September 20, 2024
কলামফিচার ৩

মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাঁধনের স্ট্রাগল ও আত্মবিশ্বাস দেখে শিখুন

মেহেরুন নূর রহমান।। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারণে আমি বাংলাদেশের ইদানিংকালের নাটক, সিনেমা, সংগীত ইত্যাদির সাথে জড়িত অনেককেই ভালো করে চিনি না। এ কারণেই আজমেরী হক বাঁধনের কাজের সাথে আমার তেমন পরিচয় ছিল না। রেহানা মরিয়ম নূর চলচ্চিত্রের কারণেই মূলত আমার বাঁধন এবং বাঁধনের কাজ সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয়।

সুখের ব্যাপার তার সম্পর্কে যতই জানছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। বাঁধন ডেন্টিস্ট, বিউটি প্যাজেন্ট বিজয়ী, এক সন্তানের মা এবং সেই সাথে চমৎকার একজন অভিনেত্রী। এবং সর্বোপরি সে একজন নারীবাদী, এবং ঠিক এ জায়গাটি আমাকে চমৎকৃত করেছে সবচেয়ে বেশি। বাঁধন নারীবাদী এবং সে সেটা স্পষ্ট করে বলার মত সাহস রাখে, এটা দেখে আমি মুগ্ধ।

অনেকেই বলতে পারেন এতে মুগ্ধ হবার কী আছে? আছে ভাই আছে। প্রথমত বাংলাদেশের ক’জনই বা নারীবাদ বিষয়টি কী তা বোঝে? প্রচুর লোকজন, নারী কিংবা পুরুষ, তাদের বলতে শুনবেন – আমরা নারীবাদী না, মানবতাবাদী, সমতায় বিশ্বাস করি। নারীবাদী যে সাম্যবাদ এবং মানবতাবাদের উপর দাঁড়িয়ে, এই জ্ঞান কিংবা শিক্ষাই তাদের নেই। আর বিশাল একটি জনগোষ্ঠী তো নারীবাদকে রীতিমত ঘৃণা করে। তাদের কাছে নারীবাদী মানেই যথেচ্ছ যৌনাচারে বিশ্বাসী একজন নারী, যে পুরুষদের ঘৃণা করে আবার সেই সাথে  পুরুষখেকো। অসংখ্য তথাকথিত শিক্ষিত পুরুষদের  মধ্যে আমি দেখেছি, কেউ নিজেকে নারীবাদী বলে পরিচয় দিলে তাকে সহজলভ্য, সহজে বিছানায় নেয়া যায় এমন একজন নারী ভাবে। আর কোন পুরুষের নিজেকে নারীবাদী বলা মানে সে যথেষ্ঠ পুরুষ নয় অথবা নারীদের সাথে শোবার জন্য এটা তার একটি বাহানা।

আমাদের দেশে অভিনয় জগতের সাথে যুক্ত খুব কম নারীকে দেখেছি প্রকাশ্যে বলতে যে সে নারীবাদী। আগেই বলেছি বেশিরভাগেরই নারীবাদ সম্পর্কে যথেষ্ট পড়াশোনা বা ধারণা নেই। দু’একজন সম্পর্কে একটু আশার আলো দেখলেও পরবর্তীতে তাদের নানা কর্মকাণ্ডে সেই আলোটুকু নষ্ট হয়ে গেছে দ্রুত। কেউ কেউ নারীবাদে বিশ্বাস করলেও হয়তো প্রকাশ্যে বলতে সাহস পায় না জনপ্রিয়তা হারাবার ভয়ে। সেখানে বাঁধন যখন নিজেকে প্রকাশ্যে নারীবাদী বলে পরিচয় দেয় তখন আমার তার প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা তৈরি হয়। ব্যক্তিগতভাবে বাঁধন সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে মেয়েটিকে সাহসী তো মনে হয়েছেই, সেইসাথে মনে হয়েছে দায়িত্বশীল, কর্মঠ এবং আত্মনির্ভরশীল। স্বামীর সাথে বনিবনা হয়নি, বের হয়ে এসেছে কিন্তু বাচ্চার কাস্টডি ছেড়ে দেয়নি। প্রাণপণ লড়াই করে বাচ্চার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে।

মেয়েটি ডিপ্রেশনের সাথে যুদ্ধ করা একজন মানুষ। আমার পরিচিত সম্ভাবনাময় অনেককে দেখেছি ডিপ্রেশনের কারণে সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যেতে, জীবনযুদ্ধ করার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলতে। কিন্তু বাঁধন এর মধ্যে থেকেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলছে। সহজ নয় কিন্তু।

রেহানা মরিয়ম নূরের ট্রেইলার দেখেছি, দেখেছি মেকআপবিহীন বাঁধনের ইনটেন্স এক্সপ্রেশনস। আমার ভালো লেগেছে। মূল চলচ্চিত্রটি দেখার অপেক্ষায় আছি। মেয়েটির ফ্যাশন সেন্স দারুন। নিজেকে মেইনটেইন করতে জানে। তার শাড়ি গয়না, ড্রেস সব আমার পছন্দ হয়েছে। তো তার শাড়ী গয়না নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। বাঁধনের পরা পোশাক নিয়ে এতো যে পজেটিভ আলোচনা হচ্ছে সেগুলোকে স্বাগত জানাই। আমাদের দেশে যেখানে দিনদিন মেয়েদের বস্তায় ভরার পাঁয়তারা চলছে সেখানে বাঁধনের পোশাক নিয়ে ইতিবাচক আলোচনাগুলো ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। বাঁধন স্লাট বা বেশ্যা উপাধি পাওয়ার জায়গায় প্রশংসা পাচ্ছে এটা তো দারুন।

বাঁধনকে নিয়ে এই যে আমি লিখছি তার কারণ কিন্তু এই নয় যে বাঁধন দেখতে সুন্দর, স্মার্ট, বা দারুন সব পোশাক এবং গয়না পরেছে কান চলচ্চিত্র উৎসবে। লিখছি কারণ বাঁধনকে আমার ভালো লেগেছে। তার সাজপোশাকের কারণে নয়, কাজের প্রতি তার একাগ্রতার জন্য, সেই সাথে তার সাহসিকতা, আত্মনির্ভরশীলতা এবং দায়িত্বশীলতার জন্য।

অসংখ্য মেয়ে/নারীদের ও দেখছি বাঁধনের শাড়ি গয়না পোশাক মেকআপ নিয়ে নানা রকম পোস্ট দিতে। তার মত শাড়ি, গয়না কেনার হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। অনেকে আফসোস করছে বাঁধনের মত ফিগার কেন তাদের নয় এই দুঃখে।

এ সবই ভালো এবং সবই পজিটিভ আলোচনা। কিন্তু শুধু শাড়ি গয়না নিয়ে পড়ে থাকলে কি চলবে? মেয়েটির কাজ সম্পর্কে জানুন,  স্ট্রাগল সম্পর্কে জানুন, নিজেকে প্রকাশের সাহসিকতাটুকু দেখুন। দেখুন শাড়ি, গয়না  এসব টাকাপয়সা থাকলে অনেকেই কিনতে পারে। স্বামীর বা বাবার টাকায় দামি দামি শাড়ি গয়না পরা নারীদের তো চারপাশ আমরা সারাক্ষণ দেখি। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়জন আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে? কয়জন হতে পারে শ্রদ্ধার পাত্র?

আমাদের সমাজে নারীদের পিতৃতন্ত্রের বলি হওয়ার একটি বড় কারণ এই হল পড়াশোনা না করা (প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলছি না),  আত্মনির্ভরশীল না হওয়া, সবকিছুর জন্য বাবা, স্বামী বা ভাইয়ের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে থাকা। এ ধরনের পরজীবী আচরণই পুরুষতন্ত্রেকে বাঁচিয়ে রাখে যুগের পর যুগ।রূপচর্চা, ফ্যাশন আর গায়ের রং ফর্সা করার জন্য মেয়েরা যতটুকু সময় ব্যয় করে বা চেষ্টা করে ততটুকু যদি লেখাপড়া, ক্যারিয়ার গড়া এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য ব্যয় করতো তবে তারা নিজের আলোয় নিজেই সুন্দরতম হতে পারতো, এবং সমাজের চিত্র  অনেকখানি অন্যরকম হতো।

আমার পরিচিত অনেক মেয়েকে দেখেছি রূপচর্চায় অনেক পারদর্শী কিন্তু বাইরের সামান্য জটিল কোন কাজ করতে পারে না। অনেক নারী নিজে নিজে ডাক্তারের কাছে যেতে ভয় পায় কারণ ডাক্তারের দেয়া ইনস্ট্রাকশনস ঠিকমতো বুঝতে পারবে কিনা সে আত্মবিশ্বাসটুকু নেই। বহু নারী ফাইনান্সিয়াল ব্যাপারে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, টেকনোলজি রিলেটেড জ্ঞান থাকে খুব সামান্য, এদিকে সাজগোজ বা ফ্যাশন সম্পর্কে  জ্ঞানের কমতি নেই। সাজগোজ বা ফ্যাশন সম্পর্ক জ্ঞান থাকা ভালো বই মন্দ নয়, তবে আপনি শুধু এসব ব্যাপারেই জানবেন আর দুনিয়ার আর কিছু সম্পর্কে তেমন আগ্রহ দেখবেন না, সেটা খুব কাজের নয়।

আমার পরিচিত একজনকে জানি দুনিয়ার সব বিউটি পার্লারের নাম জানে, লেটেস্ট ডিজাইনের শাড়ি বা ড্রেসের খবর সবার আগে তার কাছে পাবেন, কিন্তু কিন্তু সামান্য একটা ইমেইল অ্যাকাউন্ট খুলতে জানেনা। নারীটি যে অশিক্ষিত তা কিন্তু নয়, তার শুধু নতুন কিছু জানার আগ্রহ নেই। নিজের জানার গণ্ডির বাইরে নতুন কিছু শিখতে গেলে যে পরিশ্রমটুকু করতে হয় সেটা করার ইচ্ছা নাই।

বেশ কিছু পয়সাওয়ালার বৌদের চিনি, যারা গাড়ি ছাড়া চলতে পারে না। বাসায় দু-চারজন গৃহকর্মী আছে যারা ঘরের সব কাজ করে। শুয়ে-বসে, পার্লারে গিয়ে, নতুন শাড়ি গয়না শপিং করে, সিরিয়াল দেখে তাদের দিন কাটে। এরকম অর্থহীন জীবন কি সত্যিই খুব আনন্দের? যে গার্মেন্টসকর্মী মেয়েটি দিনরাত কাজ করে পরিবারের জন্য, অনেক প্রবঞ্চনার বিনিময়ে উপার্জন করে তার বাচ্চাদের জন্য, তার ঘর্মাক্ত মুখ আমার কয়েক পরত মেকাপ মাখা পয়সাওয়ালা বৌদের চেয়ে অনেক সুন্দর লাগে, তার জীবন আমার কাছে বেশি অর্থবহ এবং মূল্যবান।

আগেই বলেছি রূপচর্চা, সাজগোজ, বা সুন্দর পোশাক গয়না পরা মন্দ বা অন্যায় কিছু নয়, বরং নিজেকে সবজায়গায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন খুব ভালো। কিন্তু সেই সাথে দরকার নিজেকে শিক্ষিত করা, নিজের মননকে উন্নত করা। দরকার স্বনির্ভর হওয়া, নিজের স্বপ্ন পূরণ করবার মতো যোগ্যতা অর্জন করা। শুধু বাঁধন বলে নয় এরকম আরো অসংখ্য নারীর গল্প আপনি চাইলে জানতে পারবেন যারা নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে নিজেকে উজ্জ্বল তারকায় পরিণত করেছেন। তারকা বলতে দিয়ে কিন্তু শুধু সেলিব্রেটিদের বোঝাচ্ছি না। মানুষের বাসায় কাজ করা যে নারীটি স্বামী মারে বলে স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে সন্তানদের নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে বাঁচছে সে আমার চোখে তারকা। যে মেয়েটির সমাজের চোখে তথাকথিত সুন্দরী না বলে, ভালো বিয়ে হবে না এই ভয়ে চিন্তিত সবাইকে পিছনে ফেলে শুধুমাত্র নিজের পরিশ্রম, যোগ্যতা  আর সিনসিরিয়াটি দিয়ে আজকে উচ্চপদে কর্মরত সে আমার চোখে তারকা। যে মেয়েটি নিজের প্যাশন পূরণের জন্য সমাজ, পরিবারের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে স্ব-গৌরবে মাথা উঁচু করে নিজের মত কাজ করে যাচ্ছে সে আমার চোখে তারকা।

আমরা শুধু নিজেদের জন্য বাঁচি না। বাঁচি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও। আজ যদি আপনার মেয়ে আপনাকে শুধু শাড়ি গয়না এসব নিয়েই বেশি কনশাস হতে দেখে তবে সে কী শিখবে? আজকে যদি সে দেখে আপনি পরনির্ভরশীল, তাদের ভেতরও কি পরনির্ভরশীলতা জন্ম নেবে না? কষ্ট করে নিজের জন্য কিছু অর্জনের আনন্দ থেকে কি সে বঞ্চিত হবে না? ভেবে দেখুন  আপনার আচরণ আপনার কন্যার আত্মবিস্বাসী না হবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না তো?

তাই বলছি, জীবনকে একটা গণ্ডিতে বন্দি না রেখে নিজেকে সমৃদ্ধ করুন। বাঁধনদের সৌন্দর্য্য আর সাজসজ্জার বাইরেও আরো সব সাফল্য আছে, অ্যাচিভমেন্ট আছে, স্ট্রাগল আছে সেগুলো জানুন। বাঁধনরা শুধুমাত্র ফ্যাশন আর সাজগোজের জন্য  আপনার অনুপ্রেরণা না হোক,সেই সাথে আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল এবং সাহসী মানুষ হবার জন্যও প্রেরণা যোগাক।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]