কলম ধরেছেন। পার্সী মহিলারাও অন্তঃপুরের ঘেরাটোপ থেকে বাইরে এসে খোলা গাড়ীতে ঘোরেন, পুরুষদের সাথে কথা বলেন, ব্যবসায় করেন। এজন্য প্রথমদিকে তাদের অনেক কথা শুনতে হলেও তারা পিছপা হয়নি, স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছে,  বিলাতী সভ্যতা লাভ করেছে। অনুরূপ ভাবনার কারণেই রোকেয়া ‘নারীস্থানে’র মহারানীর অন্তঃকরণ গড়ে তুলেছেন সম্পূর্ণ আধুনিক মননশীলতায়। এই মহারানী বাল্যকাল থেকেই বিজ্ঞান চর্চায়, স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে উৎসাহী। ফলে রাজ্যে অসংখ্য বালিকা বিদ্যায়র স্থাপনের ফলে শিক্ষার আলোয় যাবতীয় অন্ধকার যেমন, কুসংস্কার দূর হল, বাল্যবিবাহ প্রথা রহিত হল। রাজ্যে মহিলাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ^বিদ্যালয় স্থাপিত হল। এই শিক্ষার সুফলরূপে ‘সুলতানার স্বপ্নে’র নারীরা কুসংস্কার মুক্ত, আধুনিক, বিজ্ঞানীরূপে নিজেদের গড়ে তুলতে পেরেছে। এখানে রোকেয়ার ব্যক্তি-স্বপ্নের যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে।

সমালোচকের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করাই যায়। তিনি রোকেয়ার চিন্তার এক স্পষ্ট রূপ আঁকার চেষ্টা করেছেন। রোকেয়া Sultana’s Dream ১৯০৫ সালে লেখেন যা গ্রন্থাকারে ১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয়। এর বেশ পরে সুলতানার স্বপ্ন রচনা করেন। যা ১৯২১ সালের মতিচূর গ্রন্থের ২য় খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়। রোকেয়া তাঁর এই স্বল্পায়তনের লেখাটির মধ্যে অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। অনেক দুঃসাহসী পদক্ষেপের কথা বলেছেন। যেগুলো এভাবে হয়তো অন্য কোনো সমাজব্যবস্থায় বলা হয়েছে। ম্যারি উলস্টোনক্রাফট, ভার্জিনিয়া উলফ কিংবা হালের চিমামান্দা এনগোজে আদেচে বলেছেন তাদের মতো করে। তাদের সঙ্গে রোকেয়ার একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। রোকেয়া যে সমাজে জন্মেছেন যে আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন চারপাশের যে জীবন দেখেছেন সেখানে এভাবে ভাবতে পারাটা ভীষণই অভিনব, চমৎকারিত্বে ভরা এবং দুঃসাহসীকতারও ব্যাপার বলেই আমরা ধারণা করি।

তিনি দেখিয়েছেন পুরুষের মানসিকতার দুর্বলতর দিকগুলোকে। এবং নারীদের মহত্তম দিকগুলি। তিনি সমাজকে অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গিকে তোয়াক্কা না করে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা তথা কর্মপদ্ধতি উপস্থাপন করেছেন। বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন রোকেয়া অশিক্ষা আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতবর্ষে বসে। এরোপ্লেনে না চড়েও বায়ুশকটের কথা এমনকি তার ওড়া এবং জ্বালানি সংক্রান্ত বিষয়েও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা উপস্থাপন করেন। একটা ছোট্ট গ-ির মধ্যে থেকেও রোকেয়া একটা রাজ্য পরিচালনার সামগ্রিক দিককে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর সুলতানার স্বপ্ন লেখাটায়। এ যেন এক স্বপ্ন যা প্রত্যেক নারী দেখে থাকে। তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা পাবে, বিকশিত হতে পারবে নিজেরা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করার পাবে অবাধ সুযোগ সর্বোপরি ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে নিজেকে।

রোকেয়া নারীর আত্মপ্রত্যয়ী রূপের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে সম্মানের চোখে দেখেছেন। এবং তাঁর ধারণা একমাত্র শিক্ষার আলোই পারে নারীকে নিজের জায়গা তৈরি করে দিতে। শিক্ষা মনকে কলুষমুক্ত করে। তবে এই আলো কেবল নারীর জন্য নয় অন্ধকারে আচ্ছন্ন পুরুষের মনেও আসা দরকার। তাদের চিন্তায় যে পুরোনো সংস্কার বাসা বেঁধে আছে। মগজে কারফিউ চলছে কাল থেকে কালান্তরে- সেখান থেকে তাদের বের হয়ে আসার সময় এসেছে। দৃষ্টির স্বচ্ছতা খুবই দরকার। তাহলেই নতুন দিনকে নতুন আলোয় দেখতে পারবে, গ্রহণ করতে পারবে অনায়াসে।

রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন আজকের সমাজের জন্যও প্রাসঙ্গিক। অনেকে বলে থাকেন রোকেয়া পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টি দিয়েই নারীকে দেখেছেন। যে সমাজব্যবস্থায় তাঁর বেড়ে ওঠা সেখানে এরকমটা হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু সুলতানার স্বপ্নতে রোকেয়াকে ভিন্নভাবে আবিষ্কারের সুযোগ আছে। পুরুষতন্ত্রের গড়ে দেওয়া ছাঁচে নয় বরং সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নারীকে দেখেছেন। এখানে তিনি যে নারীস্থানের স্বপ্ন দেখেছেন তা তো আসলে এক অর্থে নারীর ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করার কথা বলে। আজকের পৃথিবীর স্লোগানও তো তাই নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করা। রোকেয়ার চিন্তার আধুনিকতা এখানেই। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে আরও সামনের অর্থাৎ একশ বছর পরের সমাজকে দেখেছেন। সেভাবেই পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছেন। নারীর অধিকার, ক্ষমতায়ন এবং পুরুষের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে এক সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে। যে সমাজে অর্থনৈতিক সংকটও থাকবে না। প্রকৃতিকে বশীভূত করা হবে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধন করে। কেবল এখানেই নয় রক্তপাতহীন লড়াইয়ের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ না করা কিংবা কৌশলে শত্রুকে পরাস্ত করার ব্যাপারটিও বেশ দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার ব্যাপারে নারীস্থান সদা তৎপর। সেখানে ক্ষরা এবং অতিবৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণের সফল চেষ্টা করা হয়েছে। বিজ্ঞানচর্চাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা আজকের সমাজে করা হচ্ছে। অথচ রোকেয়া অনেক আগে এমনটা বলে গেছেন। রোকেয়ার চিন্তাকে আজকের দিনে কাজে লাগিয়ে একটা সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেতেই পারে।

তাই সুলতানার স্বপ্ন রোকেয়ার এক সুচিন্তিত, সুব্যাখ্যাত, সুপরিকল্পিত লেখা। জীবনকে সহজ করে দেখার জন্য, জীবনের জয়গান গাওয়ার জন্য, নারীর জীবনকে মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য রোকেয়া এমন স্বপ্ন দেখেছেন। নারীর অবমূল্যায়ন সমাজকে কিছু দিতে পারে না। রোকেয়া সেটা বুঝেছিলেন তাঁর সমাজের অন্য মানুষদের চেয়ে একটু বেশি ভালোভাবে। তাই নারী জাগরণের অগ্রপথিক, প্রগতিশীল চিন্তার মানুষটি নারীদের আত্মবিকাশের জন্য কলম দিয়ে লড়াই চালিয়েছেন একটা প্রতিকূল সমাজব্যবস্থার সঙ্গে। প্রতিষ্ঠা করেছেন অকাট্য সব যুক্তি আর উদাহরণ। সমাজকে ভাবতে, নড়েচড়ে উঠতে বাধ্য করেছে তাঁর চিন্তার দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা, যুক্তিশীলতা আর আধুনিকতা। সুলতানার স্বপ্ন এক প্রগতিশীল মানুষের প্রগতিশীল ও মননশীল চেতনার প্রকাশ। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক স্মারক। নারীর মুক্তিকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ এক দুঃসাহসী অভিযাত্রা, দুঃসাহসী পদক্ষেপ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *