স্বৈরাচারী পুরুষ বনাম নারীর চাওয়া-পাওয়া
মনিরা সুলতানা মুন্নী ।। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো একে অন্যের উপর নির্ভর করা। যদি পরিবারের কথা চিন্তা করা হয় তাহলে চিত্রটা পরিস্কার বোঝা যাবে। আমাদের আরো একটা প্রবৃত্তি আছে, সেটা হলো অন্যকে নিজের মতো পরিচালনা করার চেষ্টা। আমাদের মস্তিষ্কে এমন কিছু বিষয় গেড়ে বসেছে যেটা উপড়ানো কঠিন। আমরা যে বিষয়গুলো দেখে, সমাজের যে মাপকাঠির মধ্যে বা গণ্ডির ভেতরে বড় হয়েছি, সেখানকার ভালো মন্দ চলা-ফেরার নিয়মকানুনগুলোকে একমাত্র ঠিক মনে করি এবং চাই সেই অনুযায়ী বাকি সকলে চলুক। কোনো কোনো সময় আমাদের এই মানসিকতা চরমভাবে প্রকাশ পায়।
মস্তিষ্কে গেড়ে বসা মান্ধাতা আমলের শিকড় পৌঁছেছে পাতালের অন্তে এবং সেই ধারণা দিয়ে আমরা ঘটা করে দুঃখীস্বরে গল্প করতে শুনি- ‘‘চিন্তা করো ভাই, মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়াশুনা করে শেষমেশ কী করছে? সেই তো সংসারের কাজই করতে হচ্ছে, তাহলে কেন এই আসনগুলো দখল করলো? এরা পড়তে না আসলে এই আসনে কিছু ছেলে পড়তো। তারা ভালো অবস্থানে যেতে পারতো এবং একটা সংসার বেঁচে যেত! কী দরকার ছিলো আসনগুলো নষ্ট করার?
যারা এগুলো বলে তাদেরকে বলতে ইচ্ছে করে, নারী শেষমেষ কিছু করছে না কেন? নারীর জন্য কতোটা সুযোগ তারা রেখেছে? বিয়ের কথা এগোনোর প্রথম বাক্য হয় আমাদের বউকে কিন্তু আমরা চাকরি করতে দেব না। যেন মানুষ না মাংসের পিণ্ড কিনে নিয়ে যাচ্ছে যেভাবে খুশি রান্না করে খাবে! জানতে ইচ্ছে করে, তারা স্ত্রী চাকরি করবে এজন্য সংসারের কোন দায়িত্বটা নিয়েছে? স্বামী-শ্বশুরবাড়ির কথামতো চলবে ভেবে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী মেয়ে খোঁজা হয় এখনো এই সমাজে।
পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নারীদের আলাদা আসন নিয়ে যারা কটুক্তি করেন তারা কি জানেন না কাদের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পেতে নারীর আলাদা আসনের এই ব্যবস্থা? সংসারে নারী হেনস্থা হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নেই, রাস্তায় নারী সুরক্ষিত নয়, নারী একা চলতে পারবে না কিছু পুরুষের ভয়ে। তাদের অপমানবোধ কেন হয় না? নারীর নিরাপত্তা তারা দিতে পারে না, এর পুরো দায় পুরুষের, সেটাও মানতে পারেনা কেন?
কেন ধর্ষণের শিকার মেয়েদের শুনতে হয় তার পোষাক ঠিক ছিল না, তার চরিত্র ঠিক ছিল না, তার এতো রাতে বাইরে যাওয়া ঠিক না ইত্যাদি ইত্যাদি? পুরুষের ঠিক-ভুল কেন ধরা হয় না? পুরুষ কেন বুঝতে পারে না যে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার দায় একমাত্র তার!
কে কী পোষাক পরলো, কে কোন কাজটি ভালো করেনি, কার কোন সময় কোথায় যাওয়া উচিৎ এবং অনুচিত এসব নিয়ে আমরা সমালোচনা করি। তার কারণ আমাদের সেই প্রবৃত্তি, যা কিনা আমাদের নিজের ভাবনায় যে বিষয়গুলো ভালো এবং ঠিক বলে মনে করি সে বিষয়গুলোকে দিয়ে অন্যের চলার পথকে বিশ্লেষণ করি, নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি, এবং সেইমতো না চললে আমাদের ইগোতে আঘাত পাই। এই আঘাতের ঝাল মেটাতেই আমরা অন্যের সমালোচনা করি। অন্যের মত, পথ বা বিশ্বাসের সাথে না মিললে আমরা সেটা সহজভাবে মেনে নিতে পারি না, চেষ্টাও করি না বরং চেষ্টা করি তার বিশ্বাস, পছন্দ ও চলার পথকে ব্যঙ্গ করে তাকে জবরদস্ত অপমান এবং অন্য কারো কাছে তাকে ভুল অথবা খারাপ করে উপস্থাপন করার।
এই মানসিক অবস্থা তৈরি হয় পরিবার থেকে, যেখানে সচরাচর বাবা হয় উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এবং তারই একমাত্র অধিকার থাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। এবং তিনিই নির্ধারণ করেন পরিবারের কোন ব্যক্তির চলাফেরা কেমন হবে। তার নিয়মের গণ্ডির বাইরে যাওয়ার চেষ্টাটুকুও করলে পেতে হবে শাস্তি, এই শাস্তি এক এক পরিবার বা সমাজিক অবস্থান ভেদে আলাদা হয়, যেমন নিম্নবিত্ত পরিবারের শাস্তির ধরণ- অসভ্য ভাষার প্রয়োগ এবং শারীরিকভাবে বর্বর নির্যাতন। এর আওতাভুক্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বাবা মা ও স্ত্রীর কথা বলাই বাহুল্য। এখানে সন্তান তার মতামত দেয়ার করার সুযোগ পাচ্ছে না, খুব সহজে বলে দেওয়া হচ্ছে – “ও কী বোঝে যে বলবে”। মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে এই নিয়মের প্রয়োগ আরো ভয়ংকর।
মেয়ে সন্তান নিজের মতো করে জীবনকে পরিচালনা করতে নিজের ভালো মন্দ নিজে নির্ধারণ করছে, তাকে দুর্বল করতে বাবা বলছে – ‘‘আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজের মত ফলাবা’’। গাদা গাদা টাকা যৌতুক, ঘরভর্তি জিনিস দিয়ে মেয়েকে পরের ঘরে পাঠাতে বাবাকুলের যে খাটুনি তা যদি মেয়েকে প্রতিষ্ঠা করায় থাকতো তাহলে মেয়েদের জীবন কিছুটা মসৃণ হতো। তেমনই স্ত্রী কিছু করতে গেলে শুনতে হবে – ‘‘আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে করবা যা করার। আমার বাড়িতে এসব চলবে না”।
বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে এসে পুরুষ বলছে, ‘‘বিয়ের পরে আমার উপর খবরদারি করতে পারবা না, আমি যা করবো মেনে নিতে হবে। আমাকে আমার মতো চলতে দিতে হবে’’। নারীর এমন শর্তের কথা শুনলে এ সমাজ পারলে গঙ্গাজলে স্নান করে শুদ্ধ হয়!
এমন পারিবারিক পরিস্থিতি যেখানে সন্তান দেখে বড় হচ্ছে পিতাই সকল শক্তির উৎস এবং সকল ক্ষমতার প্রতীক, তখন ওই পরিবারের ছেলে সন্তানটিও এটা স্বাভাবিক মেনে বড় হচ্ছে আর এভাবেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে সামাজিক কাটামো যেটা মোটেও নারীর অনুকূলে নয়।
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় পরিবারের নারীর গুরুত্ব বেশি, তখন আবার শুনতে হয় নানা তিক্ত কথা, ওই পরিবারের পুরুষটিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়- মেয়েমানুষের কথায় ওঠে বসে। ওতো মেয়েমানুষেরও অধম! যার উপরে মেয়ে মানুষ খবরদারি করে সে পুরুষ নামের কলঙ্ক, এর থেকে ভালো শাড়ি চুড়ি পরা। আরো নানা বিষবাক্য।
এ সবই আমাদের প্রাচিনপন্থী মনোভাব। আমরা যা দেখে বড় হয়েছি এবং যেটাকে ঠিক বলে মনে করি, সেটাই প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতা।
আমরা যেহেতু একত্রে বসবাস করি, তাই সহজভাবে আমাদের দৈনন্দিন কিছু কাজকর্ম, চাওয়া পাওয়া, একজনের আরেকজনের উপর নির্ভরশীলতা। আমরা আশা করি, আমার সাথের মানুষটি আমার জন্য আমার মনের মতো করে চলবে। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না, যার কাছে আমার চাওয়া সে আসলে সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ, তারও মাথাভর্তি ঘিলু, যেটা আমাদের কাছে বুদ্ধির প্রতীক। তার আলাদা রুচিবোধ আছে। মোটকথা একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। কিন্তু মেয়ে মানুষকে আমরা ভাবি যে, সে সব জায়গার যোগ্য নয়, তার জন্ম হয়েছে ঘর গুছানোর কাজ করার জন্য। ‘মেয়ে মানুষ’ মানে দুর্বল। সেহেতু তাকে তার স্বামীর কথামতোই চলতে হবে। তা যদি সে না চলে তাহলে তাকে নির্যাতিত হতে হবে। এই নির্যাতনটিই হচ্ছে পুরুষের মানসিকতা প্রকাশের চরম পর্যায়, যেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর জন্য বিপদজনক।
চাওয়া কিন্তু একজন নারীরও থাকে। সেক্ষেত্রে পুরুষের কোনও দায়বদ্ধতা থাকে না এবং পুরুষের চাওয়া পূরণ না হলে পুরুষ যে আগ্রাসী ব্যবহার করে নারী তা করে না। এটাই মানসিকতার দু’টি দিক। একটি সহনশীলতা আর একটা আগ্রাসী।
নারীর উপর নির্যাতনের বড়ো একটি কারণ মানসিকতার এই স্বৈরাবস্থা। যেটা চাইলেই পরিবর্তন সম্ভব।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]