November 2, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্রে ‘ঊনমানুষে’র অর্থ-সম্পদের অধিকার কতটুকু?

আফরোজ ন্যান্সি।। পুঁজিবাদই পুরুষতন্ত্রের মূল প্রাণশক্তি। পুঁজিবাদ হলো সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদের মালিকানা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সম্পদের অধিকাংশই অল্প কিছু পুঁজিপতিদের কুক্ষিগত হয়। সমাজে সৃষ্টি হয় আয়-বৈষম্য, ধনীরা ক্রমশ ধনী হতে থাকে আর দরিদ্র হতে থাকে হতদরিদ্র। পুঁজিবাদের ফলে যেসব সামাজিক শোষণমূলক অবস্থার সৃষ্টি হয়, তার প্রধানতম শোষণব্যবস্থার নাম পুরুষতন্ত্র। বলা যেতে পারে, পুঁজিবাদ থেকেই জন্ম নিচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

লক্ষ্য করে দেখুন, পুঁজিবাদে যে শোষণের চর্চা, পুরুষতন্ত্র সেই একই শোষনকে জারি রাখে, প্রকারান্তরে আরো বাড়িয়ে তোলে। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানার উপর ভিত্তি করে সমাজের মধ্যে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ইত্যাদি শ্রেণি বিভাগ বা শ্রেণি বৈষম্য সৃষ্টি হয়। একইভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষকে অন্যান্য লিঙ্গের তুলনার উচ্চতর অবস্থানে ভাবতে শেখানো হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় একপক্ষ মালিক, অন্যপক্ষ দাস। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এক পক্ষ মানুষ, অন্যপক্ষ ঊনমানুষ। নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ, হিজড়াকে তৃতীয় লিঙ্গ নির্ধারন করে দিয়ে পরোক্ষভাবে বলে দেওয়া হয় যে পুরুষেরাই প্রথম লিঙ্গ।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা তার বাণিজ্যিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করে শোষণের হাতিয়ারগুলি বাঁচিয়ে রাখতে। সমাজের উচ্চবিত্তরা এখানে প্রথম শ্রেণির নাগরিক, তাদের স্বার্থ বজায় রাখাই রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পায়। একইভাবে একজন পুরুষ, নাগরিক হিসেবে নারী কিংবা ট্রান্সজেন্ডারদের চাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত পুরুষের হাতেই কুক্ষিগত থাকে ক্ষমতা। সমাজের ও রাষ্ট্রের স্টিয়ারিং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের হাতেই থাকে। ফলে একজন পুরুষকে শিশু বয়স থেকে শেখানো হয় অর্থ উপার্জন করাই তোমার একমাত্র কাজ। শিশু থেকে পুরুষ হয়ে ওঠার এই পুরো সময়টা মনে ও মননে সে উচ্চবিত্ত হওয়ার চেষ্টাই করতে থাকে, কেননা তাকে জানানো হয়েছে উচ্চবিত্ত হলেই কেবলমাত্র  ক্ষমতার শীর্ষে যেতে পারবে সে। সবাইকে দাস বানিয়ে, নিজে প্রভু হয়ে থাকতে পারবে। একজন পুরুষ তখনই কেবল পুরুষ হয়ে ওঠে যখন যে উপার্জন করা শেখে। তা সে যে উপায়েই উপার্জন করুক সেটি সমাজের ধর্তব্য নয়। প্রবাদ আছে, অর্থের গায়ে কোনো কালিমা থাকেনা (পুরুষের অর্থের গায়ে কালিমা না থাকলেও ক্ষেত্রবিশেষে নারীর উপার্জিত অর্থের গায়ে ঠিকই থাকে)। আমাদের সমাজে অর্থ উপাজর্ন করে না এমন পুরুষদের কে মশকরা করে বলা হয় হিজড়া অর্থাৎ সে ঊনমানুষ, তৃতীয় স্তরের মানুষ। তাকে মানুষের কাতারে পৌঁছাতে হলে অর্থ উপার্জন করতে হবে, প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে হবে, সারাজীবন উপার্জন করেই যেতে হবে। গড়তে হবে সম্পদের পাহাড়। নিজের এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য। যত বেশি অর্থ হবে ততবেশি যেকোনো ধরণের অন্যায় করে পার পেয়ে যেতে পারবে সে।

এলএসডি নামক এক ভয়াবহ মাদক বিক্রেতা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরেও তার চোখে-মুখে যে অহংকারের হাসি তার মূল জোর কিন্তু ওই অর্থই। সে জানে তাকে স্বয়ং এই রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখবে। এই মাদক বিক্রেতার উপর আবার ঝাঁকে ঝাঁকে তরুনী ক্রাশ খাচ্ছে। এই ক্রাশ খাওয়া যতটা না চেহারার উপর তার চাইতে বেশি অর্থের উপর। এই একই তরুনীরা কিন্তু কোনো চা-সিগারেট বিক্রেতার প্রেমে পড়বেনা যতই সুন্দর চেহারা (প্রচলিত অর্থে) হোক। এই তরুনীরাও ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থারই গিনিপিগ। একই জিনিস আমরা বসুন্ধরার মালিক আনভীরের ক্ষেত্রেও দেখেছি। আনভীর যত অপরাধনই করুক মানুষ তার পেছন পেছন ঘুরবে, তার পক্ষে কথা বলবে, মিডিয়া তার পক্ষে থাকবে, রাষ্ট্র তার ব্যাপারে নীরব অবস্থানে থাকবে, নারীরা তার প্রেমে পড়বে, স্ত্রী তার সঙ্গে জীবনযাপন করবে। এটিই ধনতান্ত্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। যুগ যুগ ধরে এই ব্যবস্থা টিকে আছে। আরো সমৃদ্ধ, আরো প্রসারিত হয়েছে, হচ্ছে। কিছু মানুষ নিজের স্বার্থে টিকিয়ে রাখছে এই ব্যবস্থাকে।

শুধু রাষ্ট্র কিংবা সমাজ নয়, পরিবারও এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পারিবারিক সম্পর্কগুলি এই ব্যবস্থার মধ্যে অনিবার্যভাবেই ক্রমশ নিছক ব্যবসায়িক লেনদেনের জায়গায় গিয়ে ঠেকে। পুরুষ সদস্যটি সংসারের অর্থের চাহিদা মেটাচ্ছে বলেই পরিবারের বাকি সদস্যদের বিশেষত নারী  ও শিশুদের নিয়ন্ত্রন করার ক্ষমতাও অর্জন করে। পরিবারে পুরুষ সদ্যসটির জবাবদিহিতা অন্য সদস্যদের তুলনায় নেই বললেই চলে। উপরন্তু প্রভু ও দাসনীতি এখানে আরো পোক্ত। শ্রমিক তবুও নূন্যতম মজুরি পায় অথচ পরিবারগুলিতে নারীকে বিনা পারিশ্রমিকে যুগ যুগ ধরে খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তার পরিশ্রমকে সেবা-ভালোবাসার মোড়কে সাজিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছে। অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে বছরে নারীদের বেতনহীন কাজের অর্থমূল্য ১০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোম্পানি অ্যাপলের বার্ষিক ব্যবসার ৪৩ গুণ বেশি। এই বিশাল পরিমান পারিশ্রমিক আমাদের নারীরা চাইতে শেখেনি আজো। প্রচলিত নারীত্ব এবং মাতৃত্বের গোলকধাঁধায় পাঁক খেয়ে বেড়াচ্ছে কেবল। নারীকে শেখানো হয়েছে, পুরুষ করবে বাইরের কাজ আর নারী করবে গেরস্থালির কাজ। পুরুষটি যদিও বাইরের কাজ করে পারিশ্রমিক পাচ্ছে আবার সেই পারিশ্রমিকের জোরে নিয়ন্ত্রণ করছে পরিবারের নারী, শিশু ও বৃদ্ধ সদস্যদের কিন্তু ঘরের কাজ করার বিনিময়ে নারীকে কোনো পারিশ্রমিক তো দেওয়া হচ্ছেই না বরং তাকে অধীনস্ত করে রাখা হচ্ছে।

পাশ্চাত্য সমাজে আজো গেরস্থালীর ৭০ ভাগ কাজ নারীরা করে, প্রাচ্যে এই জরিপ করাই হয় না বোধহয়, আমরা এতোটাই পিছিয়ে আছি। আমাদের পুরুষদের একটা খুব প্রচলিত কথা হচ্ছে, আমার বৌ কিছু করে না। কিছু করে না বলতে মূলত অর্থ উপার্জন করেনা বোঝানো হয়। আপনি যাই করুন না কেন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দিন শেষে আপনার পরিশ্রমের আর্থিক মূল্য কতটা এটাই ধর্তব্যের বিষয়। এ ধরণের পুঁজিপন্থী সমাজে যার অর্থ কম সেই সেবাদাস, সেই শ্রমিক, সেই প্রান্তিক, সেই দলিত।

অনেক বছর পর্যন্ত নারীর অর্থোপাজন করাটা একেবারেই মেনে নেয়নি পুরুষতন্ত্র। তবে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার নিজের প্রয়োজনে নারীকে গ্রহণ করছে, তবে শোষণ জারি রাখার জন্য নারী ও পুরুষের পারিশ্রমিকে রেখে দিয়েছে বিশাল ব্যবধান। আজ অব্দি পৃথিবীব্যাপী নারীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে পারিশ্রমিকের এই বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নিয়ে। অন্যদিকে, নারীরা ঘরে-বাইরে নানা ধরণের কাজ করে অর্থোপার্জন করছে ঠিকই তবু সেই টাকার উপর কতটা অধিকার থাকে নারীর? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শুরু থেকে নারীর মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে নারী মানে কোমল বস্তু, নারী মানে নির্লোভ, নারী মানে সেবিকা, অতএব নারীর টাকার প্রতি লোভ থাকতে নেই। নারী যা কিছুই করবে নির্লোভ অবস্থানে থেকে করবে, নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে তার পরিবারের সেবায় উজার করে দেবে। নারীকে শেখানো হয়, তোমার টাকা তোমার নয়, তা তোমার পরিবারের। এমন বহু নারী আছেন যারা চাকুরি করে মাস শেষে বেতনের এক পয়সা নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারেন না। বলাই বাহুল্য নারীর হাতে পুঁজি সঞ্চিত হোক তা পুরুষের কাম্য নয়।

একজন চাকুরিজীবী নারী হিসেবে একটা প্রশ্ন প্রায়শই আমি শুনি। তুমি তো মেয়েমানুষ, তুমি টাকা দিয়া করবা কী? নিতান্ত হাস্যরস করে বলা হলেও এই কথার পেছনের যে মানসিকতা তা আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ লালন করেন। নারীর টাকার প্রয়োজন নেই, নারীর সম্পদের প্রয়োজন নেই, নারী টাকা দিয়ে কী করবে, নারীর জীবন ধারণের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তার যোগান দেবে অন্য একজন পুরুষ, বিনিময়ে নারীটিকে যথেচ্ছা ভোগ করার, নিয়ন্ত্রণ করার, অসম্মানজনক অবস্থানে রাখার ক্ষমতা অর্জন করবে পুরুষটি। অতএব, নারীকে কম পারিশ্রমিক দাও, নারীকে অর্ধেক সম্পদ দাও।

পুঁজিবাদী-পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনোই সাম্যবাদী সমাজের প্রতিষ্ঠা চাইবে না। কেননা সাম্য প্রতিষ্ঠা হলে এই পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজটি গুড়িয়ে যাবে। প্রভুর আসনটি তখন আর ধরে রাখা যাবে না। অতএব, প্রভুকে আসনচ্যুত করে মর্ত্যে নামিয়ে আনার কাজটি ‘ঊনমানুষ’দেরই করতে হবে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]