November 24, 2024
কলামফিচার ৩

পর্দায় নারীবাদের চতুর্থ ঢেউ

বিধান রিবেরু ।। নারীদের নিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা কী বলে? আমরা যা জানি ও মানি তার সাথে কি প্রতি মুহূর্তের তুলে দেয়া অভিজ্ঞান মেলে? আমরা তো জানি নারীর সমান অধিকারের কথা, আমরা মানি নারীও পুরুষের মতোই সকল কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু বাস্তবতা কি এই জানা ও মানার সপক্ষে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেয়? দেয় না। আর দেয় না বলেই নারীবাদের চতুর্থ ঢেউ উঠেছিল ২০১২ সালে এক ব্রিটিশ নারীবাদী লরা বেটসের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিনের লিঙ্গ বৈষম্যমূলক অভিজ্ঞতাকে অনলাইনে ভাগাভাগি করে নেয়ার আহ্বান করে তিনি যে পথ দেখিয়েছিলেন, তা সম্প্রতি ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ পর্যন্ত এসেছে ঠেকেছে। অবশ্য ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে আফ্রিকান-আমেরিকান নারীবাদী তারানা বুর্কের হাত ধরে। কিশোরীদের জন্য আয়োজিত যৌন সহিংসতা বিষয়ক এক কর্মশালায় নিজেদের বাজে অভিজ্ঞতা ও সাহায্য চাওয়ার কথা বিস্তারিত লেখার বদলে ‘মি টু’ লেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন তারানা। ত্রিশটি মেয়ের মধ্যে কুড়িজনই লিখেছিলেন ‘মি টু’। সেখান থেকে শুরু এই ‘আমিও’ আন্দোলন।

সাম্প্রতিক সময়ে, ২০১৭ সালে, চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় নতুন করে ‘আমিও’ আন্দোলন জেগে ওঠে প্রখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। ওই বছরেই অভিনেতা অ্যালিসা মিলানো টুইটারে ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ লিখে সকলকে আহ্বান জানান নিজেদের হয়রানির অভিযোগ প্রকাশের জন্য। এরপর অস্কার অনুষ্ঠানে নারীদের কালো পোশাক পরা, সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারীদের প্রতিবাদ, গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম – সকল ক্ষেত্রেই নারীদের হয়রানির কথাই বেরিয়ে আসতে থাকে। এটা বলাটা বোধ করি অত্যুক্তি হবে না যে, হলিউডের নারীপ্রধান সুপারহিরো মুভিগুলোতে নারীবাদের এই চতুর্থ ঢেউয়ের ধাক্কা কিছুটা হলেও লেগেছে, যেমন ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ (২০১৭), ক্যাপ্টেন মার্ভেল’ (২০১৯),  ‘ব্ল্যাক উইডো’ (২০২১) ইত্যাদি, এসব ছবি দর্শকপ্রিয়ও হয়েছে।

বাংলাদেশেও, হার্ভের ঘটনার পর, ‘আমিও’ আন্দোলনের প্রভাব চোখে পড়ে। অনেক নির্মাতা, নির্দেশক ও টিভির কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যৌন হয়রানির। তাতে ওই লোকেদের কিছুই হয়নি। বরং সমাজে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও খুনের সংখ্যা বেড়েছে। এখনও বেড়ে চলেছে। সমাজের একটি ছোট সচেতন অংশ এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে, কিন্তু তাতেও থামানো যায়নি শিল্পপতি বা রাস্তার নেশাখোরদের, নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে তো ঘটছেই। বাংলাদেশী সিনেমা ও ওয়েবসিরিজে তো নতুন করে নারীদের পণ্য বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে গত বছর থেকে। এসব কারণে এক পত্রিকা তো শিরোনামই করেছিল: ‘অশ্লীলতার অপর নাম ওয়েব সিরিজ?’ সত্যি ঘটনা অবলম্বনেই হোক বা বানোয়াট কল্পকাহিনী, এসব ধারাবাহিকে নারী যৌনতার সামগ্রী। গত বছর এই প্রকোপ বেশি চোখে পড়ে। তবে ইদানিং হাওয়া বোধহয় কিছুটা বদলাতে শুরু করেছে। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলম্যান’ ধারাবাহিকটি প্রণিধানযোগ্য।

এই ধারাবাহিকে চরিত্র নির্মাণে তাড়াহুড়ো, গল্প বলাতে অস্থির ভাব, সবার অভিনয় উৎরে না যাওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে, কিন্তু যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এর বক্তব্য। এটিও অনেকটা ‘আমিও’ আন্দোলনের প্রতিধ্বনি। ছবির মূল চরিত্র সাবিলা সাহস করে প্রকাশ্যে বলে ‘আমিও’ এই সমাজে হেনস্থা ও হয়রানির শিকার। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। সমাজে জেঁকে বসা পুরুষতন্ত্র ওরফে পিতৃতন্ত্র যেন সাবিলার বাবার মতোই। নারীরা এই “পিতা”কে না পারছে ফেলতে, না পারছে মেনে নিতে। পদে পদে পিতৃতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র তাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়, ভোগ করতে চায়, গ্রাস করতে চায়, শাসন করতে চায়, খর্ব করতে চায়। তাই তো সাবিলার চোখে দেখা যায় মুক্তির স্বপ্ন, বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন।

ইরানি একটি ছবি দেখেছিলাম: ‘আ সেপারেশন’ (২০১১), সেখানে নাদের চরিত্রটির বাবাও সাবিলার বাবার মতো অসুস্থ, জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিল পরিবারের উপর। সেই ছবিতে নাদেরের বাবা হয়ে উঠেছিল ইরানি ধর্মভিত্তিক, পশ্চাদপদ সমাজের প্রতীক। আজগর ফরহাদির ওই ছবির শেষে যেমন নাদের ও সিমিন, স্বামী-স্ত্রী, কাঁচের তৈরি বিভাজনের দুপাশে বসে বিচ্ছেদের রেখা টানছিলেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর এই সিরিজেও দেখা যায় সাবিলা ও তার স্বামী একটি করিডোরের দুইপাশে দাঁড়িয়ে। স্ত্রীর বক্তব্য, স্বামীর পৌরুষের কারণে যৌন হয়রানি করা লোকটি আর শাস্তি পেলো না, কারণ স্বামী সেই লোকটিকে খুন করে ফেলেছে। এখানেও নারীটি পুরুষের কাছ থেকে দূরত্ব রচনা করে। সাবিলা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করে। সাবিলার পাশে এসে দাঁড়ায় লরা, আরেক নারী, সাবিলার হেনস্তাকারী কবি খায়রুল আলমের মেয়ে। অবশ্য তাতে পিতৃতন্ত্র বলি কি পুরুষতন্ত্র, তার কিন্তু অবসান হয় না। তারপরও বলবো সাবিলা ও লরাকে দেখে আশার সলতেতে আগুন লাগে, সেটাই বা কম কি!

নারী চরিত্রকেন্দ্রিক আরো একটি ছবির কথা বললেই নয়, বাংলাদেশের ছবি, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ (২০২১), আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ছবি। এই ছবিতেও, পড়েছি, প্রাত্যহিক প্রতিকূলতা ঠেলে একজন নারী অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যায় শেষতক। ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে, দেশে এখনো মুক্তি পায়নি। যা হোক, কথা হলো শুধু হলিউড বা ঢাকার স্বাধীন নির্মাতারা নন, পাশের দেশও নারীকেন্দ্রিক গল্পে মনোযোগ দিয়েছে। বলিউডের চলচ্চিত্রে এ যেন নারীশক্তির পুনরুত্থান। ‘মাদার ইন্ডিয়া’র কথা মনে রেখেই সম্প্রতি কিছু ছবির নাম যদি বলি, যেমন ‘কাহানি’ (২০১২), ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ (২০১২), মারদানি (২০১৪), ‘ম্যারি কম’ (২০১৪), নিরজা (২০১৬), মম (২০১৭), গুঞ্জন সাক্সেনা: দ্য কার্গিল গার্ল (২০২০) প্রভৃতি ছবি নারীশক্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছে।

চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকে যদিও অধিকাংশ সময়েই নারীর কথা একজন নারী বলেন না, বলেন পুরুষ, তাই সেটি নিয়ে নারীবাদীদের ভেতর আলোচনা আছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল আছে। সেক্ষেত্রে একজন নারী নির্মাতার কথা মনে এলো – তাঁর নাম আগ্নেস ভার্দা – ‘ক্লেও ফ্রম ফাইভ টু সেভেন’ (১৯৬১) ভার্দার বিখ্যাত ছবি। এক গায়িকার মৃত্যু মুখোমুখি এসে নিজেকে আবিষ্কারের গল্প বলা হয় এতে। অসাধারণ ছবি। নারীর চোখ দিয়ে নারীকে অঙ্কন। তবে উল্টো চিত্রও আছে, যেমন ‘দ্য হার্ট লকার’ (২০০৮), ক্যাথেরিন বিগেলো নারী নির্মাতা হলেও, তার ছবিটি একেবারে টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক হলিউডের ঐতিহ্য বহন করছে ষোলো আনা। নারীরাও পুরুষতন্ত্রকে চিন্তায় ধারণ করতে পারে, এই ছবিটি তারই উদাহরণ। তবে নারীর দুঃখ, বেদনার সঙ্গে মিশে গিয়ে ছবি তৈরির নজিরও কম নেই। যেমন ফরাসি লেখক, পর্নতারকা ও নির্মাতা ওভিডি বানিয়েছেন অনেক ছবি। নারীবাদী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা লরা মালভের কথাও বলা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ও আসরগুলোতে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ অনেক কম। এটা নিয়ে সমালোচনা আছে।

নারীরা চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমেই শুধু নয়, ওয়েব পোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বৈষম্য দূর করার কথা বলছেন, নিজেদের স্বতন্ত্র শক্তির দিকটিও চিহ্নিত করছেন। তবে নারীবাদের এই চতুর্থ ঢেউকে কোনোভাবেই পুরুষের প্রতিপক্ষ করে ভাবা ঠিক হবে না। নারী ও পুরুষ কেউ কারো প্রতিপক্ষ নন। কিন্তু নারী যে সমাজব্যবস্থার শিকার, সে সমাজব্যবস্থায় পুঁজিবাদ, পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র সমানভাবে সক্রিয়। আর এই তিনটিই নারীর জন্য বৈষম্যের সৃষ্টি করে। লরা বেটসের কথার প্রতিধ্বনি তুলেই শেষ করি তাহলে, এই বৈষম্য বা পুরুষপ্রাধান্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে নারী ও পুরুষের মুখোমুখি অবস্থান নয়, বরং বদ্ধমূল কিছু ধারণা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই। এই লড়াইতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করা উচিত।