November 21, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

আইটেম গানে নারীর শরীর ও পুঁজিবাদী বাণিজ্যিকীকরণ

সাকিব শাকিল।। বিশ্ববাজারে সবকিছু আজ পণ্য। বিশ্বব্যাপী বৈর উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষের মূল্যায়ন শুধু মাত্র উৎপাদন কেন্দ্রীকতায় পরিণত হয়েছে। মানুষ যেন আজ যন্ত্র। মানুষের শ্রমের জায়গা প্রযুক্তি ক্রমশই দখল করে নিলেও প্রযুক্তির উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে শ্রমের শোষণ আরো তীব্রতর ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকারত্ব, দরিদ্রতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য মানুষকে করে তুলেছে আরো কোণঠাসা। যার ফলে এইসব সমস্যার সুযোগ নিয়ে বৃহৎ পুঁজিপতিরা অধিক শ্রম আদায় করে নামমাত্র পারিশ্রমিক মূল্য দিয়ে গড়ে তুলছে টাকার পাহাড়। মানুষের আবেগ, অনুভূতি, দেহ, মন,শরীর সবকিছু ক্রয় ও বিক্রয়ের জন্য পুঁজিবাদ তৈরি করেছে মুক্তবাজার অর্থনীতি।

পুঁজির একচেটিয়া উৎপাদন ব্যবস্থা মুক্তবাজার সৃষ্টির লক্ষ্য অনুন্নত পুঁজির দেশগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তৈরি করছে নয়া উপনিবেশ, হস্তক্ষেপ করছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে। বিশ্বব্যাপী তৈরি করছে সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধ, জঙ্গীরাষ্ট্র, আগ্রাসনের ভয়াল থাবা। এই বৃহত্তর ধনতান্ত্রিকতাবাদের হাত থেকে কারো মুক্তি নেই।

আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত শোষিত হয়ে আসছে নারী। দাসযুগে নারী ব্যবহৃত হয়েছে দাসী হিসবে, সামন্তবাদী সমাজে নারী ব্যবহৃত হয়েছে গৃহবন্দি অবস্থায় জমিদার প্রভুদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে।
নারীকে অদমিত করে রাখা হয়েছে প্রতিটা সেক্টরে। যেন পৃথিবীর প্রথম আঘাত নারীর উপরেই প্রয়োগ করে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যুদ্ধবিগ্রহ, দুর্যোগ, মৃত্যু সবকিছুতেই নারীকে হতে হয়েছে ধর্ষিত, ক্ষতিগ্রস্ত, নির্যাযিত, নিষ্পেষিত। এসবকিছুর মূলে  নারীর শরীরকেন্দ্রীক পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ও এর পৌশাচিকতার প্রয়োগই প্রধানত দায়ী।
বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতেও রাস্তাঘাটে, কলেজ, ক্যাম্পাসে, অনলাইন জগতে নারী নানাভাবে হেনস্তার শিকার। পুরুষতান্ত্রিক উন্নয়নশীল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে নারী পরিণত হয়েছে ব্যবসার অন্যতম প্রধান বস্তুতে। নারীর শরীরকে কেন্দ্র করে পুঁজি তার বাজারে ছাড়ে ফেয়ার এন্ড লাভলী ক্রিম, সাত দিনে ফর্সা হওয়ার নিঞ্জা টেকনিক, ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট, পর্ন ইন্ড্রাস্ট্রি, রাস্তাঘাটে হারবালের বিজ্ঞাপন, সেরা সুন্দরী প্রতিযোগিতা। বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য হয় নারীর শরীরকেন্দ্রীক সহিংস গানের লিরিক, জমজমাট বিগ বাজেটের আইটেম গান।

ভরা মজলিসে শত শত পুরুষের মাঝে একজন নারী নেচে যাচ্ছে বিভিন্ন কসরতে, তাকে কেন্দ্র করে শত পুরুষের ভিড়, মদ, মাস্তি ও মিউজিকে গড়ে তোলা হয়েছে নারীর শরীরকেন্দ্রীক একটা জমকালো পরিবেশ। এরকম দৃশ্যের চিত্র কল্পনা করলে আমাদের মনে ভেসে ওঠে আইটেম গানের ইমেজ।

বিনোদন জগতের জন্য মিডিয়ার নির্মাণ শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মিডিয়া আমাদের ব্যক্তিত্বে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত কালচার চর্চার ক্ষেত্রে হেজিমোনিক ভূমিকা রাখে আমাদের জীবনে। ব্যক্তি মানসের ভেতরে ভেতরে সৃষ্টি করে অদৃশ্য এক ভাবাদর্শ।

চলচিত্র নির্মাণে আইটেম গানগুলি নারীর প্রতি সহিংস ভাবাদর্শ গড়ে। যেখানে দর্শকের বিনোদনের একমাত্র উপভোগের বস্তু হয় নারীর শরীর। যা একজন মানুষকে নারী যে শুধু ভোগপণ্য, তার প্রতি সহিংসতার একটা অবৈধ বলপ্রয়োগকারী দিক তৈরি করে। এসব গানে নারীর পোশাক, অঙ্গভঙ্গি, নাচ, আরো বিভিন্ন এক্সপ্রেশন, স্তন, নিতম্ব, কোমর, নাভী- মোটকথা পুরুষের চোখে নারীর যৌনাকর্ষী অঙ্গ ও ক্যামেরার কারসাজিগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, কলকাতা ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমায় আইটেম গানগুলোতে যৌন নির্যাতনকে স্বাভাবিক করার সংস্কৃতি এবং নারীদেহকে অযত্ন ব্যবহারের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই। আইটেম গানগুলি ঘোষণা করে যে নারীদের দেহ শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য যা তারা নিজেরাই প্রদর্শন করে শত শত পুরুষের মাঝে এবং নারীকে উদ্দেশ্য করে নোংরা কথাবার্তা তাদের কামনাকে উস্কে দেয়।

আইটেম গানগুলিতে নারীকে যৌন হয়রানি নারীর কাছে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হিসাবে চিত্রিত করা হয়, এই বার্তাটাই নির্মাতারা প্রচার করে যে এসব ক্ষেত্রে নারীর  প্রথম অস্বীকৃতি আসল নয়।

ভারতে ফেমিনিস্ট সংগঠনগুলি জানিয়েছে এই গানগুলি যৌন হয়রানির বৈধতা দেয়; কিছুদিন আগে তারা একটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে দাবি করেছে যে “আইটেম গানের কোরিওগ্রাফি প্রায়শই গণশ্লীলতাহানির ঘটনা বা গণধর্ষণের অনুকরণ করে।” বেবি ডলে এটি স্পষ্ট হয়, যখন অভিনেত্রী সানি লিওন হাতের মুঠোয় নিজেকে স্পর্শ করে নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকে।

আইটেম গানের লিরিক্স নারীকে প্রায়শই তন্দুরি মুর্গী (ফেবিকল সে আইটেম সং), একটি মুরগির থালা বা আফগান জলেবি, মিছরির দানা, আইটেম বোম, মাংসের পিস, ঝালমুড়ি, লাল টমেটো, চমচম, রসগোল্লা, আঙুর, আইসক্রিম, কোকাকোলা, পান জর্দা জাতীয় উপভোগ্য জিনিসের সাথে তুলনা করে।

আইটেম গানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে নারীকে হেয় করা ভাষায় লেখা আইটেম গানের লিরিকগুলি শতকরা ৯০ ভাগই নারী কণ্ঠশিল্পীদের  গাওয়া। প্রকৃতপক্ষে এই গানগুলো নারী শিল্পীদের দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে গাওয়ানো হয়। কলকাতার তুলনায় বাংলাদেশের গানের লিরিকগুলি আরো বেশি নারী অবমাননাকর। বাংলাদেশে একসময়কার বিগ্রেড মুভিতে গাওয়া গানগুলি ও দৃশ্যায়ন আমাদের গভীরভাবে ব্যথিত করে।

বলিউডে যেটা সর্বোচ্চ মাত্রায় চলে গেছে তা হলো প্রত্যেকটা সিনেমাতে একটি করে আইটেম গান থাকবেই। আইটেম গানের ভাষা নির্ধারণ করে যে নারী নিজেই কামনাকাতর, সে নানাভাবে পুরুষকে কামনা করে, তার শরীরের চাহিদা শুধুমাত্র যৌনতাকেন্দ্রিক। ভারতে ইভটিজিং গবেষণায়, ছাত্রীরা জানিয়েছে তারা যখন ইভটিজিংয়ের স্বীকার হয় তখন এইসব আইটেম গানের রাফ ওয়ার্ড তাদেরকে শোনানো হয়।

নারীর নিজস্ব যৌনতা, চাওয়া-পাওয়া পুঁজিবাদী বাণিজ্যের খপ্পরে পড়ে বাড়িয়ে তুলছে নারী সহিংসতা। নারীর শরীরকেন্দ্রীক পুঁজির বিনিয়োগ পুরুষতান্ত্রিক সেন্টিমেন্টকে মাথায় রেখে এইসব সিনেমা নির্মাতারা গড়ে তুলছে টাকার পাহাড়। নিম্নমানের নির্মাণ, দুর্বল প্লটের সিনেমা দিয়েও শুধুমাত্র আইটেম গানকে কেন্দ্র করে অনেক সিনেমার নির্মাতা প্রডাকশন খরচ তুলে নেয়। প্রযুক্তির এই যুগে একটি গান রিলিজ হওয়ার সাথে সাথে মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ থেকে আইটেম গানের নির্মাতারা ইনকাম করে। সম্প্রতি নোরা ফাতেহির দিলবার দিলবার গানটি রিলিজ হওয়ার সাথে সাথেই মিলিয়ন ভিউ হওয়ার রেকর্ড গড়ে।

আইটেম গানে বলিউডের অনেক স্টার অভিনেত্রী অভিনয় করলেও বেশিরভাগ অভিনেত্রীর রয়েছে আইটেম গানের বিরুদ্ধে অভিযোগ। তনুশ্রী দত্ত, মালাইকা অরোরাকে লোক সম্মুখে শুনতে হয়েছে আইটেম গার্ল শব্দ ব্যবহার করে উত্যক্ত গালি।
আইটেম গানে পারফর্ম করা নারীদের হতে হয়েছে সামাজিক নিগৃহীতির শিকার। বাণিজ্যিক সিনেমা তার তৈরি করা ‘আইটেম গার্ল’ শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহার করে নারীকে হেয় করছে সমাজের  কাছে।

বাংলাদেশের আইটেম গানে পারফর্ম করা বিপাশা কবিরের একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো (জুন ২৭, ২০১৫) প্রতিবেদনটির শিরোনাম—আইটেম গানে অনীহা আইটেম কন্যার!

প্রতিবেদনটির শিরোনাম লক্ষণীয়। অনেকগুলো আইটেম গান করা বিপাশা কবিরকে আইটেম গার্লই মনে করে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক, যেন লাক্স তারকা বিপাশা কবিরের  অন্য কোনো পরিচয় নেই! শিরোনামটিতে খুব সূক্ষ্মভাবে আইটেম গানে পারফর্ম করা নারীকে হেয় করা হয়েছে। যে আইটেম গানে একবার পারফর্ম করেছে তার চিরকাল আইটেম গানই করতে হবে এমন সম্মতি উৎপাদনের প্রচেষ্টা আছে সংবাদের শিরোনামটিতে।

বিপাশা কবির এই প্রতিবেদনটির প্রেক্ষিতে নেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি আর আইটেম গান করবেন না। সিনেমার মূল নায়িকার চরিত্রেই অভিনয় করতে চান। বলেন, নায়িকা হতে এসেছিলাম, হয়েছি আইটেম গার্ল।

বিপাশা কবিরের এই কথার ভেতরেই বোঝা যায় আইটেম গানে পারফর্ম করা নারীর সামাজিক বঞ্চনা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই লাঞ্চনা বঞ্চনার ক্ষেত্রটি আরো বেশি তীব্র। নারী তার ব্যক্তিগত মনোবৃত্তি, আবেগ, কামনা বাসনা ব্যক্তিগত বিষয়ে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা নিয়ে চলবে। কিন্তু বাণিজ্যিক ধারার আইটেম গানগুলোতে তার পোশাক, এক্সপ্রেশন, অঙ্গভঙ্গি সবকিছু নির্ধারণ করে দেয় এর পেছনে অর্থলগ্নকারী প্রযোজকরা।

শাবানা আজমির মতে, “যখন কোনও নারী নিজের যৌনতা উদযাপন করতে চায়,  আমার এতে কোনও সমস্যা নেই। আমি মনে করি নিজের যৌনতা, পোশাক নির্বাচন একটা দুর্দান্ত বিষয় । তবে নিজের যৌনতা উদযাপনের ভান করে আপনি যখন বাণিজ্যিক সিনেমায় নারীকে যৌনকামনার বস্তু হিসবেই চিত্রিত করছেন তা পুরুষের দৃষ্টিতে নারীর আত্মসমর্পণ করা।”

অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক নারী আইটেম গান করে থাকেন। পুঁজি তার বৈর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে নারীর শরীরকে কেন্দ্র করে এভাবেই ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করে চলছে।

আমরা চাই নারীর শরীর নয়, নারী তার মেধাবুদ্ধি দিয়েই বিভিন্ন জায়গায় যোগ্য স্থান নির্ধারণ করে  নেবে। নারীর ক্ষমতায়নে যে ট্যাবু এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান, নারী  তার মেধা, দক্ষতা, ও সৃজনশীলতায় সেই ট্যাবু ভেঙে চুরমার করে দেবে একদিন। আগামীতে উন্নত প্রতিটা বিশ্বের ক্ষমতায়নে নারী তার অগ্রগণ্য প্রগতিশীল ভূমিকা রাখতে প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়াবে। নারী হয়ে উঠবে সুকান্তের কবিতার মতো দৃঢ়, আত্মনির্ভরশীল, স্বাধীন; যে জ্বলে পুড়ে মরে ছাড়খাড় হবে তবু কখনও মাথা নোয়াবে না।

তথ্যসূত্র:

১.
The Bollywood Dilemma
By Sarah Deonarain (January 18, 2020)

Herverd Political Review

২.
Is it time to bury the item song?
Damini Kulkarni
Oct 07, 2018 (scrool.in)

৩. ইন্টারনেট

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]