November 21, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

মেয়েদের ওড়না সরে গেলেই পৃথিবীতে গজব নেমে আসে

নাহিদা নিশি।। ‘‘এটা বাংলাদেশ, ইউরোপ কিংবা আমেরিকা না। এখানে মেয়েদের ওড়না ছাড়া ঘোরা যাবে না। এখানে মেয়েদের বিড়ি-সিগারেট খাওয়া যাবে না। এখানে মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে থাকা যাবে না। এখানে মেয়েদের উচ্চস্বরে হাসা যাবে না। এখানে মেয়েদের বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ট্যুরে যাওয়া যাবে না। এখানে মেয়েদের নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়া যাবে না। এখানে মেয়েদের গার্ড অব অনারে উপস্থিত থাকা যাবে না। এখানে মেয়েদের ব্লা ব্লা ব্লা…..”

এইসব কথা বলে মানুষজন ঠিক কী ইঙ্গিত করে আমি জানি না। ইউরোপ-আমেরিকা খারাপ দেশ? সেখানকার মেয়েরা সব ‘পতিতা’? নাকি সেখানে নারীদের নিরাপত্তা তুলনামূলক বেশি? বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের মেয়েদের সমস্ত কিছুর অধিকার আছে। সংবিধানের কোথাও নির্ধারণ করে দেয়া হয় নাই, এখানকার মেয়েদের পোশাক কী রকম হবে! কোথাও লেখা নাই, মেয়েরা রাতে বের হতে পারবে না, মেয়েরা ওড়না ছাড়া বের হতে পারবে না। সংবিধানে অশালীন (!) পোশাক পরার অপরাধে রাষ্ট্র কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করে নাই, বরং টিজ করার শাস্তি আছে, ধর্ষণের শাস্তি আছে, নিপীড়নের শাস্তি আছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী- ‍পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না’। সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরের নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’।

হ্যাঁ, এটা বাংলাদেশের সংবিধান। অথচ কে মানে? এখানকার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই ধর্ষকের শাস্তির চেয়ে ধর্ষণের শিকার নারীর দোষ খুঁজে বের করতে ব্যস্ত থাকেন। এখানকার মিডিয়াকর্মীরা চাপে পড়ে কখনো কখনো ধর্ষক কিংবা নিপীড়কের বিরুদ্ধে কথা বললেও শেষে গিয়ে মেয়েদের পোশাক আর শালীনতার উপরেই দোষ চাপান। ‘কিন্তু’, ‘যদিও’ এসব বলে বলে কৌশলে ভিক্টিম ব্লেমিং করে যান।

সংবিধানের ২৮(৩) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা আছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না।’

অথচ পরীমণি ইস্যুতে বেশিরভাগ লোকজনই বলছে, “এটা ইউরোপ-আমেরিকা না। একটা মেয়ে এতো রাতে ক্লাবে যাবে কেন!” যদিও প্রশ্নটা হওয়া উচিত ছিলো, “একটা ছেলে যদি রাতের বেলা নিশ্চিন্তে ক্লাবে যেতে পারে, একটা মেয়ে পারে না কেন”?

এটা তো গেল আমজনতার কথা, অশিক্ষিত, অসচেতন মানুষের কথা। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, যারা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের দায়িত্ব নেন, তারা কি সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল? রাষ্ট্র যে নারী-পুরুষ’কে সমান অধিকার দিয়েছে, সেই সম্পর্কে তারা কতটুকু ওয়াকিবহাল?

গত ১৩ই জুন মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার ক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে মত দেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয়্রভাবে সম্মান জানায় সংশ্লিষ্ট জেলা কিংবা উপজেলা প্রশাসন। ডিসি বা ইউএনও সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে উপস্থিত থাকেন। যেহেতু দেশের শতাধিক উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্বে নারী কর্মকর্তারা রয়েছেন, সেহেতু নারী কর্মকর্তারাই গার্ড অব অনার দিয়ে থাকেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারী ইউএনওর বিকল্প হিসেবে কোনো পুরুষকে গার্ড অব অনারে উপস্থিত থাকার জন্য সুপারিশ করেন।

সংবিধান অনুযায়ী এটা কি তারা করতে পারেন?

যদিও “নারী ইউএনও” বলে কোনো পদ নাই আমাদের দেশে, সকলকেই সমান প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে হয়, যদিও কোনো চেয়ারই ‘নারী-পুরুষ’ বোঝে না। তবু নারী ইউএনও, নারী ডিসিদের নারী হওয়ার কারণে অসন্মানিত হতে হয়। বলা হচ্ছে, নারী ইউএনও গার্ড অব অনারে উপস্থিত থাকতে পারবেন না- কারণ ধর্মমতে নারীদের জানাজার নামাজে অংশগ্রহণের বিধান নেই, কারণ গার্ড অব অনারে নারী ইউএনওর উপস্থিতিতে স্থানীয় পর্যায়ে লোকজন আপত্তি জানাচ্ছেন।

প্রথমত, জানাজার নামাজ হলো সম্পূর্ণ ধর্মীয় ব্যাপার, জানাজার নামাজের সাথে গার্ড অব অনারের কোনো সম্পর্ক নেই, এটা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া। তাছাড়া দেশের সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা তো আর মুসলিম না!

দ্বিতীয়ত, কেউ যদি আপত্তি জানায়, তাহলে রাষ্ট্রের উচিত সেইসব আপত্তি জানানো লোকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, তাদেরকে সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরামর্শ দেয়া। কুকুর যদি পাগল হয়ে মানুষকে কামড়াতে শুরু করে তাহলে আমরা নিশ্চয়ই কুকুরের ভয়ে ঘরে বসে থাকবো না, ক্ষ্যাপা কুকুরটিকে আটকানোর ব্যবস্থা করবো। তাই রাষ্ট্রের উচিত কারো আপত্তির প্রতি সন্মান না দেখানো। এটা সাংবিধানিক ব্যাপার, এটা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকারের ব্যাপার, কোনো মামা বাড়ির আবদার না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, খুন-খারাপি, ঘুষ, সুদ, জিনা, ধর্ষণ, পরকিয়া, প্রতারণা, মদ, নেশা সবই এই দেশে খুব ভালোভাবে চলে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী যে এগুলো জঘন্যতম অপরাধ, এটা কারো মনে থাকে না, ইনবক্সে ন্যুড দেয়ার সময় কারো মনে থাকে না যে, সে একজন মুসলিম! শুধুমাত্র নারীর বেলায়ই সকলের মনে পড়ে যায় যে, বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ। খুন-ধর্ষণ, চুরি, প্রতারণা কোনো কিছুতেই ধর্মের কোনো ক্ষতি হয় না, শুধুমাত্র মেয়েদের বুকের ওড়না সরে গেলেই পৃথিবীতে গজব নেমে আসে, মেয়েরা গার্ড অব অনার দিলেই ধর্মের প্রাচীর ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে।

রোকেয়া বলেছিলেন, “যখনই কোন ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন তখনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।” এরচেয়ে বড় কোনো সত্য নাই।

এই তো কিছুদিন আগেই, হাইকোর্ট নারীদের নিকাহ রেজিস্ট্রার হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করলো। কারণ হিসেবে বলা হলো যে, নারীরা যেহেতু মসজিদে গিয়ে বিয়ে পড়াতে পারবে না, নারীরা যেহেতু মাসের একটা সময় ধর্মমতে অপবিত্র থাকে, সেহেতু নারীরা নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবে না। একই কারণে হিন্দু নারীদের পৌরহিত্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে।

যাই হোক, যদিও ম্যারেজ রেজিস্ট্রি কোনো ধর্মীয় কাজ না, যদিও গার্ড অব অনার কোনো ধর্মীয় প্রক্রিয়া না, যদিও ধর্ম মানতে সবাই বাধ্য না, তারপরও পুরুষতন্ত্র রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে। শুধুমাত্র নারীকে আটকানোর জন্য। নারীর পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে নারীকে গার্ড অব অনার দিতে দেখলে অনেক পুরুষেরই সেটা সহ্য হয় না। নারীকে স্বাধীন হতে দেখলে অনেক পুরুষের পুরুষানুভূতিতে আঘাত লাগে।

বর্তমান বাংলাদেশে বিরাট অংশ মেয়ে হিজাব পরে। চারভাগের সাড়ে তিনভাগ নারীই সন্ধ্যার পর ঘরে বসে থাকে। কেউ বলে না, “এটা আরবদেশ না, এটা বাংলাদেশ।” কেউ বলে না, “এখানে নারী-পুরুষ সবাই সবসময় সমান অধিকার রাখে।” অথচ দুই-একটা মেয়ে ওড়না ছাড়া ঘুরলে গোটা দেশ ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে যায়, দুই-একটা মেয়ে রাত-বিরাতে বাইরে থাকলে সমাজের অর্গাজম হয়ে যায়।

এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে সমাজের উচিত মেয়েদের ঘাড়ে দোষ না দিয়ে নিজেকে বদলানো, দ্রুত চিকিৎসা নেয়া। প্রিম্যাচিউর ইজাকুলেশন একটা বড় সমস্যা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]